সড়ক দুর্ঘটনা
শূন্যঘরে স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজে বেড়ান সুমন, ছেলের জন্য হাহাকার নূর আলমের
‘যখন ঘরে ঢুকি, ছেলেকে খুঁজি, স্ত্রীকে খুঁজি। অবুঝ বড় মেয়েটিও খুঁজে বেড়ায় মা-ভাইকে, কেউ আর সাড়া দেয় না। তাদের ছাড়া এই বাসায় থাকা প্রতিটি সেকেন্ডই যেন অসহ্য যন্ত্রণার।’
কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে মোহাম্মদ সুমনের। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় চোখের সামনে স্ত্রী ও একমাত্র ছেলের মৃত্যু দেখা বছর চল্লিশের এই যুবকের চারপাশে এখন শুধুই শূন্যতা।
সেদিন পেছন থেকে আসা বেপরোয়া যাত্রীবাহী বাসের চাপায় মুহূর্তেই প্রাণ হারায় বাবার মোটরসাইকেলে থাকা সুমনের ছয় বছর আট মাস বয়সী ছেলে নেহাল ইসলাম আব্দুল্লাহ। একই দুর্ঘটনায় নিহত ছয়জনের মধ্যে ছিলেন সুমনের স্ত্রী রেশমা বেগমও। অন্য চারজনও একই পরিবারের, যারা ছিলেন দুর্ঘটনার শিকার একটি প্রাইভেটকারের যাত্রী। তারা হলেন বৃদ্ধা আমেনা আক্তার, তার দুই মেয়ে ইসরাত জাহান ইমু ও রিহার এবং আরেক মেয়ের ঘরের নাতি তিন বছরের শিশু আয়েজ।
‘আমার বোনেরা ছিল, তারা চলে গেছে। এখন সংসার কে চালাবে? যেখানে শূন্যঘরের অন্য সবকিছুকেই মৃত বলে মনে হয়, আমরা বাবা-মেয়ে সেখানে কীভাবে থাকবো?’- হাহাকার করে বলছিলেন সুমন।
শূন্যঘরে স্ত্রী-সন্তানের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো পাঠাও বাইক রাইডার সুমন জানান, শ্যালিকার বিয়েতে যেতে নিজের মোটরসাইকেলেই স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে ঢাকা থেকে মাদারীপুরে যাচ্ছিলেন তিনি। বেলা ১১টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ধলেশ্বরী টোল প্লাজার মাওয়ামুখী লেনে ধলেশ্বরী টোলপ্লাজায় টোল দেয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ করেই বাসটির ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে পড়ে ওই বাসেরই চাকায় পিষে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় তার ছেলে আব্দুল্লাহ। বাসের চাকায় চাপা পড়ে গুরুতর আহত স্ত্রী রেশমার মৃত্যু ঘটে হাসপাতালে। আহত পাঁচজনের মধ্যে সুমনও ছিলেন। তবে হাসপাতালে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে এখন ফাঁকা বাসায় মেয়েটিকে নিয়ে থাকেন তিনি।
এক ছেলে ও এক মেয়ের পড়াশোনা চালাতে বাড়তি আয়ের আশায় মগবাজারে চায়ের দোকান করেছিলেন সুমন। নার্সারিপড়ুয়া ছেলেকে গত বছর ভর্তি করেছিলেন মাদ্রাসায়। বড় হয়ে শিক্ষিত আলেম হয়ে বাবা-মায়ের কষ্ট ঘোচাবে, আশা ছিল পরিবারটির।
সুমন বলেন, ‘ছেলেটি চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। সারাক্ষণ দুরন্তপনায় বাড়ি মাথায় করে রাখতো। কাজ থেকে ঘরে ফিরে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হতো ছেলেমেয়ের মুখে চেয়ে। ওদের ঘিরেই আমাদের সব স্বপ্ন। এখন তো স্বপ্ন ভেঙে গেল, সঙ্গে চলে গেল ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ওর মা-ও।’
‘যদি সম্ভব হতো, আমার প্রাণের বিনিময়ে মা-ছেলেকে বাঁচাতাম। চোখের সামনে ওদের এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না।’
ফায়ার সার্ভিস ও হাইওয়ে পুলিশ জানায়, ঘটনার সময় টোল দিতে অপেক্ষমাণ ছিল প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেলসহ কয়েকটি যানবাহন। এ সময় দ্রুতগতির কুয়াকাটাগামী ব্যাপারী পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টোলপ্লাজার ব্যারিয়ার অতিক্রম করে অপেক্ষমাণ প্রাইভেটকারকে চাপা দিয়ে আরও কয়েকটি যানবাহনকে ধাক্কা দেয়। এতে দুই পরিবারের ছয়জন নিহত ও চারজন গুরুতর আহত হন।
হতাহত হওয়া অন্য পরিবারটির গৃহকর্তা এজেন্সি ব্যবসায়ী নূর আলম জানান, নিজস্ব প্রাইভেটকারে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গোপালগঞ্জে এক আত্মীয়ের মৃত্যুর চার দিন পর দোয়ার আয়োজনে যাচ্ছিলেন তিনি। টোলপ্লাজায় টোল পরিশোধ করতে দাঁড়ায় তাদের গাড়িটি। ভেতরে হাসি-খুশি পরিবারের সঙ্গে মেতে ছিলেন কথায়-আনন্দে। বছর তিনেকের ছেলে আয়াজ ছিল তার কোলেই। উচ্ছ্বল-প্রাণবন্ত সেও মেতে ছিল পারিবারিক ভ্রমণের আনন্দে। চোখের পলকে ব্যাপারী পরিবহনের বাসটি এসে মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাসের সঙ্গে ধাক্কা দেয় তাদের প্রাইভেটকারটিকেও। বাবার কোল থেকে ছিটকে বাসের চাপায় প্রাণ হারায় আয়াজ। প্রাইভেটকার দুমড়ে-মুচড়ে মারা যান তার শাশুড়ি আমেনা আক্তার আর দুই শ্যালিকা ইমু ও রিহারও।
মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বাঁচলেও আহত হন নূর আলম, তার স্ত্রী অনামিকা, ছোট বোন ও প্রাইভেটকারটির চালক। তিনি সুস্থ হয়ে ঢাকার বাসায় ফিরলেও স্ত্রী ও ছোট বোন আনোয়ারা খান মেমোরিয়ালে চিকিৎসাধীন।
চোখের সামনে প্রিয়জনদের এমনভাবে হারানোর কারণে নূর আলমের জন্য বেঁচে থাকাটাও যেন এখন অসহনীয় কষ্টের। মানসিক বিপর্যস্ততায় দুর্বিষহ তার দৈনন্দিন জীবনযাপন। স্ত্রী ও ছোট বোনকে হাসপাতালে রেখে ছোট ছেলের শোকে বিহ্বল তিনি।
নানা স্মৃতিচারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়া নূর আলম বলেন, ‘ছোট্ট ছেলেটা আমার বুকের ওপর ছিল। টোল দিতে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। হঠাৎ কোনো হর্ন নাই, কিচ্ছু নাই, আমাদের ওপর দিয়ে গাড়ি উঠাই দিছে। চোখের পলকে ছেলেটা আমার থেকে চলে গেছে। আমার ছোট ও বড় শ্যালিকার সঙ্গে চলে গেছেন শাশুড়িও। হাসপাতালে ভর্তি স্ত্রী কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও ছোট বোনের অবস্থা ভালো না।’
‘চোখের পলকে আমার পুরো পরিবার শেষ। আমার নির্দোষ পরিবারের কী এমন দোষ ছিল? কেন এভাবে প্রাণ দিল? আমি এর বিচার চাই, বিচার চাই’- আহাজারি করে বলেন তিনি।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে নূরে আলম বলেন, ‘যদি এক সেকেন্ড সময় পেতাম, ছেলেকে বাঁচাতে পারতাম। আমার ছেলেটা আমার বুকে নেই, কীভাবে বাঁচবো? আমিও তো বাঁচতে পারবো না ছেলেকে ছাড়া। আমাদের সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তার জন্য রাষ্ট্রই দায়ী। সেখানে কোনো স্পিড ব্রেকার ছিল না, কেন ছিল না? লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার, ফিটনেসবিহীন গাড়ি কীভাবে তারা রাস্তায় চালাতে পারে?’
যাদের অবহেলায় এতো বড় দুর্ঘটনা, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা এবং গাড়িচালকসহ জড়িতদের ফাঁসির দাবিও জানান তিনি।
ওই দুর্ঘটনার নির্মমতা নাড়া দিয়েছে দেশবাসীকেও। ভাবাচ্ছে সবাইকে। প্রশ্ন উঠেছে, অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল, চালকের অসতর্কতা, মালিকপক্ষের গাফিলতি, অব্যবস্থাপনায় পদ্মা সেতু ঘিরে গড়া অত্যাধুনিক মহাসড়কটিতে আর কতো প্রাণ ঝরবে?
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন বলছে, মরণফাঁদে পরিণত হওয়া ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গত এক বছরে ৭২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫১ জন। আর সারা দেশে সব মিলে প্রাণ হারিয়েছেন আট হাজার ৫৪৩ জন। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর আহতদের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে