Views Bangladesh Logo

সুপারনোভা রেমন্যান্ট N49 ও নক্ষত্রের কবি জীবনানন্দ দাশ

Dipankar  Dipon

দীপংকর দীপন

ল্যানিয়াকেয়া সুপারক্লাস্টারের লক্ষাধিক গ্যালাক্সির একটি আকাশগঙ্গা। তার একটি ছোট্ট নক্ষত্র সূর্যের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবীর একজন কবি কোনো এক রাতে পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে:
‘পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হ’য়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি?’

সেই কবি জীবনানন্দ দাশ। তার ‘দুজন’ কবিতায় তিনি এই প্রশ্ন করে গেছেন- নক্ষত্রেরও কি মরে যেতে হয়? হয়। নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়। মহাবিশ্বে যে সব মহাজাগতিক ঘটনা ঘটে চলে তার ভেতর একটি অন্যতম আগ্রহউদ্দীপক বিষয় হলো নক্ষত্রের মৃত্যু ও জন্ম। নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যুর এই চক্র আমরা বোঝার চেষ্টা করবো সুপারনোভা রেমন্যান্ট N49-এর মধ্য দিয়ে।


২০১০ সালে চন্দ্রা এক্সরে অবসারভেটরি থেকে প্রকাশিত


এই যে ছবিটি দেখছেন- সেটা কোনো রঙিন ধোঁয়ার কুণ্ডলি নয়... এটা এক মহাজাগতিক বিস্ফোরণের সাক্ষী- যার নাম সুপারনোভা রেমন্যান্ট N49। এটি একটি বিশাল, জটিল গ্যাসের মেঘ যা দেখতে এক বিশাল আতশবাজির মতো লাগলেও, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি তারার শেষ নিঃশ্বাসের গল্প। সুপারনোভা (Supernova) হলো একটি নক্ষত্রের জীবনের শেষ পর্যায়ে ঘটে যাওয়া এক বিশাল বিস্ফোরণ যা এতটাই শক্তিশালী যে কিছু সময়ের জন্য সেই একটি তারা পুরো গ্যালাক্সির চেয়েও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নক্ষত্রের জ্বালানি শেষ হলে সংগঠিত হয় এই সুপারনোভা বিস্ফোরণ। নক্ষত্রের ক্ষয় আছে। সেই ক্ষয় নিয়ে নক্ষত্রের কবি জীবনানন্দের হাহাকারও আছে। “নির্জন স্বাক্ষর” কবিতায় জীবনানন্দ লিখছেন:


‘নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,
নক্ষত্রের মতন হৃদয় পড়িতেছে ঝ’রে-
ক্লান্ত হ’য়ে- শিশিরের মতো শব্দ ক’রে।’

নক্ষত্রের ক্ষয়ে কবির চেতন-অবচেতন শুধু শুধুই হাহাকারে পূর্ণ হয় নাই। কারণ তিনি জানতেন নক্ষত্রের ক্ষয় হয় প্রতিনিয়ত, তাই মৃত্যুও হয় প্রতিনিয়ত। নক্ষত্রের ক্ষয় কীভাবে হয় তা বোঝার জন্য নক্ষত্রের গঠন ও জ্বলন প্রক্রিয়া বুঝতে হবে। আমরা আকাশে যেসব নক্ষত্র দেখি, তারা আসলে প্রধানত

হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের বিশাল গ্যাসীয় গোলক- যাদের কেন্দ্রভাগে ঘটে চলেছে নিউক্লিয়ার ফিউশন নামে একটি প্রক্রিয়া। আমাদের চেনা আগুন সেখানে জ্বলে না। পৃথিবীর আগুন হলো অক্সিজেনের সঙ্গে কার্বনের বিক্রিয়া যা তুলনামূলকভাবে কম শক্তি উৎপন্ন করে। নক্ষত্রে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস (প্রোটন)গুলো একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। যেমন প্রতি সেকেন্ডে সূর্য ৬০ কোটি টন হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তর করে! ফিউশনে উৎপন্ন শক্তি গামা রশ্মি হিসেবে শুরু হয়, পরে নক্ষত্রের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করার সময় তা দৃশ্যমান আলো, তাপ ও অন্যান্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যে রূপান্তরিত হয়। নক্ষত্র বেঁচে থাকে যতদিন পর্যন্ত এর কেন্দ্রে হাইড্রোজেন ফিউশন চলতে থাকে; কিন্তু এই জ্বালানি (হাইড্রোজেন) চিরস্থায়ী নয়- এক সময় তা ফুরিয়ে যায়। ভর যত বেশি হয়, তার জ্বালানি (হাইড্রোজেন) তত দ্রুত নিঃশেষ হয় এবং মৃত্যু তত তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে।

জীবনানন্দ তার মহাজাগতিক বোধ দিয়ে নক্ষত্রের আয়ু শেষ হয়ে যাবার কান্নাটা টের পেয়েছিলেন। “স্বপ্নের হাতে” কবিতায় তিনি লিখেছেন:
‘সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব-
নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয়!’

জীবনানন্দ জানতেন মানুষের মতো, পাখির মতো, ফুলের মতো নক্ষত্রও অমর নয়। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছে প্রতিটি নক্ষত্র, গ্রহ ও উপগ্রহ। সময়ের হাত মুছে ফেলে সব আর এক মহাবিস্ফোরণে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নক্ষত্ররা। ঠিক এই মুহূর্তে এই মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও নক্ষত্র মরে গিয়ে সুপারনোভা হচ্ছে। দুই ধরনের সুপার নোভা আছে।

১. খুব বড় এবং ভারী নক্ষত্ররা (যেমন - যাদের ভর সূর্যের চেয়ে ৮ গুণ বা বেশি) জীবনের শেষে তাদের কেন্দ্রে লোহা (iron) তৈরি করে। লোহা নিউক্লিয়ার ফিউশন সমর্থন করে না, তাই নক্ষত্রের কেন্দ্রে শক্তি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কেন্দ্রীয় অংশ ভেঙে (collapse) পড়ে। এই বিপুল পরিমাণ ভর আকস্মিকভাবে সংকুচিত হয়ে নিউট্রন তারা বা কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হয়। নক্ষত্রের বাইরের স্তরগুলো তখন ভয়ংকর গতিতে বিস্ফোরিত হয় - এটিই সুপারনোভা। এটাকে বলে ম্যাসিভ নক্ষত্রের মৃত্যু (Type II Supernova)।

২. একটি সাদা বামন নক্ষত্র যদি একটি কাছাকাছি থাকা অন্য নক্ষত্রের কাছ থেকে গ্যাস টেনে নিয়ে নিজের ভর বাড়াতে থাকে, এবং যখন এটি চন্দ্রসেখর সীমা (প্রায় ১ দশমিক ৪ গুণ সূর্যের ভর) অতিক্রম করে, তখন হঠাৎই এটি ভয়াবহ বিস্ফোরণে উড়ে যায় - এটিও সুপারনোভা। একে বলে সাদা বামন নক্ষত্রের সঙ্গে বাইনারি সিস্টেমে থাকা অন্য একটি নক্ষত্রের বিক্রিয়া (Type Ia Supernova)।


২০০৩ সালে নাসা থেকে প্রকাশিত সুপারনোভা রেমন্যান্ট N49 এর ছবি। মহাবিশ্বের নকল ছবির ভিড়ে আসল ছবি পাওয়াই দুষ্কর। কারণ মহাবিশ্বের যেসব ছায়াপথ, ব্লাকহোল, নক্ষত্রমণ্ডলির ছবি অনলাইনে ঘুড়ে বেড়ায় তার বেশিরভাগই কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ।


N49 হলো একটি টাইপ-২ সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে তৈরি রেমন্যান্ট। এই সুপারনোভা রেমন্যান্ট N49 গ্যাস ও ধূলির বিশাল মেঘ যা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় নিক্ষিপ্ত পদার্থ দ্বারা গঠিত হয়েছে এবং মহাকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। মহাবিশ্বের নকল ছবির ভিড়ে আসল ছবি পাওয়াই দুষ্কর। কারণ মহাবিশ্বের যেসব ছায়াপথ, ব্লাকহোল, নক্ষত্রমণ্ডলির ছবি অনলাইনে ঘুড়ে বেড়ায় তার বেশিরভাগই কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ। নাসা থেকে প্রকাশিত সুপারনোভা রেমন্যান্ট N49-এর এই ছবিটি হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (HST)-এর ওয়াইড ফিল্ড প্ল্যানেটারি ক্যামেরা ২ ব্যবহার করে তোলা হয়েছে। এই রঙিন দৃশ্য হাবল স্পেস টেলিস্কোপে ধারণ করতে বিশেষ ফিল্টার ব্যবহার করে ধরা হয়েছে সালফার, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন গ্যাসের আলো। তারপর সেগুলো বসানো হয়েছে তারাভরা একটি সাদাকালো ছবির উপরে- যাতে মহাজাগতিক শিল্প যেন আরও প্রাণ পায়। পেছনের তারাদের ছবিও কিন্তু হাবল দিয়েই তোলা। এই N49 বিশেষভাবে গুরুত্বপুর্ণ কারণ এটি বৃহৎ ম্যাজেলানিক মেঘ বা Large Magellanic Cloud (LMC)-এ অবস্থিত যা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির খুব কাছের একটি স্যাটেলাইট গ্যালাক্সি। N49 হলো Large Magellanic Cloud-এ পাওয়া সবচেয়ে উজ্জ্বল সুপারনোভা রেমন্যান্ট। LMC একটি ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি যা মিল্কিওয়ের মহাকর্ষীয় টানে আবদ্ধ। যেটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১,৬৩,০০০ আলোকবর্ষ দূরে। LMC- মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে কসমিক ল্যাবরেটরি কারণ এখানে আছে টারান্টুলা নেবুলা (30 Doradus) নামে বিশাল এক নক্ষত্র তৈরির অঞ্চল। নক্ষত্র কীভাবে জন্ম নেয়, বড় হয় এবং মারা যায় -এসব বুঝতে LMC-কে বিজ্ঞানীদের খুব দরকার। আর কবির দরকার নক্ষত্রের মৃত্যুকে এক মহাজাগতিক দীর্ঘশ্বাস মহাকাশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। কারণ একটি নক্ষত্রের মৃত্যু থেকেই তো আরেকটি নক্ষত্র জন্ম নেয়।

যে নক্ষত্ররা মরে যায় তার জন্য তাদের জন্য এক মহাজাগতীয় হাহাকার অনুভব করে জীবনানন্দ “নির্জন স্বাক্ষর” কবিতায় লেখেন, ‘তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত
যে-নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার।’

মৃত্যু শীতল, তার চেয়েও শীতল মহাকাশ। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নক্ষত্র কেবল মহাজাগতিক বস্তু নয়, বরং সময়, অনন্ততা ও মানব অস্তিত্বের রূপক। তার কবিতায় মৃত্যুচেতনা প্রায়শই প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের সঙ্গে মিশে যায়। আকাশের গভীরে, সময়ের অতল স্রোতে, জন্ম নেয় তারা-নক্ষত্র। আগুনের মতো জ্বলন্ত, তারা আলোকিত করে গ্যালাক্সির নিঃসঙ্গ প্রান্তর। কোটি কোটি বছর ধরে নক্ষত্ররা আলো বিলায়, তাপ দেয়, সৃষ্টি করে মহাবিশ্বের টুকরো টুকরো গল্প; কিন্তু তারাও চিরন্তন নয়। যখন একটি নক্ষত্র জ্বালানির শেষ বিন্দু পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলে, তখন তার ভিতরে শুরু হয় নীরব কান্না, শেষ হয়ে যাবার আর্তনাদ। কেউ ধীরে নিভে যায়-সাদা বামন (White Dwarf) হয়ে। কেউ বিস্ফোরিত হয় বিশাল শব্দে- সুপারনোভা হয়ে, আলোকছটায় গ্যালাক্সি কাঁপিয়ে তোলে। আর কেউ… সমস্ত আলো গিলে নেয় নিজের ভেতর- একটি কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole) হয়ে নিঃশব্দে তলিয়ে যায় মহাকালের অন্ধকারে। মৃত নক্ষত্ররা মৃত নয় পুরোপুরি। তাদের ধ্বংসই হয় নতুন কিছুর জন্মের পটভূমি। নক্ষত্রের মৃত্যু মহাজাগতিক জন্মের আতুরঘর - কবির আবেগ বুকে ধারণ করে বললে - নক্ষত্ররা মরে যায়, যাতে আমরা জন্মাতে পারি। আমরা সবাই- এক একটি মৃত নক্ষত্রের সন্তান। “হাওয়ার রাত” কবিতায় - এ জীবনানন্দ লেখেন:


‘যে-নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম’রে গিয়েছে
তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে ক’রে এনেছে;’

নক্ষত্ররা ফিরে আসে। অন্যরূপে, অন্য সৃষ্টি হয়ে। সুপারনোভার বিস্ফোরণের ফলে নতুন মৌল (elements) সৃষ্টি হয়, যেমন - সোনা, রুপা, ইউরেনিয়াম। এই রেমন্যান্ট ছড়িয়ে দেয় লোহা, সিলিকন, অক্সিজেন- যা ভবিষ্যতের নক্ষত্র আর গ্রহ তৈরিতে কাজ করে। লোহা গ্রহের কেন্দ্রে থাকে, সিলিকন দিয়ে তৈরি হয় ভূপৃষ্ঠ আর অক্সিজেন তো জীবনের মূল চাবিকাঠি। নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকে জন্ম নেয় নতুন তারা, গ্রহ, এমনকি জীবনও। আমাদের শরীরে থাকা লোহা, ক্যালসিয়াম, সোনা- এসেছে সেই মৃত নক্ষত্রদের ভাঙা হাড়গোড় থেকে। আমাদের পৃথিবী ও শরীরেও যে ভারী মৌল আছে, তার অনেকটাই এসেছে অতীতের কোনো সুপারনোভার মাধ্যমে। সুপারনোভা বিস্ফোরণ ছাড়া পৃথিবীতে কার্বন, অক্সিজেন বা লোহার মতো উপাদান থাকত না। অর্থাৎ, আমরা সবাই আসলে “তারার ধূলি” দিয়ে তৈরি-অর্থাৎ নক্ষত্রের মৃত্যুর ফলে এক মহাজাগতিক জন্মের অংশ।

নক্ষত্ররা সুপারনোভা হয়ে আলো ছড়িয়ে শেষ হয়; কিন্তু তাদের মৃত্যু এক নতুন শুরু… হয়তো কোনো একদিন এই সুপারনোভা গ্যাসের ভেতর থেকে জন্ম নেবে নতুন একটি নক্ষত্র, যেটি তার চারপাশে তৈরি করবে গ্রহ, আর একদিন হয়তো তেমন একটি গ্রহে জীবনানন্দের মতো কেউ মহাকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলবে:

‘পুরোনো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয়
নতুনেরা আসিতেছে ব’লে;’
(নির্জন স্বাক্ষর, জীবনানন্দ দাশ)

নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যুর এই চক্র নক্ষত্রের প্রতি এক মহাজাগতিক হাহাকার দিয়ে ধরতে পেরেছেন জীবনানন্দ, তাই রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দকে আমরা যদি ‘শুদ্ধতম কবি’, ‘নির্জনতার কবি’র এসব নামের সঙ্গে “নক্ষত্রের কবি” বলে একটি নতুন একটি নামে ডাকি- সেটা নিশ্চই ভুল হবে না। কারণ তিনিই তো একই কবিতায় লিখেছেন:
‘যে-নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত
লাগিতেছে আমার শরীরে-’

মহাজাগতিক শীত জীবনানন্দকে আর্ত করে- কেবল তীব্রভাবে নক্ষত্রকে ভালোবেসে নক্ষত্রের কবি হলেই তা সম্ভব।

দীপংকর দীপন: চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ