দুর্ভোগে সিলেট বিভাগের পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা
অফিসের ভেতরে তীব্র জনবল সংকট আর বাইরে দালালচক্রের দৌরাত্ম্য। ভেতরে-বাইরের এসব নানা সমস্যায় জর্জরিত সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস।
সিলেট নগরীর আলমপুরের অফিসটিতে পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ মানুষের অভিযোগ, দালালচক্র এক সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে তদবির করলেও এখন চলছে বিএনপি নেতাদের নাম ভাঙিয়ে। ভোগান্তি রয়ে গেছে আগের মতোই, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতোসব হয়রানি-দুর্ভোগ নিরসনে ভ্রুক্ষেপও নেই কর্তৃপক্ষের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন দালালচক্রের সদস্যরা। আর আশেপাশে রয়েছে বিভিন্ন কম্পিউটার দোকান। পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ মানুষ গাড়ি থেকে নামার পরই তাদের ঘিরে ধরে চক্রের সদস্যরা। তারা জিজ্ঞেস করে কেন এসেছেন। তারপর অফিসে ভোগান্তির ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসেন এসব দোকান পর্যন্ত।
দোকানে আসার পর দালালরা তাদের জানান, অফিসে আবেদন করতে গেলে ফরম পূরণ, পুলিশ ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পর্যন্ত অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। তাদের দিয়ে করালে কোনো ঝামেলা নেই। যদি কোনো কাগজ কম পড়ে, তাহলেও ম্যানেজ করে দিতে পারবেন তারা।
এমন আশ্বাসবাণী শুনে হয়রানি ও ভোগান্তির ভয়ে রাজি হয়ে যান গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল বেশিরভাগ গ্রাহক। এ সুযোগে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা দালালচক্র হাতিয়ে নেয়।
সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, পাসপোর্ট অফিসের বাইরে কিছু ফটোকপির দোকানে ফরম সংগ্রহের সময় থেকেই পিছু নেন দালালরা। ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ফরম পূরণ, পুলিশ ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে পাসপোর্ট হাতে পাইয়ে দেয়ার লোভ দেখান। তবে সময় অনুসারে টাকার পরিমাণ বাড়ান-কমান তারা। যতো কম সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট দিতে বলা হয়, ততো টাকার অঙ্ক বেশি, সময় বেশি হলে টাকা কম।
নগরীর আলমপুরের বাসিন্দা ফয়সল আমীন বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিস থেকে আমাকে বলা হয়েছে, সঠিক কাগজপত্র জমা দিলেই পাসপোর্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আবেদন করার পর এখন দেখি অবস্থা ভিন্ন! সহজে পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া চালু থাকলেও পরে নানা ভোগান্তি দেখে নেতাদের দিয়ে ফোন দেয়াতে হয়, না হয় বাধ্য হয়ে দালাল ধরতে হয়’।
তার অভিযোগ, ‘একসময় আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে কাজ হতো। এখন বিএনপি নেতাদের নামে তদবির করা হচ্ছে এই অফিসে। নগরীর আম্বরখানা, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, সুরমা মার্কেট, তালতলায় বিভিন্ন ট্রাভেলস এজেন্সি, কনসালটেন্সি ফার্মও চুক্তিতে পাসপোর্ট করে দেয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। কোনো বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এমন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। মাঝে-মধ্যে নামমাত্র অভিযান চালানো হলেও কর্তৃপক্ষকে ঠিকই ম্যানেজ করে নেন দালালরা’।
‘মূলত শিক্ষার্থীদের টার্গেট করেই তাদের ব্যবসা। পাসপোর্ট ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দায়িত্বও তারা নিয়ে নেন’- বলেন
নগরীর চৌকিদেখির বাসিন্দা রুমানা বেগম বলেন, ‘ট্রাভেলসের মাধ্যমে টাকা দিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করি। কিন্তু অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছি। একমাস আগে আবেদন করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছি। তারা আমার পাসপোর্টে বিবাহিত লিখে দিয়েছেন। এখন আমার ভোগান্তির শেষ নেই। অনেকবার পাসপোর্ট অফিস গিয়ে পুলিশ রিপোর্ট দিয়ে ফের আবেদন করেছি। এখনো হাতে আসেনি’।
‘এমন হয়রানি থেকে কবে সাধারণ মানুষ মুক্তি পাবে?’- প্রশ্ন এই নারী গ্রাহকের।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুপাটেক গ্রামের সজল বিশ্বাস বলেন, ‘এজেন্সির মাধ্যমে টাকা ও পাসপোর্টের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছি। তারপরও অনেক বাধার মুখে পড়েছি। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও আজও পাসপোর্ট হাতে পেলাম না’।
নগরীর জল্লারপাড়ের সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘ফরম পূরণ করেও ব্যাংক চালান দিয়ে জমা দিতে গেলে ধরে ফেলে দালালরা। তারা সুপার এক্সপ্রেসের (দ্রুতসময়) কথা বলে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। এ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা ৩০ হাজারে নেমে আসেন। এভাবে প্রতিদিন অফিসের আশেপাশে থাকে দালালচক্র। একসময় লাইনে অবস্থান নিলেও এখন একটু দূরে থাকেন দালালরা। যারা দ্রুত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট করতে চান, মূলত তাদেরই টার্গেট করে চক্রটি’।
পাসপোর্ট অফিসটিতে রয়েছে চরম জনবল সংকটও। দিনে গড়ে আসা দুই হাজার সেবাগ্রহীতার জন্য ৫০ জন অপারেটর থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ১২ জন। কর্মকর্তা আটজনের স্থলে আছেন দুজন। ভিসা সেন্টারে সাতজনের স্থলে একজন, ডেলিভারিতে আটজনের স্থলে দুজন, প্রহরী আটজনের স্থলে দুজন, এমএলএসএস আটজনের স্থলে আছেন তিনজন।
বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এখানে আগের মতো ভোগান্তি নেই। এমনিতেই পাসপোর্ট হয়, এ সুযোগে আবেদনকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে একটি চক্র। সেবাগ্রহীতাদের আরও সচেতন হতে হবে। এ চক্রের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। আর অফিসের কেউ চক্রে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার রেজাউল করিম জানান, পুলিশ ভেরিফিকেশনে বিলম্ব করা বা সুবিধা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাগজপত্র ঠিক থাকলে তিনদিনের মধ্যে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট দিতে হয়। তারপরও অীভযোগ পেলে গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মাহবুব মোরাদ বলেন, পাসপোর্ট অফিস ঘিরে দালালচক্র রয়েছে। শুনেছি, একসময় দালালরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু এখন আর আগের পরিস্থিতি নেই। বিভিন্ন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হচ্ছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে’।
‘সরকার ঘরে বসে ফরম পূরণ এবং টাকা জমা দিয়ে পাসপোর্ট করার সুযোগ করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদেরও আরও সচেতন হতে হবে’- বলেন তিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে