সিরিয়া: আসাদের পতনও আনবে না স্থিতিশীলতা, হতে পারে ইসরায়েলি ‘বাফার জোন’!
সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের পতন হয়েছে। দীর্ঘ ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের ঐতিহাসিক মোড় এটি। বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং বিরোধী শক্তির মধ্যে নিয়ন্ত্রণ বদলে দ্রুত পাল্টাচ্ছে দেশটির পরিস্থিতি। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং প্রচুর অপরাধে জড়াচ্ছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। অনেক এলাকায় কারফিউ জারি রয়েছে। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার পরিস্থিতিই বেশি অস্থিতিশীল।
লাখ লাখ সিরিয়াবাসী এখনো সম্পূর্ণ মানবিক সাহায্যে নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত আশ্রয় বা যথাযথ সহায়তা ছাড়াই উন্মুক্ত থাকা মানুষের জীবনে কঠোর এবং অপ্রত্যাশিত শীত উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। বেসামরিক ব্যক্তিরা ক্ষমতার গতিশীলতা এবং অঞ্চল পরিবর্তনের শিকার। তারা জানেন না, পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় নিরাপদ থাকতে পারবেন। বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো আশায় আছে, তারা বাড়িতে ফিরে বন্ধু-পরিবারের সঙ্গে ফের মিলিত হবে; কিন্তু সেক্ষেত্রেও রয়েছে অনেক অনিশ্চয়তা। হাজার হাজার মানুষ ফিরছেনও; কিন্তু তারা জানেন না, কিসের মুখোমুখি হবেন বা তাদের বাড়িগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে কি না।
সব মিলিয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন ১২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ। উল্লেখযোগ্য মানবিক দুর্ভোগে থাকা ১৬ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। সংঘাতে খাদ্যের দাম বেড়েছে, বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে গেছে এবং চিকিৎসা সহায়তা পেতে অসুবিধা হচ্ছে। জরুরি আশ্রয় সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে। কারণ, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চলমান সংঘর্ষে মানুষ বাস্তুচ্যুত হতেই থাকবে। বিদ্যমান আশ্রয়স্থলগুলোও বছরের পর বছর ব্যবহারের পরে মেরামতের প্রয়োজন।
সিরীয় শরণার্থীদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন। প্রতিবেশী লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্ক আশ্রয় দিয়েছে ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষকে। অন্যরা গেছেন প্রতিবেশী ইরাক, মিশর বা উত্তর আফ্রিকায়। কিছু শরণার্থী ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রিত। ২০১৫ সালে ইউরোপজুড়ে অভিবাসী সংকটের মাঝেও ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন সিরিয়ান আশ্রয়ের আবেদন জানিয়েছিলেন জার্মানি, সুইডেন, হাঙ্গেরি, গ্রিস, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স এবং বুলগেরিয়ায়।
উচ্চ বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং সীমিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা চিহ্নিত আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষের জেরে সিরিয়ায় গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভ শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চ মাসে। সহিংস সরকারি দমন-পীড়ন আন্দোলন গড়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদের পদত্যাগের দাবিতে। দ্রুতেই সংঘাতের সূত্রপাত হয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলগুলো গঠিত হয় এবং বিভিন্ন বিদ্রোহী দল এবং বিদেশি শক্তির সঙ্গে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ), কুর্দি বিদ্রোহী যোদ্ধা, ইসলামিক স্টেট, জাভাত ফাতহ আল-শাম, হিজবুল্লাহ, সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) এবং তুরস্ক সমর্থিত ইসলামপন্থি হায়াত তাহরির আল-শামসহ (এইচটিএস) বিভিন্ন দল এ যুদ্ধে যোগ দিলে জটিল আন্তঃগ্রুপ দ্বন্দ্বে রুপ নেয়। এমনকি আইএসআইএস এবং আল-কায়েদাসহ আন্তর্জাতিক চরমপন্থি সংগঠনগুলোও এ গৃহযুদ্ধে জড়ায়, যা আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে বাড়িয়ে তোলে। তবে বহুমুখী সংঘাতের জটিলতায় বেশি অবদান রেখেছিল স্বশাসনের দাবিতে লড়াইরত কুর্দিরা।
আবার আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাও সিরিয়ার সংঘাতকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। আসাদ সরকারের প্রধান সমর্থকদের মধ্যে রাশিয়া ২০১৫ সালে বড় বিমান অভিযান চালিয়েছে। হিজবুল্লাহর সেনা মোতায়েন এবং মিলিশিয়াদের অর্থায়ন করেছে ইরান। প্রাথমিকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো মধ্যপন্থি বিদ্রোহীদের সমর্থন করলেও পরে জিহাদি গোষ্ঠীগুলো বেড়ে যাওয়ায় অ-প্রাণঘাতী সাহায্যে মনোনিবেশ করেছিল দেশগুলো। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট আইএসআইএসের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালায় এবং সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) সমর্থন করে। একসময়কার সশস্ত্র বিদ্রোহী কুর্দি মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় বিরোধী দলগুলোকে সমর্থন করেছে তুরস্ক। এখন আরব লীগে সিরিয়ার পুনঃএকত্রীকরণ নিয়ে আলোচনা করছে সৌদি আরব। সর্বশেষ সিরিয়ায় ইরানের সামরিক তৎপরতার বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
সিরিয়ায় আসাদ-পরবর্তী ভবিষ্যতের চিত্রনায়ক হিসেবে নিজেকে অনেকটাই এগিয়ে রাখছেন ইসলামপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতা হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো এবং পরে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবের শক্ত ঘাঁটি থেকে পরিচালিত তার গ্রুপের চূড়ান্ত হামলায় ‘বিপ্লবের রাজধানী’ খ্যাত হামা এবং হোমসে শহরে আকস্মিক, ধ্বংসাত্মক অগ্রগতি না হলে বিগত দেড় সপ্তাহের উত্তাল ঘটনার পরিণতি ঘটতো না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আল-জোলানি এখন তার সংগঠন এইচটিএসের ভাবমূর্তিকে ‘আল-কায়েদা যুক্ত ভয়ংকর গোষ্ঠী’ থেকে আসাদ সরকারের বাস্তববাদী বিকল্প হিসেবে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এইচটিএস ২০১১ সালে জাভাত আল-নুসরা নামে উদ্ভূত হয়েছিল এবং প্রতিষ্ঠাতা আবু বকর আল-বাগদাদির কার্যক্রম এর গঠনের সঙ্গে আল-কায়েদার মিল ছিল। এইচটিএস এখন আল-কায়েদা থেকে সম্পূর্ণ বিরতি নিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির প্রচার এবং সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে অতীত থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালালেও এ নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে। কেননা, দলটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মুখোমুখি এবং অন্য গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।
তারপরও সিরিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এইচটিএসের উদ্দেশ্য, প্রতিযোগী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড এবং আসাদের অব্যাহত শাসন নির্বিশেষে বহিরাগত শক্তির প্রভাবেরে ওপরেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এইচটিএসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছে, অথচ এটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ রয়েছে দেশটিতে। তুরস্ক আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় বর্তমান ক্ষমতার গতিশীলতা থেকে উপকৃত হয়েছে এবং দেশটি এইচটিএসের কর্মকাণ্ডের সমর্থক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইইউ এবং আরব দেশগুলোর যৌথ বিবৃতিও এই সংকটময় সময়ে সিরিয়ার জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। কুর্দি ইস্যুতে চলমান মার্কিন-তুরস্ক মতবিরোধ এবং তুর্কি-আরব প্রতিযোগিতা কূটনৈতিক সম্পর্ককে জটিল করে তুলতে পারে। আফগানিস্তানে তালেবানের নজির পুনরাবৃত্তির বিষয়ে উদ্বেগের কারণে তাই পুনর্গঠন পর্যায়ে এইচটিএসের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
এখন যেহেতু আসাদ চলে গেছেন, চাপের প্রশ্ন হলো, এই ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীগুলো একক নেতৃত্বে একত্রিত হতে পারে কি না। ঐতিহাসিক এবং আদর্শগত পার্থক্য এই সম্ভাবনাকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। ইসরায়েল বলে আসছে, সিরিয়ার সঙ্গে সংঘাতে তার কোনো আগ্রহ নেই। তবুও প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা ও অস্ত্র স্থাপনায় শত শত বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই হামলার লক্ষ্য ইসরায়েলি নিরাপত্তা, বিশেষ করে ইরান এবং হিজবুল্লাহ থেকে হুমকি দূর করা। তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে টারটাস এবং রাজধানী দামেস্কের নানা সাইট, যেগুলো নৌ-ঘাঁটি এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতো সামরিক উদ্দেশ্যে কাজ করে৷
আবার ইসরায়েল গোলান হাইটসে জাতিসংঘের টহলযুক্ত বাফার জোনে ঢুকে ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এবং এই অঞ্চলে বসতি বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত কৌশল সম্পর্কে অনিশ্চয়তার মাঝে সিরিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে যাওয়া ইসরায়েলের ইরানি লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত করার ক্ষমতা বাড়াতে পারে। ইসরায়েল তাই নিজের সীমান্তের কাছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সংগঠিত হতে বাধা দিতে গোলান মালভূমির কাছে দক্ষিণ সিরিয়ায় ‘জীবাণুমুক্ত প্রতিরক্ষা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করছে। এই বাফার জোনের লক্ষ্য স্থায়ী ইসরায়েলি উপস্থিতি ছাড়াই নিরাপত্তা বাধা তৈরি করা, যা অস্থায়ী ব্যবস্থার বদলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্দেশ করে। উপরন্তু ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব মোকাবিলা করছে ইরানের সামরিক সাইট এবং প্রক্সিকে লক্ষ্য করে বিমান হামলার মাধ্যমে। এভাবেই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে বৃহত্তর ইসরায়েল গড়ার বৃহত্তর লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বাশার আল-আসাদকে সমর্থন করেছে ইরান। তার শাসন বজায় রাখতে যোদ্ধা, অস্ত্র এবং সামরিক পরামর্শ সরবরাহ ছাড়াও ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ সমুন্নত রেখেছে তেহরান। আসাদের পতনের আগেই এইচটিএসের নেতৃত্বে সিরিয়ার বিরোধী দলগুলোকে গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের পর এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে ‘আমেরিকান-জায়নবাদী চক্রান্ত’-এর হোতা হিসাবে চিহ্নিত করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। পাল্টা প্রতিশোধ নিতে দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা চালিয়ে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। আসাদের সম্ভাব্য পতন ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্বও করেছিল ইরানের প্রভাব এবং কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। বিশেষ করে দেশটির সমর্থন হিজবুল্লাহকে সিরিয়ান সরকারের সমর্থন ছাড়াই এইচটিএসকে অপারেশনাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে দেয়।
সুন্নি বিদ্রোহী এবং সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো যখন সিরিয়ার ক্ষমতার শূন্যতাকে কাজে লাগাচ্ছিল, তখন ইসরায়েল আসাদের সম্ভাব্য পতনকে নিজেদের সুবিধাজনক হিসাবে দেখে, যা সম্ভবত ইরানের বিরুদ্ধে দেশটির সরাসরি পদক্ষেপের পথ প্রশস্ত করে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি সে সময় দাবি করেন যে, সিরিয়া তার যুবকদের হাতেই ‘মুক্ত’ হবে। এটি সিরিয়ার রাজনৈতিক ও সামরিক দৃশ্যপটে ইরান এবং সম্ভবত রাশিয়ার ফের জড়িত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এই ঘোষণা পরিস্থিতিকে আর জটিল করে তুলেছিল। বিশেষ করে তুরস্ক সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ) এবং হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) সমর্থন করে, যা মার্কিন সমর্থিত কুর্দি বাহিনীর (এসডিএফ) সঙ্গে দেশটিকে বিরোধে জড়িয়ে ফেলে।
গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখনও পর্যন্ত সিরিয়ায় আসাদের সমর্থক রাশিয়া। ২০১৫ সালে আসাদের অনুরোধে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল দেশটি। সিরিয়ার বিরোধী দল এবং ইসলামিক স্টেট উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপসহ সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি বিমান হামলাও চালিয়েছিল। ২০১৭ সালের মধ্যেই তার সমর্থনকে দৃঢ় করতে স্থায়ীভাবে সৈন্য মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। তবে বিদ্রোহীরা যখন পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, তখন আসাদের সমর্থনে সামরিক শক্তি ব্যবহার থেকে বিরত থাকে রাশিয়া, পরিবর্তে তাকে এবং তার পরিবারকে আশ্রয় দেয়। এই পরিবর্তনগুলো সত্ত্বেও সিরিয়ার বিষয়ে আগ্রহী মস্কো। নতুন সিরিয়ান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশলও নিয়েছে।
ক্রেমলিন সিরিয়ায় তার দুটি প্রধান সামরিক ঘাঁটিকে গুরুত্ব দেয়- টারতুস নৌ-ঘাঁটি এবং খমেইমিম বিমান ঘাঁটি। এই ঘাঁটিগুলো প্রত্যাহারে বাধ্য করা হলে এটি মধ্যপ্রাচ্যে পুতিনের জন্য কৌশলগত পরাজয়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এমনও জল্পনা রয়েছে যে, রাশিয়া ইউক্রেনে মার্কিন বিরোধিতা কমানোর বিনিময়ে আসাদের প্রতি সমর্থন বন্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যার লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে সংঘাতের অবসান ঘটানো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়, যা দেশটির সিরিয়ার অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে স্পষ্ট। আসাদকে সমর্থনে রাশিয়ার নিষ্ক্রিয়তা এই বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক বিনিময়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। কেবল সময়ই এই তত্ত্বের যথার্থতা প্রকাশ করবে।
সিরিয়ার সংঘাত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকাকেও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করেছে। গত এক দশকে তুরস্ক যখন সংঘাতের গতিপথকে প্রভাবিত করেছে, তখন তার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্ককে পুনর্নির্মাণ করেছে দেশটি। সিরিয়ায় চলমান জাতিগত, সাম্প্রদায়িক এবং মতাদর্শগত বিভাজনগুলো তুরস্কের সঙ্গে সমান্তরাল এবং প্রায় ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন সিরীয় শরণার্থীর উপস্থিতি দূর-ডান এবং জেনোফোবিক দলগুলোর উত্থানকে উৎসাহিত করেছে, যা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চালচিত্র পরিবর্তন করেছে। তুরস্ক ধারাবাহিকভাবে সিরিয়াবিরোধীদের শক্তিশালী মিত্র হয়েছে। আসাদের সম্ভাব্য পতনকে তার সরকারের নীতির প্রমাণ হিসেবেও দেখেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। আগে, তুরস্কের সিরিয়া নীতি চারটি মূল উদ্দেশ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল, শরণার্থীদের প্রবাহ পরিচালনা, সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত, কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসকে (এসডিএফ) মোকাবিলা এবং বিরোধীদের জন্য আসাদ সরকারের কাছ থেকে ছাড় নিয়ে আলোচনা করা। আসাদের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ায় শেষ লক্ষ্যটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও তুরস্কের লক্ষ্য হল, দামেস্কের নতুন নেতাদের সঙ্গে তার প্রভাব বিস্তার এবং তার অবশিষ্ট উদ্দেশ্যগুলো অনুসরণকালে সামরিক চাপ বজায় রাখা।
সিরিয়ায় আল-আসাদ সরকারের পতনকে রাশিয়া ও ইরানের জন্য ধাক্কা হিসেবে দেখে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপের দেশগুলো আশা করছে, এই পরিবর্তন সিরিয়ার শরণার্থীদের দেশে ফিরে যেতে উৎসাহিত করবে। উচ্চ-পর্যায়ের আলোচনায় তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সিরিয়াকে স্থিতিশীল করা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন, দায়েশ/আইএসআইএস এবং পিকেকে-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতো অগ্রাধিকারে জোর দিয়েছেন। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি সমাধান খোঁজার বদলে সংঘাত বাড়ানোর ব্যবস্থাপনাকে ঘিরে বলেই মনে হচ্ছে। এই কৌশলটি ইউক্রেনকে সাইডলাইন করা এবং দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রগুলোকে তাদের প্রভাব বিস্তারের অনুমতি দেয়ার বিষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বাসার পতনের নায়ক আল-জোলানিকে একসময় সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখন নেতৃত্বের অবস্থানে এসে তার সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে দেশটির চিন্তা-চেতনা কোথায় দাঁড়াবে, সেটির বিষয়ে মানুষের বোঝাপড়াকে জটিল করে তোলে এবং চরমপন্থিদের মোকাবেলায় শক্তিশালী দেশগুলো নিযুক্ত দ্বৈত মানকে প্রকাশ করে। এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে যে কীভাবে ছোট দেশগুলো প্রায়শই ভূ-রাজনৈতিক দাবা খেলায় ‘বড়’ হয়ে ওঠে, বৃহত্তর কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর পক্ষে তাদের স্বার্থও প্রান্তিক হয়। এই চালচিত্রে আমেরিকা যে সন্ত্রাসবাদকে আগে নিন্দা করেছিল, রাজনৈতিক কূটকৌশলের জন্য সেটিই গোপন হাতিয়ার হিসেবে পুনরুত্থিত হতে দেখা যাচ্ছে, যা এই জাতীয় কৌশলগুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সব মিলিয়ে সিরিয়ায় উত্তেজনা বাড়ছে এবং আসাদ-পরবর্তী সময়ে স্থিতিশীলতা অর্জনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকার এবং জনগণ দেশটিকে পতনের হাত থেকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারে কি-না, তা আগামী কয়েক বছর ধরে বোঝা যাবে। বাহ্যিক সাহায্য এবং অভ্যন্তরীণ শক্তির ভারসাম্য খোঁজার মধ্যে মূল বিষয়টি নিহিত। সিরিয়ার ভবিষ্যত নির্ভর করে তার জনগণের একসঙ্গে দাঁড়ানো এবং তাদের জাতিকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতার ওপরে। বিশ্ব মনোযোগ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, সিরিয়ার সার্বভৌমত্বকে সমর্থন, শান্তি আলোচনায় সাহায্য এবং নাগরিকদের জরুরি মানবিক চাহিদা পূরণ। সিরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা বা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পদক্ষেপগুলো কেবল সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতার চক্রকেই দীর্ঘায়িত করবে।
ইসরায়েল সম্ভবত ইরানের সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই যুদ্ধ এই অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব ও শক্তিকে দুর্বল এবং সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে দেশটির ভূমিকাকে শেষ করে দিতে পারে। আগামী ১৯ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসের নেতৃত্বে পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এখনকার নীতি অব্যাহত রাখে, তবে এটি রাশিয়াকে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। বাশার আল-আসাদের পতন এবং এর ফলে এই অঞ্চলের ক্ষমতার গতিশীলতার পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতেই পারে। তবে এর সম্পূর্ণ প্রভাব বুঝতেও কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।
সাইমন মোহসিন: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে