আয় কম, ব্যয় বেশি
স্বল্প আয়ের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিন
দুই বছর ধরে এ দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন আয়ের মানুষ কীভাবে টিকে আছেন, তারাই জানেন। সাম্প্রতিক জরিপে এমনো খবর এসেছে, মধ্যবিত্তের একটা অংশ আসলে এখন নামমাত্রই আছে, জীবনযাপনে তাদের অবস্থা চলে গেছে নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাতারে। আর নিম্ন আয়ের মানুষের কথা না বলাই ভালো, স্রেফ ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছেন তারা।
মঙ্গলবার (২১ মে) সংবাদপত্রে প্রকাশিত সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে জানা যায়, টানা ২৪ মাস, অর্থাৎ দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার কম। এর মানে, প্রতি মাসে যতটা মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, মজুরি বাড়ছে তার চেয়ে কম হারে। বিপুলসংখ্যক মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের গতি বেশি। ফলে ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই কমছে। তাই খরচের গতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দরিদ্র ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, টানা ১৪ মাস ধরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়ায়। এরপর তা আর কখনোই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। সর্বশেষ গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১৪ মাস ধরে আপনি যত পণ্য ও সেবা কিনছেন, তার জন্য আপনাকে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে গড়ে ৯ শতাংশ বেশি দাম দিতে হচ্ছে। যেমন গত বছরের এপ্রিল মাসে আপনি পণ্য কিনতে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন, এ বছর এপ্রিল মাসে একই পণ্য কিনতে ১০৯ টাকা ৭৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
কোভিড মহামারির পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। পাশাপাশি সংকটের কারণে দেশে ডলারের দাম বাড়ে এবং এর প্রভাবে পণ্যের দাম আরও বেড়ে মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে জাতীয় মজুরির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর এই হিসাব করে থাকে বিবিএস। মজুরিনির্ভর এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপরই মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে। বিবিএসের হিসাবে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির মতো।
পরিসংখ্যানের প্রতিফলন বাস্তবজীবনেও দেখা যাচ্ছে। বাজারে এমন কোনো সবজি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় তরকারি নেই, যার দাম সত্তর-আশি টাকা কেজির নিচে। মাছ-মাংস প্রায় নাগালের বাইরে, ডাল-ভাত নিশ্চিত করাও বেশ কঠিন নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে। এগুলো না হয় গেল খাওয়া-খাদ্যের কথা, অন্যান্য প্রয়োজনের কথা বলতে গেলে নাভিশ্বাস উঠবে।
খাদ্যপণ্যের বাইরে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য যেমন সাবান, টুথপেস্ট, কিংবা শিক্ষা উপকরণ সবকিছুর দামেই ঊর্ধ্বগতি। ফলে মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের পক্ষেই সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ বহন করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। এখন আর ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে প্রয়োজনীয় খরচ জোগাতে পারছেন না।
অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যারা এক সময় ফ্ল্যাট বাসায় থাকতেন, তারা বাধ্য হচ্ছেন টিনশেড বাসায় থাকতে। জীবনের সাধারণ কিছু সৌখিনতা যেমন রেস্টুরেন্টে খাওয়া কিংবা মাঝে মধ্যে ভ্রমণ-বেড়ানোর ব্যাপারটাও আর নেই অনেকের। স্বল্প আয়ের মানুষের এখন একমাত্র লড়াই ঊর্ধ্বগতির বাজারে কোনোরকমে টিকে থাকা।
এখন কথা হচ্ছে, বাজার সিন্ডিকেট নানা যুক্তি দেখিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম বাড়াচ্ছে; কিন্তু নির্দিষ্ট আয়নির্ভর মানুষের আয় তো বাড়ছে না, তাদের জন্য করণীয় কী? এবং এই শ্রেণিপেশার মানুষই দেশে বিপুল, যাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ে। আয় যখন বাড়ে না, তখন তারা জীবনযাপনের কম প্রয়োজনীয় অংশ থেকে ছাঁটতে শুরু করেন, ছাঁটতে ছাঁটতে অনেক সময় অপরিহার্য প্রয়োজনও বাদ দিতে হয়, তখন তারা বেঁচে থাকেন নামমাত্র।
নানা জরিপেই বাংলাদেশের নানা দুরাবস্থার খবর আমাদের গোচরে আসে; কিন্তু সেগুলো থেকে উত্তরণের দৃশ্যমান সরকারি পদক্ষেপ তেমন একটা চোখে পড়ছে না; কিন্তু এই ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে যদি নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে সহসা মুক্তি দেয়া না যায়, তাহলে তার বিপদ শিগগিরই নানা দিক থেকে আসবে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উৎপাদন, আইনশৃঙ্খলা ব্যহতসহ সব দিকেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে খেটে খাওয়া, নির্দিষ্ট নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়ানো এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে