বনখেকোদের দৌরাত্ম্য বন্ধে ব্যবস্থা নিন
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বৃক্ষবন্দনা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান/প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ- আদিপ্রাণ।’ অথচ বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যের মতো দেশের ৫৩টি রক্ষিত বনের ২৮টির উপগ্রহ চিত্র নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুই দশকে প্রতিটি বনে গাছ কমেছে। যদিও বন রক্ষা করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও গাছ কাটা বন্ধ হয়নি।
এভাবে নির্বিচারে বন ধ্বংসের কারণে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ, তেমনিই বনের নানান প্রাণী বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। গবেষণায় দেখা গেছে, শাল, পাহাড়ি ও ম্যানগ্রোভ- তিন ধরনের রক্ষিত বনের ভূমির অবস্থা পর্যবেক্ষণে গুগলের তোলা বিভিন্ন সময়ের ছবি ব্যবহার করা হয়। ছবিগুলো পাওয়া গেছে ল্যান্ডসেট উপগ্রহ থেকে। বনের পরিবর্তন দেখতে কন্টিনিউয়াস চেঞ্জ ডিটেকশন অ্যান্ড ক্ল্যাসিফিকেশন (সিসিডিসি) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
গবেষণার আওতায় আসা সব কটি বনেই গাছ কমেছে। তাছাড়া দেশের ২৮টি বনে ১৪ হাজার ৭৬৭ হেক্টর জমির গাছপালা উজাড় হয়েছে। দেশের পার্বত্য অঞ্চলে মূলত চার শ্রেণির বন রয়েছে: সংরক্ষিত, রক্ষিত, ব্যক্তিমালিকানাধীন ও অশ্রেণিভুক্ত। এর মধ্যে অধিকাংশ সংরক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বন নির্বিচারে উজাড়ের হিড়িক পড়েছে। বন বিভাগের বিশেষ নজরদারিতেও থামছে না বনখেকোদের দৌরাত্ম্য।
কোথাও কোথাও তো পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, গত সাত বছরে বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। আর বনভূমি উজাড় হওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল।
সাধারণত পাহাড় থেকে গাছ কেটে নেয়া হয় ইটভাটা, তামাক চুল্লি, করাতকলসহ বিভিন্ন জায়গায়। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামে গাছ কাটতে হলে সরকারিভাবে অনুমোদন নিতে হয়; কিন্তু নজরদারি ও তদারকির অভাবে বিনা অনুমতিতে বনের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনখেকোরা। সম্প্রতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ওপর বন বিভাগ বিশেষ নজরদারি বাড়ালেও একেবারেই অরক্ষিত অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চল। এসব বনাঞ্চল নিয়ে এখনো কোনো জরিপ হয়নি। এসব পাহাড়ের খাসজমিতে প্রাকৃতিকভাবে যে বনাঞ্চল গড়ে ওঠে, তা অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলের আওতাভুক্ত।
এ ছাড়া জেলার আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক করাতকল, যার অর্ধেকেরই বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। এসব অবৈধ করাতকলের মালিকানায় রয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক দলের প্রভাবশালী নেতারা। বন ও পরিবেশ আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপনের কোনো নিয়ম না থাকলেও এসবের তোয়াক্কা করে না বনখেকোরা। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘিরেই অবৈধভাবে করাতকল স্থাপন করে দিনে-রাতে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের কাঠ।
বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে পাহাড়ের আয়তন প্রায় ১৩ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে বন অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৬ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর পাহাড়ি বন। তবে নির্দয়ভাবে পাহাড় ও গাছ কাটার কারণে এখন পাহাড়ের আয়তন কতটুকু আছে, তার হিসাব সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেই নেই।
জানা গেছে, প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত একটি চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে স্থানীয় ক্ষমতাসীন ও ব্যবসায়ীরা এখানে পাহাড় ও বন উজাড়ের মহোৎসব চালিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হলে লোক দেখানো কিছু উদ্যোগ ও তৎপরতা দেখা যায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। তারপর আবার যা তা-ই হয়ে যায়। তাই পার্বত্য অঞ্চলের বনের গাছ ও পাহাড় কাটা রোধ করতে হলে এসব কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
গাছের কাছে আমরা ঋণী। আমরা সেই ঋণ শোধ করছি অসভ্য বর্বর যাযাবর মানুষের মতো। আমাদের শিক্ষা আছে, দীক্ষা আছে, জ্ঞান আছে, আছে গর্ব করার মতো অনেক কিছু। আমরা ভালো করেই বুঝি আমাদের ভালো-মন্দ। শুধু ব্যক্তিগত বা মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থের কারণে গাছ কেটে আমাদের ভাগ্যে নেমে আসুক চরম বিপর্যয়, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত চাওয়াটা কারও কাম্য হতে পারে না।
তাই আমরা বলতে চাই, বনের কোনো গাছ কাটা আর যেন না হয়। সেইসঙ্গে যেসব গাছ কাটা হয়েছে, তারও কয়েক গুণ বেশি গাছ কর্তৃপক্ষকে সেখানে লাগাতে হবে। তাই অবিলম্বে বনের প্রকৃতি রক্ষায় সরকারকে টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে