পরিবেশ দূষণ বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা নিন
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানুষ গড়ে তুলেছে তার চারপাশের পরিবেশ। পরিবেশের আনুকূল্যে মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ একে অপরের নির্ভরশীলতায় বিকাশ লাভ করে। অথচ সেই পরিবেশ এখন বিপন্নের পথে। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাংকের জলবায়ুবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
এ ধরনের খবর আমাদের জন্য নতুন নয়। তবে খবরটি দেশের জন্য সুখকরও নয়। দেশে পরিবেশ দূষণের মাত্রা প্রতি বছর ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। বিশেষ করে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ ও শব্দদূষণের ফলে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ফলে স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা তৈরি করছে। ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।
গবেষণা বলছে, গত ৬০ বছরে বিশ্বে ৮০টির বেশি প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কয়েকশ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়। এসব সমস্যার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অতি মাত্রায় প্লাস্টিকের ব্যবহার, ইটভাটার দৌরাত্ম্য, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতিকে মূলত দায়ী করা হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মাত্রা থেকে বাংলাদেশের শহরগুলোতে বায়ুদূষণ ১৫ গুণ বেশি। দেশে মোট মৃত্যুর ২০ শতাংশ ঘটেছে বায়ুদূষণের কারণে। বায়ুদূষণের কারণে গত ২০ বছরে মৃত্যু ৯ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকা শহরের নাগরিকরা ৮ বছরেরও বেশি প্রত্যাশিত আয়ু হারায় দূষণের কারণে। অন্যদিকে প্রতি বছর মানুষের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। পলিথিন-প্লাস্টিকের কারণে দেশের নদীগুলো মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বায়ু ও প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় নীতি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রয়োজন।
শক্তিশালী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হলে আগামী বছরগুলোতে বায়ুদূষণ আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ যানবাহন। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকায় মোটরযানের নিবন্ধন বেড়েছে ২৮৩ শতাংশ। বায়ুদূষণ ডায়াবেটিস, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, ফুসফুসের রোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং দীর্ঘস্থায়ী হৃদরোগের জন্য দায়ী।
এ অবস্থা নিরসনে সমন্বিত বহুমাত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। রাজধানীতে প্রতি বছর ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ সমতলে ফেলা হয়। ৩৭ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। ১২ শতাংশের গন্তব্য নদীতে। অন্যান্য স্থানে পড়ে থাকে বাকি ৩ শতাংশ। দেশের বায়ুর মান কখনোই স্বাস্থ্যসম্মত থাকে না।
জুলাই-আগস্ট মাসে কিছুদিনের জন্য বাতাসের মান থাকে চলনসই। তা ছাড়া বছরের বাকি সময়ে কখনো অস্বাস্থ্যকর, কখনো খুবই অস্বাস্থ্যকর থাকে। বায়ুদূষণের কারণে দেশবাসীর যে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, তার জন্য প্রত্যেককে প্রতি বছর ৮ হাজার ৩৩৪ টাকা খরচ করতে হয়। আর মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬৫২ কোটি মার্কিন ডলার, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পথে। এর ফলে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়বে। সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটা চ্যালেঞ্জ হলেও মোকাবিলা করা অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে ২০৩০ সাল নাগাদ জনপ্রতি প্লাস্টিকের ব্যবহার দাঁড়াবে ৪০ কেজি। তাহলে অবস্থা কোন পর্যায়ে দাঁড়াবে? তাই এখনই প্রয়োজন গ্রাম থেকে শহর- সর্বত্র বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ছড়িয়ে দেয়া।
প্রকৃত অর্থে পরিবেশ দূষণের হাতে থেকে দেশকে মুক্ত করতে চাইলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই যেসব কারণে দেশের পরিবেশ দূষণ হয়ে থাকে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিচার বিশ্লেষণ করে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে