Views Bangladesh Logo

ধর্ষিতার আর্তনাদ যেন নিভৃতে কাঁদে

দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে ধর্ষণের ঘটনা। এর মধ্যে মাগুরায় ঘটেছে ৮ বছরের এক শিশু ধর্ষণের লোমহর্ষক ঘটনা। আর একের পর এক এসব ধর্ষণের কারণে উত্তাল সারা দেশ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসেই দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন, যার মধ্যে ৪৪ জন শিশু।

মাগুরায় ধর্ষণের ঘটনা ছাড়াও সম্প্রতি দেশে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নানারবাড়ি বেড়াতে এসে দ্বিতীয় শ্রেণির মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া পটুয়াখালীর বাউফলে এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে শিক্ষাসফরের চারটি স্কুলবাসে ডাকাতির পাশাপাশি তিনজন ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ রয়েছে। শেরপুরের নকলায় এক কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় থানা ঘেরাও ও নকলা-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ হয়েছে। ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ‘ইউনিক রোড রয়েলস’ নামের চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় মহান শহীদ দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে ফুল সংগ্রহ করতে যাওয়া এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আইন উপদেষ্ট আসিফ নজরুল গত ১২ মার্চ বুধবার বলেছেন, ‘ধর্ষণ মামলা তদন্ত প্রতিবেদন ১৫ দিন ও বিচার ৯০ দিনের মধ্যে করতে আইন সংশোধন করা হবে।’ তবে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এক লাখ ৫৩ হাজার ৬৩২টি ধর্ষণের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন বর্তমান আইন অনুযায়ী নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যে শেষ হয়নি।

এ ছাড়া ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৩ হাজার ১০৩টি মামলা রুজু হয়ে বিচারাধীন আছে। এছাড়া বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ধর্ষণ মামলা হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে- ৯৮ শতাংশ ধর্ষণ মামলা বিচার শেষে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে- প্রতারণা ও ছলচাতুরির মামলা নিষ্পত্তির হারও ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তির হারের থেকে বেশি। আদালত সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ ধর্ষণ মামলা যথাযথ তথ্য-প্রমাণ না থাকায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত দেশে একটি ধর্ষণ মামলাও নির্ধারিত ১৮০ দিন সময়ের মধ্যে বিচার শেষ হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ৩০ দিনের বাধ্যবাধকতা আটকে আছে আইনের বইতেই। ধর্ষণের মামলায় ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে শুধু তদন্ত প্রতিবেদন দিতেই।

দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করে, তাহলে সে উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে এবং এজন্য সে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে ২০২০ সালে আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ ধারার ৪ উপ-ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা বলৎকার চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হয়, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হয় ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। আর মামলার শেষ পরিণতি- মিথ্যা মামলা হিসেবে খারিজ।

বর্তমানে ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে ৯টি। এসব ট্রাইব্যুনালে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪২টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এসব ট্রাইব্যুনালের ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ১৭টি মামলা বিচার শেষ হয়েছে। যাতে আবার মাত্র ৬টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। বাকিগুলোতে বেকসুর খালাস পেয়েছেন আসামিরা। জানা গেছে, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে করা একটি মামলাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

এদিকে, চট্টগ্রামে একটি আদালত গত ৬ ফেব্রুয়ারি চাঞ্চল্যকর একটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার সব আসামিকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছে। চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক জয়নাল আবেদিন চার্জশিটভুক্ত ৫ আসামিকে খালাস ও মামলা ক্লোজ করার আদেশ দেন। খালাসপ্রাপ্ত আসামিরা হচ্ছেন নুরুল আজিম প্রকাশ দুলু মিয়া, মোহাম্মদ খোরশেদ, রাশেদুল আলম রাজু, মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন ও রুবেল। মামলার এজাহার ও চার্জশিট থেকে জানা গেছে, জেসমিন আক্তার নামে এক গৃহবধূ পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের নালান্দা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তাকে ধরে আসামিরা একটি খালের পাড়ে বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাতে এবং ২০ ডিসেম্বর ভোরে দুই দফায় চার ধর্ষক তাকে ধর্ষণ করে মুমূর্ষু অবস্থায় রেখে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন পরে তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় তিনি পটিয়া থানায় মামলা করলে পুলিশ এজাহারভুক্ত চারজন ও তদন্তে প্রাপ্ত একজনসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আদালত এ মামলায় চার্জও গঠন করেন। সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথম দিনে গত ৬ ফেব্রুয়ারি বশিরুল আলম নামে একজন সাক্ষ্য প্রদান করেন। সাক্ষ্য গ্রহণের প্রথম দিনেই আদালত আসামিদের খালাস দেন। এছাড়া ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার রাজধানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেন।

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচারিক আদালতে ধর্ষণের যেসব মামলা আসে তার বেশিরভাগই প্রেমঘটিত বা পরস্পর সম্মতিক্রমে শারীরিক সম্পর্কের। বিয়ে করতে না চাইলে এসব মামলা দেয়া হয়। পরে আসামি ও বাদীর বিয়ে হয়ে গেলে বা অন্য কোনোভাবে বিষয়টি মীমাংসা হলে মামলাটি মিথ্যা হিসেবে গণ্য করে খারিজ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এক পরিবারের সঙ্গে আরেক পরিবারের কলহের কারণে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে ধর্ষণের মামলা হয়। সেগুলোতে পরে বাদী প্রমাণ করতে পারে না। ফল হিসেবে মামলা খারিজ হয়। তবে যেগুলো সত্যিই ধর্ষণ হয়, সেসব মামলাতেও পরে আসামিদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে আপস করে ফেলা হয়। যারা সত্যিকারের বিচার চান, সেসব মামলাতে বড় সমস্যা ডাক্তারি রিপোর্ট, যা বিভিন্ন কারণে বা প্রভাবের ফলে ভুক্তভোগীদের পক্ষে আসে না। এছাড়া সত্যিকারের ধর্ষণ মামলায় সাক্ষীদের অনুপস্থিতি, বাদীকে ভয়ভীতি দেখিলে আদালতে আসতে না দেয়া এবং তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তকে আইনের মারপ্যাঁচে অনেকটা দায়মুক্তি দেয়ার কারণে ধর্ষণ মামলার সঠিক ও ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়।’

মানবাধিকার নেত্রী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হলে বা বনিবনা না হলে, প্রেমিকের সঙ্গে কোনো মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করলে বা প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে বিরোধ তৈরি হলে তারা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ মামলা করেন। পরে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে বিরোধ মিটমাট হয়ে গেলে কিংবা সামাজিকভাবে ট্রাইব্যুনালের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে গেলে ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য প্রদান করতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে করে ট্রাইব্যুনালে পাহাড়সম মামলার জট বাঁধতে থাকে। আর এ ধরনের মামলা বেশি হওয়ার কারণে সত্যিকারের ধর্ষণ মামলার বিচার বিলম্ব হয়। অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা ধর্ষণ মামলার সঙ্গে অনেকেই সত্যিকারের ধর্ষণ মামলা মিলিয়ে ফেলেন। অনেক আইনজীবীও তার মোয়াক্কেলকে বাঁচাতে এমন কাজ করেন। এতে করে অনেক সময়ই ধর্ষণের সঠিক বিচার হয় না।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একজন গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দেশব্যাপী শুরু হয় আন্দোলন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান আইন সংশোধন করা হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তাতেও কাজ হচ্ছে না। তাই আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিচার প্রক্রিয়াও হতে হবে আরও দ্রুত। ভুক্তভোগী, পুলিশ, ডাক্তার, আইনজীবী ও বিচারককে হতে হবে আরও বেশি সচেতন। রাষ্ট্রপক্ষকেও হতে হবে আরও আন্তরিক। এটা হলেই কেবল ধর্ষণ মামলার সঠিক ও দ্রুত বিচার সম্ভব হবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ