‘অপহরণ আতঙ্কে’ টেকনাফ, যেখানে মুক্তিপণই মুক্তির একমাত্র উপায়
প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি কক্সবাজার। তবে সীমান্তের শেষ উপজেলা টেকনাফের পাহাড়ি এলাকা যেন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। গহীন পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা গড়ে তুলেছে তাদের শক্তিশালী ও দুর্ভেদ্য আস্তানা।
তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে টেকনাফের হোয়াইক্ষং ও হ্নীলার পাহাড় থেকে অপহরণ করা হয়েছে অন্তত ১৩ জন কৃষককে। যাদের সবাইকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হয়েছে মুক্তিপণের বিনিময়ে। অপহরণের শিকার হওয়া এই অসহায়, দরিদ্র কৃষক পরিবারগুলোকে মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে হতে হচ্ছে নিঃস্ব।
টেকনাফের পাহাড়ে বাস করা স্থানীয়রা তাদের দিন যাপন করছেন অপহরণ আতঙ্ককে সঙ্গে নিয়ে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে দিনদিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত এক বছর আগে অপহরণের শিকার এক ব্যক্তি জানান, একদিন বিলে কাজ করার সময় ছেলেসহ তাকে ধরে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। সেখানে তাদের ওপর করা হয় অমানবিক নির্যাতন। পরবর্তীতে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মুক্তিপণ-বাবদ ছয় লাখ টাকা দেন অপহরণকারীদের। এতে দুইজনকেই ছেড়ে দেয় তারা। কিন্তু এখনো সেই নির্যাতনের ক্ষত সারাতে চিকিৎসা করাতে হচ্ছে, যেখানে খরচ হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার টাকা। মুক্তিপণ ও চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে পুরো পরিবারকে।
সদ্য অপহরণের শিকার হওয়া নবীর (ছদ্মনাম) মা জানান, অপহরণের খবর জেনেও পুলিশ কোনো সাহায্য করেনি তাদের। উল্টো মুক্তিপণ দিয়ে সন্তানকে ফিরিয়ে আনার পর ডাক্তার দেখানোর নাম করে তার ছেলেকে নিয়ে যায় পুলিশ।
রশিদ আহমেদ (ছদ্মনাম) বলেন, অপহরণের পর স্বজনদের কাছে ফোন দিয়ে দাবি করা হয় মুক্তিপণ, সেই মুক্তিপণ দিতে দেরি হলে চলে অকথ্য নির্যাতন। তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, "অপরাধীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনো মামলা হয়নি, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খোঁজও নেয়নি।"
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওসমান গনি জানান, অপহরণের পরপরই তারা অভিযান শুরু করে এবং এদের মধ্যে যাদেরকে পুলিশ উদ্ধার করেছে তাদের কোনো মুক্তিপণ দিতে হয়নি বলেই জানেন তিনি।
অন্যদিকে, নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, "যাদেরই অপহরণ করা হয় সবাইকেই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরতে হয়, কিছুদিন পরপরই এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে। কিছু স্থানীয় মানুষ আর রোহিঙ্গা চক্র মিলেই এই অপরাধ ঘটাচ্ছে।"
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে যাওয়া উচিৎ দাবি করে তিনি আরো বলেন, "টেকনাফের পাহাড়গুলো অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে অপহরণকারীদের জন্য। তাদের ধরতে ঝটিকা অভিযান না করে যৌথ বাহিনীর নিয়মিত অভিযান চালানো উচিৎ।"
কেন এত অপহরণ?
২০২০ সালের পর পুরো কক্সবাজার জেলার পুলিশ প্রশাসনে ঘটে এক বিশাল বদল। যে কারণে বর্তমানে নতুন কর্মকর্তাদের অপরাধী চিহ্নিত করতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে।
স্থানীয় সংবাদকর্মী সৌরভ দেব বলেন, "পুলিশের সোর্স দুর্বল হওয়ার কারণে অপরাধীরা প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। পুলিশ মুলত, অপহৃতরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসার পর তাদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে। “
তিনি আরও বলেন, “এরপর মাঠপর্যায়ে আর কোনো তদন্ত হয় বলে জানা যায় না। অপহরণের মামলাগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। যেহেতু মামলার অগ্রগতি নেই তাই অপরাধীরাও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। যে কারণে রাষ্ট্রের নাগরিকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাচ্ছে না, এটা আসলেই উদ্বেগজনক।”
তবে ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, টেকনাফ মাদক কারবারিদের অভয়ারণ্য, অনেক অপহরণ ঘটে মাদকপাচারের লেনদেন নিয়ে। অপহরণকারীরা যে মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে অপরাধ করে, সেসব নাম্বার বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার সাধারণ মানুষের নামে। যার কারণে তাদের সনাক্ত করতে হিমশিম খেতে হয়। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অপহরণের ঘটনাগুলো মাদক-সংশ্লিষ্ট নয় বলেও স্পষ্ট করেন তিনি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রাশেদ মোহাম্মদ আলী জানান, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় খুব সহজেই রোহিঙ্গাদের স্থানীয় অপরাধীরা ব্যবহার করে এসব কাজে। এবং ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সক্রিয় কিছু চক্র স্থানীয় অপরাধীচক্রের সাথে মিলে এই অপহরণ কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। যা একটি নিয়মিত ঘটনায় রূপ নিয়েছে টেকনাফে।
উল্লেখ্য, পুলিশ প্রশাসন সঠিক তথ্য দিতে না পারলেও সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে টেকনাফ অঞ্চলে ১২০ জন অপহরণের শিকার হয়েছে বলে জানা যায়। যাদের বেশিরভাগকেই মুক্তিপণ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে