প্রতিভা ও সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে হবে
দুই টেস্টের সিরিজে পাকিস্তানের কন্ডিশনে তাদের হোয়াইটওয়াশ করা দেশের ক্রিকেটে সাফল্যের ক্ষেত্রে ‘মাইলফলক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ হিসেবে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। খেলতে নামার আগে দেশের ক্রিকেট পণ্ডিতরা কেউ ভাবেনি দীর্ঘ সংস্করণের খেলায় বাংলাদেশ দল স্বাগতিক দলকে কমপ্লিটলি আউট-প্লেইড করে প্রথমবারের মতো সিরিজ জিতবে। বিজয় সব সময় আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং উজ্জীবিত করে।
এবার ভারতে দুটি টেস্ট ও তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সিরিজ। ভারতের বিপক্ষে দুটি টেস্ট আবার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ। পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের টেস্ট দলের দলগত শক্তি কয়েকগুণ বেশি। পাকিস্তানের বিপক্ষে দাপটের সঙ্গে সিরিজ জিতলেও ভারতের বিপক্ষে এটি অসম্ভব একটি চ্যালেঞ্জ।
বিশ্ব টেস্ট ক্রিকেটে ভারত এখন এলিট দলগুলোর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দেশে যারা ক্রিকেট বুঝেন তাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ দল প্রতিভার সবটুকু উজার করে দিয়ে খেলবে। চেষ্টা করবে টি-টোয়েন্টিতে ভারতের দলটি নতুন হলেও এরা ইতিমধ্যেই সাহসী ক্রিকেট খেলে দুর্দান্ত দল হিসেবে পরিচিত হয়েছে। ভারত সফরে বাংলাদেশকে দুটি সংস্করণেই মাঠে একদম দাঁড়াতে পারেনি। শেষ টেস্ট তো মাত্র দুদিন সময় পেয়ে ভারত দল বাংলাদেশকে লজ্জাজনক পরাজয়ের স্বাদ উপহার দিয়েছে।
বাংলাদেশ এবার লড়বে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নের অংশ হিসেবে দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলায় পয়েন্ট সংগ্রহের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজে (ঢাকা ও চট্টগ্রামে যথাক্রমে ২১ থেকে ২৫ এবং ২৯ থেকে ২ নভেম্বর)। বাংলাদেশ কিন্তু এখন পর্যন্ত ১৪টি টেস্ট খেলে জয়ের মুখ দেখেনি। ১২ টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে আর ২টি টেস্ট ড্র হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, দেশের পরিচিত স্পিনবান্ধব (বিশেষ করে ঢাকার মিরপুরে) উইকেটে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কতটুকু ইতিবাচক লড়াই করতে সক্ষম হবে। চলতি বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ দল নিজ দেশের উইকেটে দুই টেস্টে হোয়াইটওয়াশের স্বাদ পেয়েছে। বাংলাদেশ ২০২২ সালে শেষবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেছে সেইসঙ্গে সেই সফরে স্বাগতিক দেশ শুধু বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ সহজে জিতেনি তারা টেস্ট ক্রিকেটে তাদের রানের কয়েকটি রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা জানে দেশের মাটিতে বাংলাদেশ ভালো ক্রিকেট খেলে। জানে উইকেটের চরিত্র এবং ভূমিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘পেস আক্রমণ’ সব সময় ফলদায়ক এবং শক্তিশালী। বাংলাদেশের উইকেটের কথা ভেবেই তারা স্পিন আক্রমণে ওজন বৃদ্ধি করেছে। বাঁহাতি স্পিনার কেশব মহারাজের সঙ্গে বাঁহাতি স্পিনার সেনুরান মুথুসামি অফস্পিনার ড্যান পিট অন্তর্ভুক্ত করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোয়াডে মাত্র একজন খেলোয়াড় আছেন, যিনি টেস্ট অভিষেকের অপেক্ষায় আছেন। সফরকারি দলের ব্যাটিং সাইড পরীক্ষিত এবং শক্তিশালী। ভারসাম্যপূর্ণ দলটির লক্ষ্য আবার সিরিজ জয়। নিয়মিত অধিনায়ক ঢাকার মিরপুরে (২১ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া টেস্টে) ইনজুরিতে ভোগায় খেলতে পারবেন না। অধিনায়ক টেম্বা বাভুমার পরিবর্তে মিরপুরে দলের নেতৃত্ব দেবেন এইডেন মার্করাম পরিবর্তে স্কোয়ার্ডে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তরুণ ব্যাটার ডেওভাল্ড ব্রেভিস।
নির্বাচকরা বাংলাদেশের যে স্কোয়ার্ড দিয়েছেন এর বাইরে টেস্ট টেম্বারমেন্টের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো খেলোয়াড় তো আর নেই। দেশে টেস্ট খেলোয়াড়দের গণ্ডি ভীষণ সীমাবদ্ধ। বছর বছর ধরে একই অবস্থা চলছে। টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে নির্দিষ্ট সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই। নেই ঘরোয়া ক্রিকেটে একদশ বা টিমের বাইরে নিয়মিত কোনো টুর্নামেন্টের আয়োজন। দেশের ক্রিকেট বোর্ড এবং সংশ্লিষ্টরা ব্যস্ত বিভিন্নভাবে। কথার ফুলঝুরিতে যে ক্রিকেট এগোবে না এটা বুঝেও বাস্তবে চলে মতলব হাসিলের খেলা।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দেশান্তর হয়েছেন। এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট এবং বোর্ডের পরিচালক হওয়ার জন্য সময়ের সন্তানদের তোড়জোড় সবাই লক্ষ্য করেছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনীত পরিচালক ফারুক আহমেদ এখন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। ক্রিকেট পরিচালনা এবং অন্যান্য দায়িত্বে যিনি আছেন নাজমুল আবেদিন ফাহিম, তিনিও ক্রীড়া পরিষদের মনোনীত পরিচালক। এই দুজনকেই দেখা যাচ্ছে বোর্ডের সব অপারগতায় মিডিয়ার সামনে।
ক্রিকেট বোর্ড জাতীয় দলের প্রধান কোচ হাথুরুসিংহেকে বরখাস্ত করেছে। ১৫ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আসন্ন সিরিজের আগে। কোচ হাথুরুসিংহেকে বিদায় নিতে হবে যে কোনো সময়ে এটি বোর্ডের নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেয়ার পর সবাই বলাবলি করছেন। কারণ হলো ফারুক আহমেদ সঙ্গে কোচের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং বিরোধ। যদিও বরখাস্ত করার সময় ব্যক্তিগত বিষয়গুলো উল্লেখ করা হইনি। কারণ হিসেবে বোর্ড নতুন কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রাক্তন অলরাউন্ডার ফিল সিমন্স। তিনি আগামী বছর টেস্ট চ্যাম্পিয়ন প্রাপ্ত বাংলাদেশ দলের দায়িত্বে থাকবেন। ইতিমধ্যে নতুন কোচ বাংলাদেশ দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
এই যে, বাংলাদেশ বার বার কোচের চাকরির মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও বরখাস্ত করে- এই সংস্কৃতি সব সময় ক্রিকেটবিশ্বে একটি গণ্ডিতে আলোচনার জন্ম দেয়। বিষয়টি দেশের ক্রিকেটের জন্য অবস্যই নেতিবাচক। কোচ নির্বাচনের সময় একরকম আবার পরে পেশাদার এই মানুষটির সঙ্গে উল্টো এক ধরনের আচরণ তো হওয়া উচিত নয়। সব কিছু বুঝে শুনেই তো কোচ নির্বাচন করতে হবে।
সাকিব আল হাসান চেয়েছিলেন তিনি তার টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি দেশের দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে; কিন্তু তার সেই আশা আর পূরণ হলো না। যদিও সাকিব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তার পক্ষে এবং বিপক্ষে ক্রিকেট অনুরাগী মানুষের অভাব নেই। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন সাকিবের দেশে আসা ও বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা থাকার কথা নয়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাকিব আল হাসানের দেশে ফিরে টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলা আর হলো না। এমন ঘটনায় দেশজুড়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুভাগে বিভক্ত হলেও, আমি বলব, এই ঘটনা নজিরবিহীন।
সাকিব ইতোমধ্যে দেশের বাইরে থেকে রাজনীতিতে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে বিবৃতি দিয়েছেন। দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কোনো ধরনের ভূমিকা পালন করতে না পারার জন্য। সাকিব কীভাবে ভূমিকা পালন করবেন, তিনি তো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তাছাড়া দল এবং রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক তো কারও অজানা নয়। সাকিবের পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। সাকিব নিজে একজন ইমিগ্র্যান্ট কার্ডধারী। রাজনীতি মতবাদের মানুষ ক্রীড়াঙ্গনে থাকবেন, এটি আশা করা সম্ভব নয়। সমস্যা হলো দলীয় রাজনীতিকে ক্রীড়াঙ্গনে টেনে আনা এবং দলের নেত্রী এবং নেতাদের চাটুকারিতা এবং পদলেহন।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন ও প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে