বোতলজাত পানিতে এ কেমন নৈরাজ্য
হাফ লিটারের (এক গ্লাসের চেয়ে একটু বেশি) এক বোতল পানির দাম ২০ টাকা। এক কার্টুনে থাকে ২৪টি। দাম ২৬০ টাকা। কারওয়ান বাজার থেকে আমি নিজেই এই দামে কিনেছি। খুচরা দোকানদাররাও এই দামে কেনেন। তার মানে এক বোতল পানির ক্রয়মূল্য ১১ টাকারও কম এবং প্রতি বোতলে খুচরা বিক্রেতার লাভ হয় ৯ টাকা!
ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়াসার বিশুদ্ধ খাবার পানি কিনতে পাওয়া যায়। তার প্রতি লিটারের দাম মাত্র ৮০ পয়সা! এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে ভর্তুকি দেয় ঠিক আছে। কিন্তু যেসব কোম্পানি বোতলজাত পানির ব্যবসা করে, তাদের প্রতি বোতল পানির উৎপাদন খরচ কত? হাফ লিটার পানি এবং তার সঙ্গে একটা প্লাস্টিকের বোতল- সব মিলিয়ে ৫-৬ টাকার বেশি কি খরচ হয়?
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বলছে, এক লিটার পানির বোতল তৈরিতে খরচ ৩ দশমিক ৬৭ টাকা। এক লিটার পানি পরিশোধন খরচ এক টাকা। বোতলে লেভেলিং খরচ এক টাকা। মার্কেটিংসহ অন্যান্য খরচ ১ দশমিক ২৮ টাকা। সব মিলিয়ে এক লিটার পানির বোতলে মোট খরচ ৬ দশমিক ৯৫ টাকা; কিন্তু খুচরা বাজারে প্রতি বোতল বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। হাফ লিটার পানির বোতলের উৎপাদন খরচ আরও কম।
গত বছরের ২০ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বাজার মনিটরিং সেলের রিপোর্টে বোতলজাত পানির দাম অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়: অদ্য ২০/০৮/২০২৩ তারিখ বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বাজার মনিটরিং সেল ঢাকার শান্তিনগর বাজার পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে দেখা যায় বোতজাত খাবার পানির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে বিদ্যমান কিনলে, অ্যাকোয়াফিনা, মাম, ফ্রেশ, পুষ্টি, জীবন ব্র্যান্ডগুলোর ৫০০ মি.লি পানির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ২০ টাকা, যার পূর্ব মূল্য ছিল ১৫ টাকা। এ ছাড়াও প্রতি ৫০০ মি.লি বোতলজাত খাবার পানির পাইকারি মূল্য ১১-১২ টাকা। অর্থাৎ খুচরা পর্যায়ে বোতল প্রতি প্রায় ৮-৯ টাকা বেশি, যা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি মর্মে বাজার মনিটরিং সেলের নিকট প্রতীয়মান হয়।
এক, দেড় ও ৫ লিটারের বোতলের ক্ষেত্রেও একই কথা। তবে বড় বোতলের চেয়ে হাফ লিটারের বোতলে ক্রেতার লস বেশি; কিন্তু একজন ক্রেতা একার জন্য সাধারণত এক বা দেড় লিটারের বোতল কেনেন না। তিনি সহজে বহনযোগ্য এবং এক টানে গিলে ফেলা যায় বলে হাফ লিটারের বোতলই কেনেন।
ইদানীং হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফেতে হাফ লিটারের চেয়ে বড় বোতল রাখা হয় না। কারণ এক লিটারের বোতল ৩০ টাকা। তিনজন খেতে বসলে এক লিটার বোতল যথেষ্ট; কিন্তু এক লিটারের বোতল না রাখলে তাদের অন্তত দুটি বোতল কিনতে হয়। তাতে দুই বোতলে দোকানির লাভ ১৮ টাকা। এক লিটারের এক বোতল পানি বিক্রি করে তার ১৮ টাকা লাভ হয় না। তাছাড়া এক বা দেড় লিটারের বোতল রাখতে সামগ্রিকভাবে দোকানির বিক্রির পরিমাণ কম হয়। অর্থাৎ শুধু হাফ লিটারের বোতল রাখাও ব্যবসার কৌশল। আবার কোনো কোনো কোম্পানির হাফ লিটার বোতলের দাম ১৫ টাকা হলেও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয় ২০ টাকায়। বিশেষ করে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, ট্রেন স্টেশন এবং অনেক রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফেতে।
বাজারে বোতলজাত পানির বাইরে বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টে জারের পানি বিক্রি হয় অনেক কম দামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই দুই ধরনের পানির মধ্যে গুণগত তেমন কোনো পার্থক্য নেই। গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহের পর তা পরিশোধন করে বোতল ও জারে বাজারজাত করা হয়। তবে বোতলজাত পানি উৎপাদনকারীদের দাবি, তারা শতভাগ ফুড গ্রেডেড বোতলে পানি সরবরাহ করেন-যা তৈরির উপাদানের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে; কিন্তু তারপরও হাফ লিটার পানির বোতল ২০ টাকা আদৌ যুক্তিসঙ্গত বা বাস্তবসম্মত কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন।
কোম্পানিগুলো ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে হঠাৎ করে আধা লিটার পানির বোতলের দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করে। এই দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার ও কাঁচামালের কারণে বেড়ে যাওয়া আমদানি খরচকে দায়ী করে। যদিও প্রতিযোগিতা কমিশনের (বিসিসি) অনুসন্ধান বলছে, ডলার ও কাঁচামালের আমদানি খরচে নামমাত্র ব্যয় বাড়লেও এই অজুহাতে উৎপাদন ও সরবরাহকারী বেসরকারি কোম্পানিগুলো আধা লিটারের বোতলজাত পানির দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৪২০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা বাড়িয়েছে।
২০ টাকার বাজারমূল্য এখন কত আর ২০ টাকায় আর কী কী পাওয়া যায়- সেই তর্কে না গিয়ে এই প্রশ্নটিও তোলা দরকার যে, এখনও যে দেশে ভূগর্ভে অনেক বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় এবং অধিকাংশ নদী, খাল, হাওর, দিঘি ও পুকুরের পানি ফুটিয়ে বা ট্যাবলেট দিয়ে পরিশোধন করেই পান করা যায়, সেই দেশে হাফ লিটার পানি ২০ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হবে কেন? পানির দেশে পানির কি আকাল পড়েছে?
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিশু একাডেমিতে নদীবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান, ছোটবেলায় তিনি দেশের অনেক নদীর পানি তিনি পান করেছেন। পেটের পীড়ার ভয় ছাড়াই গিলে ফেলেছেন। কিন্তু এখন বাংলাদেশের নদীর পানি পান করা তো দূরে থাক, অনেক নদীর পানি স্পর্শও করা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে প্যারিসপ্রবাসী এই খ্যাতিমান শিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, ‘নদীর দেশে পানি কিনে খাই; মনে হয় বিদেশে আছি।’
অতএব, নদী ও পানির দেশের মানুষ যাতে রাস্তাঘাটে, দোকানপাটে, হাট-বাজারে সহজেই বিশুদ্ধ পানি পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে এবং সেইসঙ্গে বোতলজাত পানির ব্যবসার নামে নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। সকল রেস্টুরেন্টকে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করার আদেশ দিয়ে সেটি কাস্টমারকে বিনামূল্যে সরবরাহের নির্দেশ দিতে হবে। অর্থাৎ খাবারের সঙ্গে যাতে অতিরিক্ত হিসেবে পানির বোতল কিনতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
বোতলজাত পানির আরেকটি বড় বিপদ হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। লাখ লাখ বা কোটি কোটি বোতলের মধ্যে কত শতাংশ রিসাইকেল হয়? একটা বড় অংশই নানাভাবে পরিবেশের সাথে মিশে যায়। নদী ও সাগরে চলে যায়। ভূগর্ভে চলে গিয়ে মাটি ধ্বংস করে। পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। সুতরাং পরিবেশের এই বিপদ বিবেচনা করেও বোতলজাত পানির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। শুধু দামের কারণেই নয়, বরং যে দেশের শিল্প ও শহরাঞ্চলের বাইরে অন্যান্য স্থানে নদী-খাল-হাওর-দীঘি ও পুকুরের পানি এখনো বিপজ্জনক নয়; যে দেশের ভূগর্ভে এখনো পানি পাওয়া যায়- সেই দেশের মানুষকে কেন হাফ লিটার পানি ২০ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হবে- এই প্রশ্নটি জোরেশোরে তোলা দরকার।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্টের পরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দগুলো একটি হচ্ছে ‘সংস্কার’। রাষ্ট্রের সর্বত্রই সংস্কার লাগবে। তবে সবচেয়ে বড় সংস্কার লাগবে নিত্যপণ্যের বাজারে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে