মাগুরার সেই শিশুটি
‘মাগুরার সেই শিশুটি’- নিজের নামকে আড়াল করে এখন এটিই শিশুটির পরিচয়। এই নামেই তাকে চিনছে গোটা দেশ। হয়তো এই তিনটি শব্দবন্ধ দেশের সীমানাও পেরিয়ে গেছে, ছড়িয়ে পড়েছে আরও দূর-দূরান্তে। হয়তো সে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, কিংবা শিক্ষক। হয়তো একদিন সে নিজেই মা হতো, কোনো শিশুর হাত ধরে তাকে পৃথিবীর গল্প শোনাতো; কিন্তু না, সে আর বড় হবে না। তার স্বপ্নগুলো রক্তাক্ত হয়ে গেছে। মাগুরার এক নিষ্পাপ শিশুর জীবন থেমে গেছে নৃশংসতার কফিনে।
শিশুটির বয়স মাত্র আট। সে হয়তো রঙিন স্বপ্ন দেখেছিল, খেলতে চেয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে, মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়তে চেয়েছিল নিশ্চিন্তে; কিন্তু তার জীবনের পরিণতি হয়েছে এমন এক নিষ্ঠুরতার মধ্যে, যা শুধু তাকে নয়, গোটা সমাজকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তার মায়ের কোল এখন শূন্য, তার বাবা অসহায়, আর আমরা বাকরুদ্ধ। বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল শিশুটি। নিরাপদ আশ্রয় ভেবেছিল, কিন্তু সেই আশ্রয়ই হয়ে উঠল তার জন্য মৃত্যুকূপ। সেখানে তার ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। এই বর্বরতার শিকার হয়ে অবশেষে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেছে।
আমরা কেবল ক্ষোভ প্রকাশ করি, প্রতিবাদ জানাই, শোক পালন করি; কিন্তু আমাদের সমাজ কি আদৌ বদলাচ্ছে? প্রতিদিনই তো আমরা এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হচ্ছি। আজ মাগুরার সেই শিশুটি, কাল অন্য কোথাও আরেকটি শিশু- এই চক্র কি কখনো বন্ধ হবে না? সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা এই বিকৃত মানসিকতা, সহিংসতার সংস্কৃতি, বিচারহীনতার শিকল যদি ভাঙতে না পারি, তবে আমরা সবাই একেকজন অপরাধের অংশীদার। আমরা কি পারছি শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলতে? পারছি না। বরং প্রতিদিন তাদের স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছি, তাদের জীবন শেষ করে দিচ্ছি।
ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর অনেক সময় ভুক্তভোগী বেঁচে থাকলেও ন্যায়বিচার পায় না। বিচার পেতে গড়িমসি, প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ, প্রশাসনিক জটিলতা- এসবই যেন স্বাভাবিক চিত্র; কিন্তু মাগুরার এই শিশুটির ক্ষেত্রে কি বিচার দ্রুত নিশ্চিত হবে? এই ঘটনা কেবল একটি অপরাধ নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তাই অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা দূর করে দ্রুততম সময়ে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করতে হবে।
প্রশ্ন উঠছে, শিশুরা কি কোথাও নিরাপদ? তারা কি ঘরে, রাস্তায়, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, স্কুলে- কোথাও কি নিশ্চিতভাবে নিরাপদ? অভিভাবকরা কি নিশ্চিত হতে পারেন যে তাদের সন্তান নিরাপদ থাকবে? এই ভয়াবহ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সমাজের জন্য কঠিন ও অপ্রিয়। শিশুদের নিরাপত্তার জন্য আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হতে হবে দায়িত্বশীল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হতে হবে আরও কঠোর।
এই ধরনের ঘটনা প্রকাশ্যে আনতে মিডিয়ার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে মিডিয়া সচেতনতা বাড়ায়, অপরদিকে বিচারপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে। তবে মিডিয়াকে সংবেদনশীল হতে হবে, যেন ভুক্তভোগী পরিবার আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়া দরকার। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। তাই:
১. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে- প্রতিটি যৌন সহিংসতার ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. বিচার ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন- ধর্ষণের শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করতে হলে আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো গড়িমসি চলবে না।
৩. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে— প্রতিটি পরিবারকে সন্তানদের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে এবং অপরিচিতদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
৪. স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক শিক্ষা চালু করতে হবে— শিশুদের শেখাতে হবে কীভাবে তারা বিপদের সময় আত্মরক্ষা করতে পারে এবং অপরিচিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে।
৫. ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরোটলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে— সমাজের প্রতিটি স্তরে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
মাগুরার সেই শিশুটি আর কোনো দিন মায়ের কোলে ফিরবে না, বাবার হাত ধরে স্কুলে যাবে না, ভাই-বোনের সঙ্গে খেলবে না। তার নিথর দেহ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের বিবেক কি কাঁপবে না? এই শিশুর রক্ত যেন আরেকটি শিশুর স্বপ্ন ধুলিসাৎ না করে দেয়, এই প্রতিশ্রুতি আমাদের নিতে হবে। নইলে আমরা আবারও ব্যর্থ হবো, আবারও একটি নীল স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী হবো।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে