ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে
কীসের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এমন সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার মূল কারণটি অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে। ওপরে ওপরে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা কমানোর দাবিতে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কীভাবে ছাত্ররা এই আন্দোলন শুরু করেছিল, এবং এই আন্দোলন কীভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল সেসবের আর পুনরাবৃত্তি করছি না আমি। প্রথম দিকে দেশের জনসাধারণের একটা বড় অংশ যে ছাত্রদের এই আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছে সেটাও সত্য।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি এমনকি ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও সহানুভূতি জানিয়েছেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রথম দিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বারবার বলেছেন, আদালতের সিদ্ধান্ত মুলতবি আছে। এটি এখন আদালতের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ছাত্ররা তাতে আস্থা রাখতে পারেননি। তারা রাস্তায় নামেন। কোটা কমানোর জন্য নির্বাহী বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। দাবি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তারা রাস্তাঘাটও বন্ধ করে দিতে শুরু করেন।
কিন্তু, হায়! এমন সব ঘটনা ঘটতে লাগল যা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। পুলিশ এসে তাদের রাস্তা থেকে তাড়ানোর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করল। সাধারণ একটি আন্দোলন রূপ নিল যুদ্ধংদেহী বিক্ষোভে। সংগ্রামী ছাত্ররা মনে করেন তাদের দাবি অন্যান্য রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। আন্দোলন চরম সহিংসতায় রূপ নেয় ১৭ জুলাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে যা ছিল শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি-জামাত তা নিয়ে গেল রাস্তায় চরম সংঘর্ষে। আন্দোলনকে তারা একটি রাজনৈতিক বিদ্রোহে রূপ দেয়। সরকারি সম্পদ ধ্বংস করতে থাকে দেদার।
তাদের দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কঠোর ব্যবস্থা নেয়। ফলে এ পর্যন্ত ২০০ মানুষ মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে হাজারেরও বেশি। যা ছিল একেবারেই অনভিপ্রেত, তাই ঘটে গেল। গত ১৫ বছরের একটানা শাসনামলে রাস্তাঘাট, সেতু, আধুনিক বন্দর ও ঢাকায় একটি আকর্ষণীয় মেট্রোরেল নির্মাণ করে বাংলাদেশকে একটি শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দিকেই এখন শকুনের চোখ। মুক্তিযুদ্ধের পর গত ৫৩ বছরে এত বড় ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড আর কখনো হয়নি।
রাষ্ট্র পরিচালিত বাংলাদেশ টেলিভিশন ও দুটি মেট্রোরেল স্টেশনে নাশকতা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। বেশ কয়েকটি সরকারি ভবন পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় ৫০০ টি দামি সরকারি-মালিকানাধীন যানবাহন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অনেক প্রাইভেট বাসও পুড়িয়ে দিয়েছে। ধ্বংসের মাত্রা দেখলে যে কেউই এটা বলবেন যে এরকম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড যারা করছেন, তারা আর যাই হোক, তারা দেশকে ভালোবাসেন না। এর সব প্রমাণ সিসিটিভি ফুটেছে রয়ে গেছে।
আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে যেসব সুবিধাবাদী লোকজন রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের আকাঙ্ক্ষার ক্ষতিপূরণ জনগণকে দিতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ সহ্য করার মধ্য দিয়ে। ইন্টারনেট সেবায় বাধা পড়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে কোটি কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মিটারে টাকা ভরতে পারেনি বলে অনেককে অন্ধকারে থাকতে হয়েছে। বিদ্যুৎ অফিসের সামনে অনেককে ঘণ্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। গত রোববার আদালত কোটা নিয়ে রায় প্রকাশ করেছে। সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয়, ৯৩ শতাংশ সরকারি চাকরি মেধার ভিত্তিতে হবে।
ছাত্রসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ দাবি পূরণ করেছে সুপ্রিম কোর্টের রায়; কিন্তু তারপরও কিছু ছাত্র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেণ। এটা নিঃসন্দেহে বিরোধী শক্তির উসকানি। এই আন্দোলন আবারও প্রমাণ করল যে, বাংলাদেশের মানুষ এখন স্পষ্টতই দুটি দলে বিভক্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ সমর্থনে একটি ডানপন্থি শক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। এই ডানপন্থি শক্তি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণও নিয়েছিল।
জিয়াউর রহমান ইসলামিক অনুভূতি ব্যবহার করে দেশের মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যান। তার উত্তরসূরি জেনারেল এইচ এম এরশাদ এবং পরবর্তীতে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া এই একই ধারা অব্যাহত রাখেন। রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেন। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। পাকিস্তানপস্থিরা দেশ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নির্মূল করার জন্য ধর্মান্ধ অবস্থান গ্রহণ করে।
১৯৯৬ সালে সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন; কিন্তু ২০০১ সালে কারচুপি নির্বাচনে শেখ হাসিনার পরাজয়ের পর দেশ আবার বেগম জিয়ার হাত ধরে পেছন দিকে ফিরতে থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা আবার জয়ী হন। তারপর থেকে তিনি টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন। তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান একটি উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার তার পিতার স্বপ্ন পূরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাজারে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে।
পোশাক শিল্পে এখন ৪০ লাখেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। যাদের অধিকাংশই নারী। এর মানে ক্ষমতায়নে নারীরাও এগিয়ে গেছেন উল্লেখযোগ্যভাবে। আমাদের কষ্টের অর্থেই দেশের মনোমুগ্ধকর স্থাপনাগুলো তৈরি। কিন্তু, এসব গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা দান করেছেন নিজের গায়ের রক্ত। ১৯৭১ সালের আগে বাংলাদেশ ছিল একটি উপনিবেশ, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের তুলনায় সব ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে ছিলাম। সত্যি বলতে আমাদের কোনো নিজস্ব পরিচয় ছিল না।
আমাদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছিল। আজ আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি; কিন্তু একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তি বারবার আমাদের আঘাত করার চেষ্টা করছে। অবশ্যই সরকার এই সংকট কাটিয়ে উঠবে; কিন্তু পরিকল্পনা করে যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে