Views Bangladesh Logo

সেদিন সাতই মার্চ

Rafiqur  Rashid

রফিকুর রশীদ

মানুষ মাত্রই এক বা একাধিক নাম থাকে। নামেই তার পরিচয়। কারও বা একটি মাত্র নাম দিয়ে কেটে যায় গোটা জীবন। কারও বা একাধিক নামের প্রয়োজন হয়। জীবনের বাঁক বদলের সময় পদবি বা সুগন্ধী বিশেষণ এসে নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঝুলতে ঝুলতে এক সময় মূল নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়, তখন কোনটা মূল আর কোনটা যে ডালপালা তা শনাক্ত করাও দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। তবু মানুষ কিন্তু নামের কাঙাল, নাম নিয়েই বাঁচে-মরে। নামের মধ্যেই বসবাস সবার।

নিজের নাম কখনো কারও কাছে দুর্বহ হয়ে ওঠে, নাকি হয়ে উঠতে পারে? আর যদি বিশেষ কোনো কারণে তা হয়েই পড়ে, তখন কীইবা করার থাকে। পিতৃপ্রদত্ত নামও সমূলে উৎপাটনের মতো ঘটনা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন আকারে মাঝেমধ্যে ছাপা হতে দেখা যায় এফিডেফিট নম্বরসহ; কিন্তু সে সবের অধিকাংশই ধর্মান্তরঘটিত নাম পরিবর্তন। সূর্যখোলা গ্রামের মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে তো তেমন কিছুই ঘটেনি। তার জন্মদাতা পিতা শেখ মো. আজিজুর রহমান ছোটবেলায় মক্তব-মাদ্রাসায় ভর্তির সময় যেমনটি লিখে দিয়েছেন, তেমনই আছে। আংশিক পরিবর্তনের দুমর্তিও কখনো হয়নি তার। এসব নাকি কবি-টবি অনেকে করে থাকেন, নিজের নামকেই ভেঙেচুরে একটুখানি কাব্যসুষমা যুক্ত করে জাহির করতে ভালোবাসেন। গ্রাম্য স্কুলে ধর্মশিক্ষক মুজিবুর রহমান কোথায় পাবেন কাব্য প্রতিভা।

সমস্যা হয়েছে মুজিবুর রহমানের একমাত্র পুত্র হাফিজুর রহমানকে নিয়ে। তিন মেয়ের পর সবেধন নীলমণি, বোধ হয় একটু বেশিই পাত্তা পেয়েছে সে। মায়ের আঁচলতলে সন্তান চিরকালই অবারিত স্বর্গসুখ পেয়ে থাকে, হাফিজুরও তার ব্যতিক্রম নয় হয়তো; কিন্তু বাবা হিসেবে তিনিই বা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছেন ছেলের ওপরে? হাতের মুঠোর চেয়ে আমের আকৃতি বড় হয়ে গেলে তো হাত ফসকে যেতেই পারে। এমন তো হরহামেশাই ঘটে থাকে। এ জন্য পস্তালে চলবে?

নিজের নামের আগে ‘শেখ মো.’ রাখতে চায় না হাফিজুর। এসব নাকি একেবারে ব্যাক ডেটেড। এ ভারি তাজ্জব কথা! এ কি ইচ্ছে-অনিচ্ছের ব্যাপার! মুজিবুর রহমান শৈশবে তার পিতা আজিজুর রহমানের কাছে বহুবার শুনেছেন- এ দেশের সব শেখ আদি ও অকৃত্রিম শেখ নয়। অনেক আছে ধার করা শেখ। অনেক আছে ভেজাল শেখ। শেখ বললেই সবাই শেখ হয়ে যায়? আদি শেখ বংশের ধারা এসেছে আরব জাহান থেকে। দেওবন্দের মওলানা শেখ মো. আজিজুর রহমান পুত্রের পিঠে হাত রেখে ছবক দিতেন- মনে রেখো তোমার শরীরে বইছে আরবীয় রক্তের শক্তিশালী ধারা। এর পর তিনি তার পূর্বপুরুষদের চেহারার বর্ণনা শোনাতেন। গৌরবর্ণ, খাঁড়ার মতো টিকালো নাক, ছয় ফুটের ওপরে উচ্চতা... ইত্যাদি। হাফিজুর বংশ-লতিকার এই গর্বিত ধারা একেবারে ঘ্যাচ করে একটানে কেটে দিতে চায়, হাত উল্টিয়ে নিজের গায়ের চামড়া দেখিয়ে সোজাসুজি দাবি করে- আমরা তামাটে জাতি।

হাফিজুরের গোয়ার্তুমি তো নতুন নয়। শৈশবে সে মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে স্কুলে গেছে। ধর্মীয় লাইন পছন্দ হলো না, গেল জেনারেল লাইনে। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে একেবারে ইউনিভার্সিটি। শুধু সূর্যখোলা কেন আশপাশের ৮-১০ গ্রামের মধ্যে ঢাকা ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র বলতে এক হাফিজুরই প্রথম। লোকে বলে, হুজুর স্যারের ছেলের মাথা ভালো, নিশ্চয় বড় কিছু হবে।

গ্রামের মানুষ ধর্মীয় শিক্ষককে সাধারণ মওলানা সাহেব বলেই সম্বোধন করে। কেউ কেউ আবার হুজুর স্যারও বলে। হাফিজুরের বড় কিছু হবার সম্ভাবনার কথা শুনে তিনি বেশ আরাম পান, স্বস্তি বোধ করেন; কিন্তু তার প্রবল আশঙ্কা হয়- দেশে যে রাজনৈতিক ডামাডোল চলছে, এই উথাল-পাথাল ঘূর্ণিস্রোতে তার ছেলেটি কোথাও না হারিয়ে যায়। নিজের নামের সম্মুখভাগে শেখ মো. ‘লিখতে ভালো লাগে না, অথচ শেখ মুজিবের চ্যালা হয়ে মিছিলে নেমে জান বাজি রাখতে তার একটুও আপত্তি নেই। কেন, তোদের লিডারের নামের মাথা থেকে শেখ মুছে ফ্যাল! তারপর না হয় নিজেরটা ছেঁটে ফেলিস! উঁহু, তার বেলা রয়েল বেঙ্গলের মতো গর্জে ওঠে- শেখ মুজিবুর মহান নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু। এ সব আস্ফালন শুনলে হাফিজুরের বাবার ব্রহ্মচাঁদিতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে। তখন নিজের নামটিকে নিজেই মুখ ভেংচিয়ে উচ্চারণ করেন- হুঁ! শেখ মুজিব! দেশের ছাত্র-সমাজের মাথা চিবিয়ে খেয়েছেন, তিনি আবার বঙ্গবন্ধু! তোফায়েল আহমেদ চোঙা ফুঁকে বলল, আর অমনি হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু! ওই নামের পেছনে জনগণ ম্যান্ডেট দিয়েছে? যত্ত সব ফালতু নাচানাচি!

মুখে যা-ই বলুন, পুত্রজন্মের দায় তো এড়াতে পারেন না মুজিবুর রহমান। একমাত্র পুত্রসন্তান, দুমাস তার খোঁজখবর নেই। হলের ঠিকানায় চিঠি লিখে তার জবাব আসে না। মায়ের চোখে ঘুম নেই। বোনেরা কান্নাকাটি করতে করতে একদিন অভিযোগই জানিয়ে বসে- আব্বা কি ঢাকায় গিয়ে একবার খোঁজ-টোজ নিতে পারে না! বাহ্যজ্ঞানশূন্য এই সব মেয়েমানুষের কী বলবেন তিনি! দেশের যে অবস্থা, এখন কি ঘরের বাইরে পা বাড়াবার সময়! ঢাকায় আগুন জ্বলছে, সেখানে এখন পৌঁছুবেন কী করে! ইয়াহিয়া সংসদ-অধিবেশন স্থগিত করার পর চলছে অসহযোগ আন্দোলন, প্রতিদিন আধাবেলা হরতাল, রাস্তাঘাটে মিটিং মিছিলে সয়লাব, এর মধ্যে ঢাকায় যাওয়া কি মুখের কথা! বললেই হলো! এদিকে হাফিজুরের মা নাওয়া-খাওয়া ছেড়েছে, কথাবার্তাও বন্ধ-প্রায়। নিরুপায় জননী অবশেষে এক রাতে স্বামীর পায়ের ওপরে মাথা রেখে কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিলে মুজিবুর রহমান সেদিন প্রত্যুষে ফজরের নামাজ শেষে দোয়া-দরুদ পড়ে পুত্রের সন্ধানে অনিশ্চিত পথযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। কোথায় দেশের এক প্রান্তের সীমান্ত-গ্রাম সূর্যখোলা, আর কোথায় কোন সুদূরে ঢাকা মহানগরী! কখন কীভাবে পৌঁছুবেন কে জানে!

সেদিন সাতই মার্চ
দুদিন-দুরাত পথে পথে ঘুরে ঘুরে সূর্যখোলা গ্রামের ধর্মীয় শিক্ষক শেখ মো. মুজিবুর রহমান ঢাকা নগরীতে প্রবেশ করেন। পথে কত দুর্ভোগ, কত বিড়ম্বনা! কত গুজব কত খবর! সংবাদের গায়ে হুমড়ি খেয়ে আছড়ে পড়ে দুঃসংবাদ। ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনা-টঙ্গী আর্মি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, নির্বিচারে মানুষ মারছে গুলি করে; কিন্তু মিছিল মিটিং সমাবেশ তো থামছে না। গ্রাম-গঞ্জ-লঞ্চঘাট সর্বত্র টানটান উত্তেজনা, রাস্তায় রাস্তায় মিছিল আর মিছিল। গুলির ভয় করছে না মানুষ, এত সাহস পাচ্ছে কোথায়! ঢাকায় পৌঁছুনোর পর বড়ই দুর্ভাবনা হয়- এই উথাল-পাথাল মানবস্রোতের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে তো হাফিজুর রহমানকে?

প্রতিবাদী মানুষের পদভারে প্রকম্পিত রাজপথ। চতুর্দিক শোভিত ব্যানারে ফেস্টুনে। মার্চের বাতাস মুখর গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে। হাজার হাজার মানুষ। লাখ লাখ মানুষ। সবার চোখেমুখে কী উৎকণ্ঠা, কী উচ্ছ্বাস! সবাই চলেছে রেসকোর্স ময়দানে। না, কোনো ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা নয়! নয় কোনো বিশেষ কসরৎ দেখানো সাকার্স বা জাদুর খেলা। মানুষ চলেছে মানুষের প্রবাহে মিশে। লাখো লাখো মুখের আদল আর আলাদা করে চেনা যায় না। এরই মাঝে কোথাও যদি হাফিজুর থাকে, যদি থাকেই সত্যি, বাপ হয়ে মুজিবুর রহমান তাকে চিনবেন কেমন করে?

হাফিজুর কি চিনবে তার জন্মদাতা পিতাকে?
ভরসা পান না তিনি। মানবস্রোতে গা ভাসিয়ে এগিয়ে চলেন। দুদিন দুরাতের ক্লান্তি শ্রান্তি কখন অজান্তে হারিয়ে গেছে। সবার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করেন তিনি। নদীর স্রোতের যেমন নিজস্ব টান থাকে, তিনি বেশ অনুভব করেন এই মানবপ্রবাহেরও তেমনই অনতিক্রম্য টান আছে। এই প্রবাহে পড়ে তিনি দিব্যি এগিয়ে চলেন সামনে, নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে কিছু আর টের পান না আলাদা ভাবে; কিন্তু অনভ্যস্ততাজনিত কারণে সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান ধরাটা কিছুতেই যেন হয়ে ওঠে না তার। এত জনারণ্যেও শুধু এই কারণে নিজেকে ভয়ানক নিঃসঙ্গ মনে হয়। থোকা থেকে খসে পড়া বৃন্তচ্যুত লিচু যেন বা। হঠাৎ ভাবনা হয় তার এই একাকিত্ব আবার অন্যদের চোখে ধরা পড়ে যাচ্ছে না তো! চলতে চলতে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখেন তিনি। নাহ্, কোথাকার কোন এক মুজিবুর রহমান, তার দিকে তাকাবার সময় কারও নেই। সবার লক্ষ্য অন্য এক মুজিবের দিকে। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশ তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনি শেখ মুজিব।

কিন্তু হাফিজুর রহমান কোথায়!
স্রোতের উজানে বহু কষ্ট করে ছাত্রদের হলে এসে পৌঁছেন মুজিবুর রহমান। ২৫০, মহসিন হল। ভুল হয়নি, খুঁজেপেতে ঠিক জায়াগাতেই এসেছেন তিনি। চোখের চশমা খুলে কাচ মুছে আবারও চোখে পরেন। নাহ্, ২৫০ নম্বর ঠিকই আছে। এই যে বন্ধ দরজার কপাটে চক দিয়ে নাম লেখা- হাফিজুর। আরও দুটি নামও আছে; কিন্তু রুমে কেউ নেই। রুম তালা বন্ধ। আসলে এত বড় ছাত্রাবাসেই কেউ নেই। বিলম্বে হলেও নিজের বোকামিতে ভীষণ লজ্জিত বোধ করেন তিনি, বেশ বুঝতে পারেন- ওদের সবার আজকের আসল ঠিকানা রেসকোর্স ময়দান। এখানে খুঁজলে চলবে কেন!

মুজিবুর রহমান নেমে আসেন হল থেকে। পা বাড়ান সামনে। আবারও মিলে যান মিছিলের স্রোতে। একবার জানতে কৌতূহল হয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঐতিহাসিক বটতলাটা কোথায়? কোথায় দাঁড়িয়ে ছাত্রনেতা রব নতুন পতাকা তুলেছেন? এ খবরটা যখন মুজিবুর রহমান প্রথম শোনেন, তখনই তাঁর বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে- আবার নতুন পতাকা! তার মানে দেশটা ভেঙে টুকরো টুকরো করাটাই খুব জরুরি তোমাদের কাছে! শেখ মুজিব তোমাদের কানে কানে এই মন্ত্র ভজিয়েছে কেমন? হায়রে দেশভাগ! সাতচল্লিশের দেশভাগের তোমরা কী দেখেছ, কী জানো? ওপারে চন্দ্রখোলার বিষয়-সম্পত্তি সব ফেলে এসে এপারে সূর্যখোলায় নতুন বসতি গড়তে হয়েছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ছোট চাচার প্রাণ হারিয়েছে- এ সবের কিছুই ভুলে যাননি মুজিবুর রহমান। সেই ভারতের দুর্বুদ্ধিতে আবার এ দেশ ভাঙাভাঙি! সরাসরি কোনো রাজনীতি না করলেও এই দুর্ভাবনা তাকে সর্বদা তাড়িত করেছে। ভেবেছেন, শুধু ছাত্র দিয়ে পতাকা তুললেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। স্বাধীনতা কি ছেলের হাতের মোয়া! যত্ত সব ইয়ার্কি!

কিন্তু এটা কী হলো! এভাবে পিছিয়ে পড়ার কোনো মানে হয়! হাফিজুরের হলে না গেলে তো আরো খানিকটা এগিয়ে থাকাই যেত। লাখো মানুষের ভিড় ঠেলে এখন সামনে এগোবেন কী করে! হাফিজুর যেখানেই থাকুক, নিশ্চয় এই লাখো জনতার মধ্যেই আছে। হ্যাঁ, জনতাই তো! ছাত্রের তুলনায় শ্রমিক-জনতাই অধিক। এত মানুষ! এত জনতা! সবাই আছে ঐ পতাকার সঙ্গে? মুজিবুর রহমানের বুকের ভেতরে নদী ভাঙনের শব্দ হয়, রেসকোর্স তবে কি আজ শুধু ছাত্রদেরই ঠিকানা নয়, সারা দেশের আপামর জনতার ঠিকানা? তা হলে এই ভরা মধ্যাহ্ন বেলায় তার হাত-পা কেঁপে উঠছে কেন? কোথায় দুর্বলতা তার? তিনি কি আর সামনে এগোতে পারবেন না?

এরই মাঝে কলরেডি মাইক্রোফোনে গমগম করে ওঠে বজ্রকণ্ঠ,
ভাইয়েরা আমার!
এ কী! গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে কেন! কোথায় শেখ মুজিব! নাহ্ কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। দুপায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে নিজেকে উঁচু করে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। যত দূর দৃষ্টি যায় কেবল লাখো মানুষের মাথা। দূরে নৌকা আকৃতির মঞ্চ বানানো হয়েছে। কিন্তু সেই মঞ্চের মানুষগুলো যেনবা খেলনা পুতুল। মুজিবুর রহমান চোখের চশমা খুলে তাকান। তবু স্পষ্ট হয় না কিছুই। নাহ্, চশমাটা এবার না বদ্লালেই নয়। এবার কালো রঙের চওড়া ফ্রেমের চশমা নেবেন, শেখ মুজিবের চশমার মতো; যাতে বর্তমান থেকেই ভবিষ্যৎ দেখা যায়।

মার্চের পড়ন্ত বিকেল। মেঘমুক্ত আকাশ রোদ ঢালছে খাঁটি সোনার মতো। তারই মাঝে খাপ খোলা তরবারির মতো ঝল্সে ওঠে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ। তাঁর কণ্ঠে ছল্কে ওঠে তেইশ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর। তাঁর কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয় উত্তরের হিমালয়ে ধাক্কা খেয়ে। তাঁর কণ্ঠে যেনবা মন্দ্রিত হয় বারো শত নদীর নূপুর নিক্কনি আর হাজারও পাখাপাখালির কলকাকলি।

মুজিবুর রহমানের ভেতরে বাইরে ওলোটপালোট হয়ে যায়। ঢাকার আকাশ থেকে যেনবা মেঘের পালক এসে পড়ে তাঁর মাথায়। তিনি সম্মোহিত হয়ে পড়েন। তিনি শুনতে পান-

আর যদি একটা গুলি চলে...
মুজিবুর রহমান পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করেন। কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করেন-কী করতে হবে গুলি চললে?
প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। একেবারে জড়তামুক্ত স্পষ্ট আদেশ,
যার যা আছে, তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে।
এই সহজ সরল নির্দেশ খুব ভালো লাগে মুজিবুর রহমানের। তাই তো, রাইফেল-বন্দুক কী হবে! যার যা আছে সেটাই তো যথেষ্ট। কৌশলটাই বড় কথা। ওই যে বললেন- আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।

মুজিবুর রহমান মনে মনে তাঁর পুত্র হাফিজুর রহমানকে খোঁজেন। রণকৌশলটা বুঝিবা তিনি নিজে হাতে শিখিয়ে দিতে চান। কিন্তু কোথায় হাফিজুর? খুব নিকটেই, একেবারে পাশে থেকে কে যেন উচ্ছ্বসিত গলায় বলে ওঠে- ‘বাপের ব্যাটা শেখ সাহেব।’
কেন এ উচ্ছ্বাস!
শেখ সাহেব বললেন,
রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।
বাপরে বাপ! এ কী দৃঢ় প্রত্যয়! ভাঙবে, তবু মচ্কাবে না। সামনে সুদির্নিষ্ট লক্ষ্য না থাকলে কেউ কি স্থিরপ্রতিজ্ঞ হতে পারে? কী

সেই লক্ষ্য? দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন শেখ সাহেব,
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
মুজিবর রহমানের কানের দরজায় ‘শেখ সাহেব’ শব্দ যুগল হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে পড়ে। বহু বছর আগে এক স্কুল-ইন্সপেক্টর তাঁর সার্টিফিকেটে মুদ্রিত নাম দেখে তাঁকে ‘শেখ সাহেব’ বলে ঠাট্টা করেছিলেন। এতদিন পর মিথ্যে সেই পরিহাসটুকুই আবারও শোনার জন্য ভেতরে ভেতরে কে যেন লালায়িত হয়ে ওঠে। এখন মনে হয় হাফিজুরকে এবার সামনে পেলে সব দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তিনিও চিৎকার করে স্লোগান দিতে পারেন- জয় বাংলা।

আহা, আর কেউ না জানুক, হাফিজুর রহমান তো জানে- তার বাপের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এই নাম অন্ধকারে আলো ছড়ায়। এই নাম দূর আকাশে সাদা মেঘের পালকের মতো নির্ভার। নামের সাদৃশটা যতই কাকতালীয় হোক না কেন, এমন একটি নাম রাখার জন্য আজ এতদিন পরে পরলোকগত পিতা শেখ মো. আজিজুর রহমানের প্রতি নতুন করে কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে।

মানুষের নামও কি কখনো আতরদানি হয়ে যায়! সূর্যখোলা গ্রামের ধর্মীয় শিক্ষক শেখ মো. মুজিবুর রহমানের জানা ছিল না মানবিক একটি নাম এমন অনিঃশেষ সৌরভ ছড়িয়ে দিতে পারে সর্বত্র, সারা দেশে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ