ছাত্ররাজনীতির পচন: দোষ কার দায় কার
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় বুয়েটের ছাত্রছাত্রীরা ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। বুয়েট কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নিষিদ্ধ হয় ছাত্ররাজনীতি। হত্যাকাণ্ডের মামলার রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। গত ২৮ মার্চ গভীর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিসহ একদল নেতাকর্মীর বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ ও বৈঠক করার কারণে এই বন্ধ রাজনীতি আবার চালু হলো।
এই প্রবেশ ও বৈঠক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আপত্তি থাকায় পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়। সিট বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় ছাত্রলীগের পাল্টা কর্মসূচি। ইমতিয়াজ উচ্চ আদালতে রিট করলে হাইকোর্ট বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি করার ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করে দেন। ফলে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে আর কোনো আইনগত বাধা থাকল না। আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আদালত কর্তৃক স্থগিত হওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের একটা অংশ ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থানের দাবি জানিয়েছে।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক মতামত ও প্রচার চালানো হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অভিভাবকরাও তাদের মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। যারা রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত তারা ছাত্ররাজনীতির পক্ষে নানা যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে সংগঠন করার অধিকার সবার রয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে কোনো সমস্যা থাকলে তার সমাধান করতে হবে। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার যুক্তি গ্রাহ্য হতে পারে না। দেশ পরিচালনার জন্য নেতা ও নেতৃত্ব গড়ার প্রশিক্ষণ নিতে হয় ছাত্ররাজনীতি থেকে। তাদের আরও যুক্তি হচ্ছে, ছাত্ররাজনীতি আছে বলেই ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছে, স্বৈরশাসনের অবসান সম্ভব হয়েছে।
পাকিস্তান আমলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী পক্ষকে ঠেঙ্গিয়েছে মোনায়েম খানের জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন বা এনএসএফ। এই সংগঠনের শীর্ষ ক্যাডার পাচপাত্তু-জমির আলী ও খোকার কোমরে থাকত পিস্তল বা চাইনিজ কুড়াল। এরা গলায় সাপ ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াত। তবে এরা ছিল সংখ্যায় অল্প। এনএসএফ বহির্ভূত ছাত্রসমাজে নেতৃত্বের জন্য বেছে নেওয়া হতো মেধাবী, সৎ, নম্র, ভদ্র ছাত্র-ছাত্রীকে। মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্ররাজনীতির অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করে। অনেকের হাতে হাতে অস্ত্র চলে আসে। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে এক ছাত্রকে হত্যা করে কতিপয় ছাত্র। দণ্ডপ্রাপ্ত সাতজনের হত্যাকারীকে জিয়াউর রহমান মুক্তি দেন। এরপর অস্ত্রধারী ছাত্ররা খুন করার লাইসেন্স পেয়ে যান।
এখন ছাত্র নেতাদের লোভ আর ভয় লাগানোর রাজত্ব চলছে। এখন হলে হলে টর্চার সেল থাকে। থাকে অপহরণ বাণিজ্য। চাঁদা তোলা আর টেন্ডারবাজির অবাধ লাইসেন্স বহু ছাত্রনেতাকে কোটিপতি বানিয়ে দিয়েছে। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হলে হলে বোমা তৈরি হতে লাগল। অনেকে নিজের বোমায় নিজেই মরল। মরুক তারা এনএসএফের পাচপাত্তুর বা খোকার মতো। জনগণ একটুও আফসোস করবে না। ১৯৬৮ সালে সলিমুল্লাহ হলে মদ্যপ অবস্থায় পাচপাত্তুরের বুক ও তলপেট ড্যাগার দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল আরেকজন। অন্যদিকে একাত্তরের বিজয় দিবসে নারায়ণগঞ্জের পতিতালয় থেকে ধরে আনা খোকার কবর হয়নি। গুলিবিদ্ধ মৃতদেহটি রেসকোর্স ময়দানের মাঝখানে পশু-পাখির খাদ্য হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনৈতিক দলবিধি জারির মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিকে মূল রাজনৈতিক দলের আওতাভুক্ত করার পর ছাত্ররাজনীতির আসল লক্ষ্য হয় মূল দলের আজ্ঞাবহ থাকা। মূল দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনকে সমীহ করতে থাকে। এই সমীহই শাসক দলের অঙ্গ-সংঠনের ছাত্র নেতাদের প্রতি সাধারণ ছাত্রদের আতঙ্কের ম্যাসেজ। শাসক দলের অঙ্গসংঠনের ছাত্র নেতাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ন রাখতে অকর্মণ্য, রোবট ব্যক্তিদের ভিসি, প্রাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া রেওয়াজে পরিণত হলো।
ভিসি, প্রক্টর, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর সকলে দলীয় আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় এরা মেরুদণ্ডহীন, তারা নীতিনিষ্ঠ কঠোর ব্যক্তিত্বের অধিকারী নন। ছাত্র নেতাদের অবাধ প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অঢেল সম্পদ করায়াত্ত থাকায় লেখাপড়ার পরিবেশ হয়েছে কলুষিত। লেখাপড়া ও গবেষণায় সমৃদ্ধ হওয়ার বাসনা হয়েছে তিরোহিত। ১৯৭৭ সাল থেকে ছাত্র নেতা ও কর্মীদের ধ্যান-জ্ঞান সব বিনিয়োজিত হতে থাকল নিজ স্বার্থ উদ্ধার এবং মূল রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে। শ্রমবিহীন টাকার সহজ আগমনে নৈরাজ্যে ভরে গেল ছাত্ররাজনীতি। বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে নীতি-আদর্শের চেয়ে নেতা বড়। নেতা হওয়ার অহমিকা আরও বেশি বড় হয়ে প্রতিভাত হতে থাকল। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররাজনীতির বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে কলেজ বা হল কর্তৃপক্ষ থাকে নীরব ও নির্বিকার। গদি অক্ষুণ্ন রাখার এই ভূমিকাই যথাযথ। তাই সব সরকারের আমলেই সরকারের মদদপুষ্ট ছাত্রদের হাতে প্রতিপক্ষের ছাত্র খুন হয়। সরকারি দলের ছাত্ররা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব আবাসিক হলের দখলদারিত্ব সূত্রে মালিকানা স্বত্ব পেয়ে যায়। সব সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা কেন থাকে এই প্রশ্নের উত্তর সবার জানা।
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি লেগেই আছে। জাতীয় রাজনীতির অঙ্গ-সংগঠন বলেই মূল দলের ডাকা হরতাল সফল করতে বোমা বানাতে গিয়ে ছাত্রনেতার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। যাদের সন্তান কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের সর্বদা সন্তানদের দুঃসংবাদ শোনার ভয়ে দিন কাটে। তাদের ধারণা, জাতীয় রাজনীতি ছাত্ররাজনীতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। তাই বোধহয় ছাত্ররাজনীতির প্রতি সমাজে একটা অমোচনীয় অশ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ছাত্রদল বা শিবির একেবারেই নিশ্চুপ, তাদের কোনো কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান নয়, এখন বিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের দাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনেও সমবেত হতে পারছে না। অথচ বিএনপি এবং জামায়াত জোট সরকারের আমলে শুধু শিবিরের দাপটে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। কেউ একটু মাথাচাড়া দিতে চাইলে ধরে ধরে রগ কেটে দেয়া হতো। বিএনপির ছাত্রদলও তখন এত বেশি বেপরোয়া ছিল যে, আওয়ামী লীগকে ঠেঙ্গানোর জন্য বিএনপির ছাত্রদলই যথেষ্ট বলে বেগম খালেদা জিয়া একবার হুমকি দিয়েছিলেন।
আসলে স্বাধীন বা লেজুড়বৃত্তি যেভাবেই থাকুক না কেন, সরকার ও কেন্দ্রীয় নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে ছাত্র সংগঠনের ফ্যাসিজম বন্ধ হবে না। হাজার হাজার মোটরসাইকেলের সংবর্ধনায় এরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য মনে করে। এরা নামিদামি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করে, জাঁকজমকপূর্ণ ফ্ল্যাটে এদের বসবাস। আমার মেয়ে সানজানা ফারিয়াল ঐশী কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নির্বাচনে একটি প্যানেলভুক্ত প্রার্থী। শিগগিরই ভোট হবে। সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে বিগত ছয় মাস ধরে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সাবজেক্টের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠার জন্য ছয় মাস খুব বেশি সময় নয়। আমি বাধা দিইনি। অবশ্য সে আমার অনুমতিও চায়নি। শুধু অবহিত করেছে।
অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ প্রভৃতি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়েও স্টুডেন্টস ইউনিয়ন আছে। সেখানে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে যারা জয়লাভ করে তারা কর্মজীবনেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানীত হয়। তাদের কোনো ছাত্র কর্মজীবনে বিশ্ব পর্যায়ে কোনো কৃতিত্ব অর্জন করলে তাকে ডেকে নিয়ে পিএইচডি দেয়া হয়। বেনজির ভুট্টো প্রথম এশীয় নারী, যিনি ১৯৭৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিয়ন ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন। শুধু ব্রিটিশ নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিখ্যাত বিখ্যাত লোকজনের পদচারণা ছিল এই ক্লাবে। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে যাদের উচ্চাভিলাষ রয়েছে, তাদের এই ক্লাবে যোগ দেয়া সমীচীন বলে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বুয়েটে শুধু আবরার হত্যা হয়নি, ছাত্রদলের দুগ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ২০০২ সালে নিহত হন সাবেকুন নাহার সনি। এ সংঘর্ষ ছিল টেন্ডার দখল নিয়ে। ২০১৩ সালে ধর্মীয় উগ্রপন্থি এক ধর্মীয় ছাত্রের হাতে ছুরিকাঘাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দীপ। বিভিন্ন অপরাধে ছাত্র নেতাদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হতে থাকায় ছাত্ররাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। অনেকে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করছে না, ছাত্ররাজনীতি বন্ধেরও দাবি তুলছে, অনেকে সংস্কারের আবশ্যকতার কথা জানাচ্ছে। তাই প্রথমে মূল রাজনৈতিক দলের পরিশুদ্ধ হওয়া আবশ্যক। মূল রাজনৈতিক দলের নেতারা শুদ্ধ হলে ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হওয়ার সুযোগই থাকবে না। কলুষমুক্ত ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠিত না হলে ছাত্ররাজনীতির পচন ঠেকানো সম্ভব হবে না।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে