বাংলাদেশে অনুসৃত গণতন্ত্রের স্বরূপ
বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলেও সকল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনুসৃত রীতি-পদ্ধতি এক নয়। তবে রীতি-পদ্ধতি ভিন্ন হলেও জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে সরকার গঠনই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্রের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর কথা থাকলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দেশের উন্নয়নের সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়; কিন্তু স্বৈরশাসকের আমলেও প্রভূত উন্নয়ন হয়। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলিম দেশে গণতন্ত্র নেই, জবাবদিহি নেই, নাগরিকদের বাক স্বাধীনতাও নেই; কিন্তু উন্নয়ন আছে। তাই শুধু উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্রের বিচার করা ঠিক নয়। ফ্যাসিজম বিবেচনায় বাংলাদেশে অনুসৃত গণতন্ত্র আর মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই।
আমাদের দেশে প্রচলিত গণতন্ত্র নিয়ে জনগণ ত্যক্ত-বিরক্ত, দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলেই দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়, বিরোধী দলকে দমাতে নানা আইনকানুন আর কলাকৌশল অবলম্বন করা হয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজা-বাদশাহর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কথা বলা না গেলেও বাংলাদেশে কিছুটা বলা যায়। রাজা-বাদশাহর বিরুদ্ধে কথা বললে সাংবাদিক খাসোগীর মতো করাত দিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়, আর বাংলাদেশে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে কথা বললে গুম করা হয়, আয়নাঘরে নেয়া হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়, তাদের রক্ষায় ইনডেমনিটি আইন হয়, নতুবা ভয়ানক মব লিঞ্চিংয়ের মুখোমুখি হতে হয়।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এই দেশের জনগণ কখনো দেখেনি। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও বারবার সামরিক শাসন জারি হয়েছে, সামরিক শাসকরা রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, সামরিক শাসকদের তত্ত্বাবধানে গঠিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জয়লাভও করেছে। শুধু জয়লাভ নয়, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংবিধান সংশোধনের অধিকারও অর্জন করেছে। সবই হয়েছে গণতন্ত্রের নিয়মকানুন মেনে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিজের স্বার্থে বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিলেন; এই পদ্ধতিতে জনগণ নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিডি (বেসিক ডেমোক্রেসি) মেম্বারদের ভোটে তিনি ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিশাল জনগোষ্ঠীকে কেনার চেয়ে স্বল্পসংখ্যক বিডি মেম্বার বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ক্রয় করা ছিল সহজ; কিন্তু শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন হয়। বাংলাদেশেও জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন হয়েছে, বিরোধী দল ব্যতিরেকে সংসদ বসেছে, সেই সংসদে স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার স্বস্তি বোধও করেছেন। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরও পরাজিত দল সংসদে যায়নি। বিরোধী দল ব্যতিরেকে সংসদ ছিল নীরব, নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, কোলাহল মুক্ত। বিরোধী দলের অসহযোগিতায় ক্ষমতাসীন দল স্বেচ্ছাচারি হয়েছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো তাগিদ অনুভব করেনি।
বাংলাদেশে বিগত ৫৩ বছরে সংসদে নিবর্তনমূলক আইন পাস করতে কোনো দলীয় সরকারের কখনো বেগ পেতে হয়নি। বাক-স্বাধীনতা রুদ্ধ করার জন্য বা বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সব সরকারই গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন মেনে নিবর্তনমূলক আইন করেছে। যে গণতন্ত্রে সরকারদলীয় সাংসদের ইচ্ছায় ভালো-মন্দ সব আইনসম্মত করা সম্ভব, সেই গণতন্ত্রের জন্য আমরা আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই, চাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বাংলাদেশে সবাই শুধু নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার ব্যাপারে সোচ্চার; কিন্তু নির্বাচিত সরকারকে গণতান্ত্রিক আচরণে বাধ্য করার আইন প্রণয়নে উদাসীন। জনবিরোধী আইন করে গণবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের শুধু একদিনের গণতন্ত্র উপভোগ করার সুযোগ হয়। এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে পাঁচ বছরে মেয়াদে বাংলাদেশের জনগণ শুধু নির্বাচনের একদিন গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে, বাকি ১৮২৪ দিন ফ্যাসিজমের কবলে থাকবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় সিম্পল মেজরিটি অর্থাৎ অর্ধেকের চেয়ে একজন প্রতিনিধি বেশি হলেই সরকার গঠন করা সম্ভব। কোনো আসনে পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে পরাজিত চারজন প্রার্থীর প্রাপ্ত মোট ভোট বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে বেশি হলেও বিজয়ী প্রার্থী সবার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে যায়। শুধু সাংসদ নয়, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলও কখনো দেশের ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশ শাসন করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ভোটের চিত্র হচ্ছে, ১৯৯১ সনে ৩০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপি, ১৯৯৬ সনে ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আবার ১৯৯১ সনে বিএনপি ৩০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় ১৪০, অন্যদিকে ৩০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ পায় মাত্র ৮৮টি। এই অসঙ্গতি আরও স্পষ্ট হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনে; আওয়ামী লীগ ৪৯ দশমিক শূন্য শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় ২৩০টি, আর বিএনপি ৩৩ দশমিক ২০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৩০টি।
এই অসঙ্গতি দূর করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনি ব্যবস্থা উপযোগী। এই ব্যবস্থায় বিজয়ী এবং পরাজিত সব প্রার্থীর প্রতিনিধিত্ব থাকে। এই ব্যবস্থায় প্রাপ্ত ভোটের সমানুপাতিক হারে নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সংসদের আসন বণ্টন হলে ভোটদাতার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। তবে এই পদ্ধতির মাধ্যমে একক দলীয় সরকার গঠন হওয়ার সম্ভাবনা কম, দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টন হবে বিধায় কোন দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই বড় দলগুলো প্রাপ্ত ভোটের সমানুপাতিক হারে আসন বণ্টন চায় না। শুধু দল নয়, সাংসদরাও এই পদ্ধতির বিপক্ষে, কারণ এই পদ্ধতিতে কোন প্রার্থী থাকবে না, দলীয় প্রতীকে ভোট হবে এবং প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে দলের সাংসদ সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে। সাংসদদের এলাকা নির্দিষ্ট না থাকায় তারা এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।
নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন গণতন্ত্রের অন্বেষণ করার আগ্রহ কারও নেই। তবে বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কিছু সংস্কার অপরিহার্য। আইয়ুব খানের বিডি মেম্বারদের মতো বেচাকেনা বন্ধ করতে সম্ভবত সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের কারণে কোন সাংসদ দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। বেচাকেনার সম্ভাবনা থাকলেও এই ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের উচ্ছেদ দরকার। বর্তমানে হাত তুলে মুখে চিৎকার করে সাংসদরা প্রকাশ্যে ভোট দিয়ে থাকেন, এই রীতি বাতিল করে কণ্ঠ ভোটের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে সংসদে কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের চর্চা হয়। প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার যে স্লোগান উঠেছে, তা অনর্থক। প্রেসিডেন্ট বিজয়ী দলের মনোনীত, তাই ক্ষমতার বণ্টন হলেও ভারসাম্য অবণ্টিত থেকে যাবে। দলীয় প্রেসিডেন্ট নিরপেক্ষ হতে চাইলে তাকে প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ভাগ্য বরণ করতে হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট একটি আলঙ্কারিক পদ, প্রেসিডেন্ট জাতির ঐক্যের প্রতীক, সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক না থাকাই উত্তম।
বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি সংস্কার খুব জরুরি এবং তা হচ্ছে পুরো মেয়াদে নির্বাচিত সরকারকে গুড গভর্ন্যাস বা সুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাখা। শুধু সুশাসনের চর্চা না থাকায় আইয়ুব খানের মতো এই ভূখণ্ডে গণঅভ্যুত্থানে জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে; কিন্তু কোনো দলের বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিহিংসা হিটলারের চেয়েও ভয়াবহ। প্রতিহিংসা ও নিপীড়নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে দলীয় সরকার ক্ষমতা ছাড়তে চায় না, ক্ষমতা রক্ষায় হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট। রাজনৈতিক দল ও দলীয় সরকার যাতে কোনোভাবেই স্বেচ্ছাচারি হতে না পারে, সে লক্ষ্যেও সংবিধানে প্রয়োজনীয় অনুচ্ছেদের সংযোজন জরুরি। অবশ্য সংবিধানের গুরুত্ব আদৌ রয়েছে কি না, তাও বিবেচনার বিষয়।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক,বাংলাদেশ ব্যাংক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে