৩২ নম্বরের বাড়ি, এক্সক্যাভেটর এবং বৃহস্পতিবার সকাল
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ৮টা। রাজধানীর মিরপুর সড়কের রাসেল স্কোয়ার মোড়। অন্য যে কোনো দিনের মতো স্বাভাবিক। কিছু রিকশা অপেক্ষমাণ। লোকজনের স্বাভাবিক চলাফেরা। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে প্রবেশ করলে হাতের বাঁয়ে লেকের পাড়ে খোলা জায়গায় বেশ কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি পার্ক করা। দু-একটা গণমাধ্যমের স্টিকার লাগানো গাড়িও চোখে পড়লো। কোনো আইনশৃঙ্খলা বা সেনাবাহিনীর সদস্যকে দেখা গেল না। তাতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলো, আগের রাতে এখানে কিছুই হয়নি বা এখনো হচ্ছে না।
৩২ নম্বরের রাস্তা ধরে একটু পশ্চিমে এগোলেই চোখে পড়ে মানুষের ভিড়। রাস্তার দুপাশের ফুটপাতে অসংখ্য মানুষ। অনেকেই উত্তর দিকে মোবাইল ফোন তাক করে আছেন। কেউ কেউ সেলফি তুলছেন। কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ করছেন। আরেকটু কাছে যেতে এক্সক্যাভেটরে দালান ভাঙার শব্দ। ভবন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলো উড়ছে। কিছু কাঠ জ্বলছে। ফলে ধুলো আর ধোঁয়ায় একাকার। ভবনটিকে ঘিরে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-তরুণসহ নানা বয়সী মানুষ। তাদের অনেকের পোশাক আর জুতার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তারা এসেছিলেন ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে। কৌতূহলবশত এখানে এসেছেন দেখতে যে, কীভাবে একটি ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
KOBELCO লেখা নীল রঙের এক্সক্যাটরের চালক একজন যুবক। বেশ দক্ষতার সঙ্গে এক্সক্যাভেটর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভবনটি ভাঙছেন। আর ভবনের গুঁড়ো হয়ে যাওয়া অংশগুলো ছাকনির মতো তুলে অন্য জায়গায় ফেলছেন। দোতলা এই বাড়িটি যখন বিপুল উৎসাহে ভাঙা হচ্ছিল, তখনো ওপরের তলায় একাধিক লোক রড ধরে টানছিলেন। দু-একজন ওপর থেকে কাঠ ফেলছিলেন নিচে জ্বলতে থাকা আগুনের ওপর—তাতে আগুন আরও দীর্ঘায়িত হতে থাকে।
সকাল ৮টা ৪০ মিনিট। ভবনের পূর্বদিকে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট নারিকেল গাছটির ওপর এক্সক্যাভেটরের দণ্ডটি আঘাত হানে। অব্যাহত আঘাত করতে থাকে, তাতে মনে হলো এক্সক্যাভেটর চালক গাছটিকেও ভাঙতে চান। কয়েকবারের ধাক্কায় গাছ থেকে দুয়েকটি কচি ডাব সম্ভবত পড়ে যায়। তাতে পাশের ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে ভাঙনের দৃশ্য দেখতে আসা উৎসুক মানুষ দৌড়ে যান। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে কেউ কেউ বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করছিলেন, গাছটাও ভেঙে ফেলবে? কেননা তাদের হয়তো এটা কল্পনাতেও ছিল না যে, এরকম একটি বড় নারিকেল গাছও ভেঙে ফেলা হবে।
এই গাছটির বয়স কত? একটি নারিকেল গাছের পরিপক্ব হতে কত বছর লাগে? তাছাড়া গাছের মালিক যিনিই হোন না কেন, খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ গাছ কাটে না বা কাটা উচিত নয়- সেই সাধারণ জ্ঞানটুকু সবার থাকে; কিন্তু না। মানুষের সেই সাধারণ জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান এবং ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে এক্সক্যাভেটর দিয়ে সত্যি সত্যিই বিশাল নারিকেল গাছটি ভেঙে ফেলা হলো। গাছটি যখন ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে হেলে পড়লো, তখন সেখান থেকে মানুষের দৌড়ে নিরাপদে সরে গেলেন এবং গাছটি ধপাস করে পড়ে যাওয়ার পরে তারা আবার দৌড়ে গাছের কাছে গেলেন। হয়তো ভেবেছিলেন কিছু ডাব বা নারিকেল পাওয়া যায় কি না!
কেন এই গাছটিও ভাঙা হলো? সম্ভবত এ কারণে যে, যেহেতু ভবনটি ভাঙা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে সরকার যদি এখানে অন্য কোনো ভবন বানাতে চায়, তাহলে এই গাছটি যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। অথবা হতে পারে এমন যে, যে কারণে বা যাদের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলতে বাড়িটা ভাঙা হলো, তাদের কোনো কিছুই রাখা হবে না।
বাড়িটা কেন ভাঙা হলো এবং কারা থাকতেন এখানে?
বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বাড়িতে থাকতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বাড়িতে সপরিবারে নিহত হন তিনি। ১৯৮১ সালে তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরে তার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। ট্রাস্টই বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। নাম দেয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।’ বাড়িটি যে সড়কে, আগে এর নম্বর ছিল ৩২। নতুন নম্বর ১১; কিন্তু সড়কের আগের ৩২ নম্বর নামেই বাড়িটি পরিচিতি।
১৯৬১ সালের পয়লা অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১-এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন- নানা চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী এই বাড়ি। এই বাড়িতে বসে বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এখান থেকেই তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরুর পরে বঙ্গবন্ধুকে এই বাড়ি থেকেই ধরে নিয়ে যায়।
বাড়িটি কেন ভাঙা হলো? কারণ প্রতিশোধ। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় ছিলেন এবং মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভর করে চেয়ার আঁকড়ে থেকেছেন। দলের নেতাকর্মীদের অবাধে লুটপাটের সুযোগ দিয়েছেন। এরকম অনেক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সেই ক্ষোভের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত বছরের জুলাই মাসে। ছাত্রদের একটি অংশ আন্দোলন শুরু করে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে- যা ধীরে ধীরে নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হয় এবং ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে তার পতন হয়। তিনি পালিয়ে যান ভারতে।
ওইদিনই প্রথমবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটা ভাঙা হয়েছিল। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেদিন সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর সব ভাস্কর্যও ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সারা দেশ থেকে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের লোকজনের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়। শুরু হয় শেখ হাসিনা ও তার দলের শীর্ষ নেতাদের বিচারের প্রক্রিয়া- যা এখনো চলমান।
কিন্তু সেই বিচারিক প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই কেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটা ভাঙা হলো? ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাতে দ্বিতীয় দফায় যখন এই বাড়িতে আক্রমণ হলো, সেই রাতে দিল্লিতে বসে বাংলাদেশের ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনার। ফলে আগে থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং আরও একাধিক জায়গা থেকে গণমাধ্যমকে হুঁশিয়ার করা হচ্ছিল যাতে কেউ ওই ভাষণ প্রচার না করে বা এই খবর প্রকাশ ও প্রচার না করে। সেইসঙ্গে শেখ হাসিনার ওই ভাষণের প্রতিবাদে ৩২ নম্বর অভিমুখে বুলডোচার কর্মসূচি দেয়া হয় এবং বাড়িটা পুনরায় ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
সরকার কেন চুপ?
অনেকেরই ধারণা ছিল, যেহেতু ৫ আগস্ট দেশে কোনো সরকার ছিল না, ফলে সেদিন এই বাড়িটা রক্ষা করা যায়নি; কিন্তু এরপরে ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যেহেতু একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে এবং তারা প্রায় ৬ মাস ধরে ক্ষমতায় আছে; যেহেতু বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মাঠে আছে, পুলিশও আছে এবং শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে পুলিশের প্রতিটি স্তরে বিপুল পরিবর্তন আনা হয়েছে- ফলে ৩২ নম্বরের বাড়িটায় দ্বিতীয় দফায় হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার ঘটনাটি সরকারই হয়তো প্রতিহত করবে। কিন্তু না। রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী প্রতিহত করেনি। বরং গণমাধ্যমের খবর বলছে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের মুখে মিরপুর রোডে শতাধিক পুলিশের একটি দল দেখা গেলেও ভাঙচুরের সময় তারা বাড়িটির দিকে এগোয়নি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম বলেন, এ ধরনের কোনো কর্মসূচি বিষয়ে তাদের জানা ছিল না। (ডেইলি স্টার অনলাইন, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
এই কর্মূচির খবর সারা দেশের মানুষ জানে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দিনভর এ নিয়ে ক্যাম্পেইন হয়েছে। অথচ পুলিশ জানে না! সেনাবাহিনী গিয়েছিল ঘটনাস্থলে; কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, উত্তেজিত লোকজন তাদেরকে লক্ষ্য করে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দিচ্ছে এবং এক পর্যায়ে তারা ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। বুধবার রাতভর বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। এরপর শুরু হয় এক্সক্যাভেটর দিয়ে চূড়ান্তভাবে বাড়িটা মাটিয়ে মিশিয়ে দেয়ার কাজ।
প্রশ্ন হলো, একটি স্বাধীন দেশে যখন একটি সরকার আছে- সেখানে একটি ঐতিহাসসিক ভবন চাইলেই কিছু উন্মত্ত লোক ভেঙে ফেলতে পারে কি না? সেই বাড়িটার মালিক যেই হোন কিংবা তার উত্তরসূরিদের অপরাধ যতই হোক, এরকম একটি ভবন ভেঙে ফেলার ঘটনায় রাষ্ট্র কেন নির্লিপ্ত থাকবে?
শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতারা যেসব অপরাধ করেছেন, তার বিচার নিশ্চয়ই হবে। বিচার করার জন্য আদালত আছে। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছিল, সেই ট্রাইব্যুনালেই তাদের বিচার হচ্ছে। সুতরাং সেই বিচারের জন্য অপেক্ষা করাই বরং কাম্য; কিন্তু উন্মত্ত জনতা যা চাইবে, যেভাবে চাইবে সেভাবে যদি দেশ চলতে থাকে, তাহলে আর সেখানে সরকার বা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও সামরিক বাহিনীর কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে না।
পরিশেষে…
বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৯টা। ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙার এই যজ্ঞ চলছিল। হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডি লেকের ওপারে, অর্থাৎ যেখান থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িটা দেখা যায়- সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। স্বাস্থ্য সচেতন লোকজন হাঁটছে। কথা বলছে। লেকের এ পাড় থেকে তারা দেখছে একটি নীল রঙের এক্সক্যাভেটর অনবরত শব্দ করে একটি ইতিহাস গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এক্সক্যাভেটরের শব্দের ভেতর থেকে কিছুক্ষণ পরপর ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগানও ভেসে আসছে। সুতরাং, এই ভবন ভাঙার মধ্য দিয়ে শুধু একটি ইতিহাস গুঁড়িয়ে দেয়া নয়, বরং একটি নতুন ইতিহাস কিংবা ইতিহাসের নতুন বয়ান তৈরি করাই হয়তো উদ্দেশ্য; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের শিক্ষা তো এটিই যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।…
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে