বৈশ্বিক সমৃদ্ধির প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে আইএমইসি
অর্থনৈতিক করিডোরগুলোর অনেক ধরণের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বাণিজ্য বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নায়ন। এর সঙ্গে তারা গ্রামীণ এলাকায় উন্নায়নে অবদান রাখতে পারে, আঞ্চলিক ভারসাম্য আনতে পারে। এই করিডোর যতগুলো পথ অতিক্রম করে যাবে তার আশেপাশে সবখানেই সামগ্রিকভাবে প্রভাব পড়বে, আর্থৎ সামাজিক অগ্রগতি বাড়াবে। এই ধরণের করিডোর প্রতিষ্ঠিত হলে পণ্য-প্রবাহের নতুন পথ সৃষ্টি হয়, যার ফলে অঞ্চলগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
অর্থনৈতিক করিডোর ‘আইএমইসি’ ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক বিনিময়ের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাতে প্রস্তুত। প্রাথমিকভাবে এর লক্ষ্য হচ্ছে একটি মাল্টি-মডেল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সমুদ্র ও রেলপথকে একই কাতারে নিয়ে আসা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে হাইড্রোজেন পাইপলাইন ও হাই-টেক আইটির মতো আরো উদ্ভাবনী অবকাঠামো। আইএমইসির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বাণিজ্য সুযোগ নাটকীয়ভাবে বাড়ার সম্ভাবনা। সুয়েজ খালের তুলনায় আরো উন্নত পরিবহন পথের মধ্য দিয়ে আইএমইসি ৪০ শতাংশ কম সময়ে পণ্য আনা-নেয়া করতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পণ্য-পরিবহনে সময় বাঁচলে খরচও কম পড়বে, তাই এটা শুধু যে বাণিজ্য-ব্যয় সাশ্রয়ী করে তুলবে তা না, বরং বাণিজ্য-সম্প্রসারণে পুরো পরিবেশটাকেই অনুকূল দিকে নিয়ে যাবে।
বৈশ্বিক বাণিজ্য-পরিসরে আইএমইসি এক নতুন দিগন্তের ইশারা, বিশ্ববাণিজ্যের সংজ্ঞাকেই এ বদলে দিবে। এর সঙ্গে যারা যুক্ত তারা আর আগের মতো থাকবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একে ‘খেলা পরিবর্তন করার বিনিয়োগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটাকে তিনি ‘সত্যিই একটা বড় ব্যাপার’ বলে মনে করেন। এটি শুধুমাত্র যে নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোকেই সরাসরি স্পর্শ করবে তা নয়, বরং এর বিশাল প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিকভাবে। আইএমইসির সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এমন একটি রূপরেখা প্রকাশ করেছে যে এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত রেলপথ ও পরিবহন নেটওয়ার্ক একটি ‘নির্ভরযোগ্য ও ব্যয়-সংকোচন আন্তঃসীমান্ত জাহাজ থেকে রেলপথ পরিবহন নেটওয়াক’ গড়ে তুলবে। এই উন্নয়ন বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতিশীলতার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে প্রত্যাশা করা যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লায়েন বলেছেন, নির্দিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে ভ্রমণ-সময় ৪০ শতাশং কমিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে এই কড়িডোরের। এটিকে তিনি ‘ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে দ্রুততম সংযোগ’ পথ হিসেবে প্রচার করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, এর ফলে অন্যান্য বাণিজ্যব্যয় এমনিতেই কমে আসবে। ফলস্বরূপ এটি সমৃদ্ধির পথে বিরাট প্রভাব ফেলবে।
করিডোরের প্রভাব পড়বে বাণিজ্য-সুবিধার বাইরেও। অংশগ্রহণকারী অঞ্চলগুলোতে এটি শিল্প-কারখানা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কাঁচামাল এবং তৈরিকৃত পণ্য পরিবহনের জন্য উন্নত যোগযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আইএমইসি ব্যবাসায়িক কার্যকলাপকে আরো উৎসাহিত করতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অঞ্চগুলোতে কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে, উৎপাদন বাড়লে শিল্প-কারখানাও বাড়বে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই কর্মসংস্থান বাড়বে। অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় পরিবহন ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, এতেই বোঝা যায় যে, কর্মসংস্থান এবং শিল্পকারখানা উন্নতির ওপর আইএমইসির প্রভাব ভালোভাবেই পড়বে।
তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ নিরাপত্তা ও পরিবেশগত স্থায়িত্ব রক্ষায়ও আইএমইসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল-রপ্তানিকারক দেশগুলো ভারত ও ইউরোপের জন্য আরো সহজলভ্য হবে, পাশাপাশি হাইড্রোজেন পাইপলাইনগুলোর মতো পরিষ্কার শক্তি পরিবহনের ওপর জোর দিলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনও কমাতে পারবে, যা এখন এক বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। আইএমইসি’র অধীনে বন্দর ও অন্যান্য অবকাঠামোর কৌশলগত উন্নয়ন বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে, অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এর সঙ্গে আরো যোগ করা যায় যে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর বিকল্প প্রস্তাব দেয়ার মাধ্যমে আইএমইসি বিশ্ব বাণিজ্যের গতিশীলতাকে এক নতুন আকার দেয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করেছে। ঐতিহ্যগত সামুদ্রিক পথের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এই করিডোর একটি দ্রুতগামি নতুন পথের দিশা উন্মোচন করবে। তাছাড়া, অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে এই কড়িডোর একটি সংস্কৃতিক সম্মিলন সৃষ্টি করবে, কয়েকটি সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংযোগ ঘটবে এই পথের মধ্য দিয়ে, আঞ্চলিক মিলনের মধ্য দিয়ে শান্তি বাড়বে, তাই এটিকে একটি রূপান্তরমূলক উদ্যোগ বললে ভুল হবে না। নানা দিক থেকেই এর প্রভাব পড়বে সুদূরপ্রসারী।
আইএমইসি মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলো বিশেষ করে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের দেশগুলো (জিসিসিএস) প্রতি ভারতের এক কৌশলগত পুনর্গঠনের প্রমাণ, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে গতি পেয়েছে। তেল বাণিজ্য আর কিছু খুঁচরা পণ্য প্রবেশের সহজ সম্পর্ক থেকে তা এখন নিরাপত্তা সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন এবং প্রযুক্তিগত লেনদেনের বহুবিধ সুযোগ-সুবিধায় সম্প্রসারিত হচ্ছে।
একমেরু বা দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তে আইএমইসি বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনা প্রকাশ করে, যেখানে কোনো একক রাষ্ট্র নয়, বরং বহু রাষ্ট্র মিলিয়েই ক্ষমতা ভাগাভাগী করবে, ক্ষমতা ভাগাভাগী হবে এখানে সহযোগিতার ভিত্তিতে। এই প্রেক্ষিতে আইএমইসি এখানে কাজ করবে এই মেরুগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে। সবাই যার যার অর্থনীতি, সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রেখেই এখানে একসাথে কাজ করবে। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জটিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক সহজ হয়ে যাচ্ছে। ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বাড়ছে। বৈশ্বিক ভারসাম্য ও স্থিতিস্থাপকতা প্রতিষ্ঠায়ও এই কড়িডোর অবদান রাখছে।
যাই হোক, আইএমইসি’র সফলতা নির্ভর করে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিরতার ওপর। সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও কৌশলগত গুরুত্ব সত্ত্বেও এই অঞ্চলটি দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আর সংঘাতে জর্জরিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা শুধু আঞ্চলিক মাথাব্যথা না, বরং একটি বৈশ্বিক প্রয়োজনীয়তা। নিরাপদ বাণিজ্য পথ, নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সম্পদ আর জ্ঞান ও মানুষের অবাধ বিনিময়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীল অবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য আইএমইসি একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই অঞ্চলের শান্তি সারা বিশ্বেই প্রভাব ফেলবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখবে। জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র বিমোচন, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এই করিডোর নতুন দুয়ার খুলে দিবে।
লেখক: বিবেক দেবরয় ভারতেরর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত, গবেষণা, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আদিত্য সিন্হা উক্ত পরিষদের অফিসার।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে