রাত দখল কর্মসূচি
যে আন্দোলন মমতার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে
গত ১৪ আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতার ঠিক আগের মুহূর্তে কলকাতা যেভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তা প্রৌঢ় বয়সেও কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। ডাক ছিল, ‘রাত দখল’ কর মেয়েরা। তা যে এভাবে ঝড় হয়ে আছড়ে পড়বে, শুধু কলকাতা নয়, সারা ভারতের অলিগলি, চেনা-অচেনা শহর, মফস্বলে, তা কল্পনা করিনি। আমি যেখানে থাকি, তার কাছাকাছি এক সমাবেশে হাজির হবার পর পরই জনপ্লাবণ ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমার পায়ের ব্যথায় কাবু স্ত্রী ও তার এক বন্ধু সামনে এগিয়ে গেল। আজ তো অর্ধেক আকাশের আহ্বান। ফলে তারাই সামনের সারিতে।
পেছনে থেকে দেখছিলাম, কত কত মহিলা, ছোট ছোট শিশুকে নিয়েও এসেছেন কয়েক দিন আগে কলকাতার প্রাচীন হসপিটাল, আর জি করের ভেতরে ডাক্তার তরুণীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। ভারতের ইতিহাসে এভাবে ডাক্তার মেয়েকে তার কর্মক্ষেত্র, হসপিটাল প্রেমিসেসের ভেতরেই ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা প্রথম। হতে পারে তার জন্যই এর অভিঘাত এমন তীব্র। ফলে সারা দেশে আওয়াজ উঠল, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। আমরা ন্যায় বিচার চাই।
এখন পর্যন্ত যেটুকু যা খবর, তার ভিত্তিতে এটা বলাই যায়, মেধাবী মেয়েটির ওপরে চরম অত্যাচার ও শেষ অবধি খুন নিঃসন্দেহে, আইনি পরিভাষায়, রেয়ারেস্ট অব দ্য রেয়ারেস্ট ঘটনা। প্রশ্ন উঠছে, এর পেছনে কি শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের কোনো হাত আছে! এভাবে বলা বা প্রশ্ন তোলা হয়তো ঠিক নয়। তবে গোটা বিষয়টিকে পুলিশ, প্রশাসন যেভাবে আড়াল করতে চাইছেন তাতে কোনো না কোন শক্তিশালী চক্র যে মেয়েটির হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে, তা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।
মেয়েটির মা এক টিভি ইন্টারভিউয়ে পরিষ্কার বলেছেন যে, হসপিটালের সহকারী সুপারের ফোন পেয়ে তিনি ও মেয়েটির বাবা সেখানে গেলে পুলিশ তাদের সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে। অনেক অনুনয়-বিনয় করার পরেও তাদের মেয়ের ডেডবডি দেখতেও দেওয়া হয়নি। এমনকি হসপিটাল ও পুলিশ প্রথম দিকে বলার চেষ্টা করেছিল যে, মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। চাপের মুখে তারা স্বীকার করে যে, মেয়েটিকে নৃশংসভাবে রেপ করে খুন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত একজন সিভিক ভলেন্টিয়ার্সকে গ্রেপ্তার করা হলেও সে যে বলির পাঁঠামাত্র, তা নিয়ে সাধারণের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
শোনা যাচ্ছে, হসপিটালের ভেতরে প্রভাবশালীদের মদতে নানা ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম চলত। মধুচক্র অবধি বসত। ডাক্তার মেয়েটি বিষয়গুলো জেনে যায় এবং বলে, সে সোশ্যাল মিডিয়ায় সব ফাঁস করে দেবে। এই সৎ সাহসের মাশুল তাকে গুনতে হলো জীবন দিয়ে। এর দায় কোনোভাবেই রাজ্যের তৃণমূল সরকার অস্বীকার করতে পারে না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি পপুলারিস্ট। জন মোহিনী। ভোট ব্যাংকের স্বার্থে তিনি একাধিক সামাজিক প্রকল্প চালিয়ে নিজের জনভিত্তি মজবুত করেন; কিন্তু স্থায়ীভাবে রাজ্যের অর্থনীতি শক্তিশালী করার চেষ্টা সেভাবে করেননি। পাশাপাশি বিপুল বেকারদের হাতে রাখতে ক্লাবে ক্লাবে পূজার নামে মোটা টাকা অনুদান দেন। সেই টাকায় অধিকাংশ ক্লাবে সন্ধ্যা নামতেই বসে মদ ও জুয়ার আসর। এভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এক লুম্পেনাইজেশন। লুম্পেন সংস্কৃতির প্রভাব ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র, হসপিটাল তার বাইরে নয়। দুর্নীতি, বিপুল বেআইনি অর্থ রোজগার এবং ভোগের চাহিদা সামাজিক অস্থিরতা আনছে। এটা শুধু কলকাতায় নয়।
সারা রাজ্যে নারী পাচার নিত্যদিনের ঘটনা। চা বাগান ও অন্যান্য একাধিক শিল্প নিভু নিভু অবস্থায়। অভাবে সেসব এলাকায় মৃতপ্রায় অবস্থায় ধুঁকছে। পুলিশ প্রশাসনের দলীয়করণ হয়ে গেছে বহুদিন। মুখ্যমন্ত্রীর বিরাগভাজন হলে রক্ষা নেই। গণতন্ত্র নামেই। ফলে এই অবস্থায় আর জি কর হসপিটালের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনাও বিরল নয়। কটা আর সামনে আসে! আদিবাসী, সংখ্যালঘু বা নিম্নবর্গের মেয়ে হলে আমরা অতটা সোচ্চার হই না। হতে পারে, তার কারণ, সেই মেয়েরা আমাদের চেনাজানা সমাজের নয়। এ তো আমাদের ঘরের। চেনা সমাজের।
সৌমিত্র দস্তিদার: ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে