বান্দরবানে ভয়ংকর রোমাঞ্চকর দেবতাখুমের পথে পথে রহস্যের হাতছানি
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানের ভয়ংকর রোমাঞ্চকর পর্যটনকেন্দ্র দেবতাখুম। সুনসান নীরবতা, পাখির কলরব, সান বাঁধানো পাথরের সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে স্বচ্ছ জলধারা, খালের পানির স্রোতে পাথরে তৈরি হওয়া নানা নকশা আর খাঁজ দেবতাখুমের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে আরও কয়েকগুণ।
রোয়াংছড়ি উপজেলার দেবতাখুমের পথে পথে যেন সব রহস্যের হাতছানি।
পাহাড়ের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় গত বছরের এপ্রিল থেকে জেলার তিনটি উপজেলা রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচিতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্থানীয় দর্শনার্থীরা ভ্রমণ করতে পারলেও নিরাপত্তা বিবেচনায় দেবতাখুমের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছেন না পর্যটকরা। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় চলতি বা আগামী সপ্তাহে জনপ্রিয় পর্যটনস্পটটি খুলে দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
দেবতাখুম মূলত তারাছা খালের অংশ। দুই পাশে সবুজ বাঁশগাছের পাহাড়েঘেরা এবং গভীর জলের পাথুরে এলাকা। সহজে ঘুরে আসা যায় বলেই অমিয়খুম, নাফাখুম, সাতভাইখুমসহ জেলার জলাধারগুলোর মধ্যে দেবতাখুম সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, দুই পাশের সুউচ্চ পাথুরে পাহাড়ের বাধায় দেবতাখুমের ভেতরে সূর্যের আলো সরাসরি পৌঁছে না। তাই যতই ভেতরে যাওয়া যায়, ততই শীতল অনুভূত হয়। ঝরনার পানির শব্দ ও কোলাহলমুক্ত শান্ত দেবতাখুমের ভেতরে বাঁশের ভেলা বা ছোট্ট নৌকা প্রবেশের মুহূর্তে দারুণ ভয়ংকর আর রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয় ভ্রমণকারীদের।
রোয়াংছড়ি উপজেলার কচ্ছপতলী বাজার থেকে ট্যুরিস্ট গাইড নিয়েই দেবতাখুমে যেতে হয়। বাজার থেকে ব্রিজের নিচে তারাছা খালের রাস্তা হয়ে হেঁটে সেখানে যেতে ঘণ্টাদেড়েক পথ পাড়ি দিতে হয়। কচ্ছপতলী সেনাক্যাম্পের পাশের নতুন রাস্তা দিয়ে গাড়িতে বা হেঁটেও দেবতাখুমের পাশের পাড়ায় পৌঁছানো যায়। এতে সময় কিছুটা কম লাগলেও সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হন খালপথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের। একেকজন গাইড দশজন পর্যটককে নেতৃত্ব দিতে পারেন জেলা প্রশাসনের নিয়মে। সেনাক্যাম্পে নিরাপত্তার স্বার্থে ভ্রমণকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধ করতে হয়।
দর্শনীয় এই পর্যটনস্পট পরিচালনায় ৫২ সদস্যের সমিতি এবং ৯৬ জন পর্যটক গাইড রয়েছেন।
নৌকাচালক অংসিং মারমা বলেন, সমিতির তত্ত্বাবধানে ভ্রমণকারী ও পর্যটকদের নৌকা ও বাঁশের ভেলা চালিয়ে দেবতাখুম ঘুরিয়ে দেখান তারা। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকার মতো পান। ভ্রমণকারী পর্যটকরাও খুশি হয়ে বখশিশ দিতেন। এটি তাদের বাড়তি আয়। তাই পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিল।
‘দীর্ঘদিন ধরে দেবতাখুমে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় পর্যটক না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। এটি খুলে দেয়া হলে বাড়তি উপার্জনে পরিবারে আবারও সচ্ছলতা ফিরবে, সেই আশায় আছি’- বলেন তিনি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রবিজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, দেবতাখুম পর্যটনস্পট ঘিরে শতাধিক পাড়াবাসীর কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। সমিতির তত্ত্বাবধানে পর্যটকদের নিরাপত্তা, গাইড সেবা, লাইফ জ্যাকেট সেবা, খাবারের ব্যবস্থা করাসহ সার্বিক সহযোগিতায় বাড়তি উপার্জন করতেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা; কিন্তু পর্যটনস্পটটি বন্ধ থাকায় দিশেহারা এবং মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন সবাই। দ্রুত সেটি খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, পর্যটনশিল্প এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। কৃষি, হস্তশিল্প, কোমরতাঁত, পরিবহনসহ সবকিছুও এর সঙ্গে জড়িত। তাই পর্যটনের উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তিনি জানান, পাহাড়ের পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটাই ভালো। সপ্তাহখানেকের মধ্যে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য দেবতাখুম খুলে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। ভ্রমণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে বন্ধ থাকা অন্য স্থানগুলোও খুলে দেয়া হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পর্যটন খুলে দিতে সম্মত আছেন।
দেবতাখুম পরিচালনা কমিটির সভাপতি নুচোমং মারমা বলেন, ‘পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার অপেক্ষায় পাড়াবাসী। খুলে দেয়ার খবরে রাস্তাঘাটসহ পুরো দেবতাখুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পাঁচটি নৌকা ও ৫০টি বাঁশের ভেলা ঠিকঠাক করছি।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে