Views Bangladesh Logo

ক্ষমতায় থাকার পুরোনো তরিকা

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

‘রাস্তা থেকে মানুষ বলে আপনারা আরও ৫ বছর থাকেন।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর এই বক্তব্যের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের বেশ মিল রয়েছে।


গত ২৯ মার্চ নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনি লিখেছিলেন: ‘প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন স্টেটসম্যানকে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে।’


এর ১২ দিন পর ১০ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ থানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রচেষ্টা বাড়ানো হয়েছে এবং আরও বাড়বে। রাস্তা থেকে মানুষ বলে যে, আপনারা আরও পাঁচ বছর থাকেন। (ডেইলি স্টার অনলাইন, ১০ এপ্রিল ২০২৫)।

দেখা যাচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং সারজিস আলম- দুজনের বক্তব্যে ‘পাঁচ বছর’ শব্দটি কমন। তারা কেন পাঁচ বছর বলছেন? বাংলাদেশে সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর বলে? এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ৮ মাস পার করেছে। তারা পাঁচ বছর বলতে কি আরও চার বছর চার মাসকে বুঝাচ্ছেন নাকি নতুন করে আরও পাঁচ বছর- তা পরিষ্কার নয়।

এখানে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসছে।

১. অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা ড. ইউনূসের সরকার কোন পদ্ধতিতে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে? একটি অনির্বাচিত সরকারের এত দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা যতটা না সাংবিধানিক প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন নৈতিকতার।

২. অতীতে যেসব রাষ্ট্রপ্রধান বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতায় এসেছেন, তারাও নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষমতাকে বৈধতা দিয়েছেন। এরপর ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যে চারটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেগুলোরও সাংবিধানিক বৈধতা ছিল বা তারা সাংবিধানিক পদ্ধতি মেনেই ক্ষমতায় বসেছিল; কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ার ফলে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়টি নিয়ে সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দেয়। অবশেষে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি বিশেষ সরকার গঠিত হয়। অর্থাৎ এই সরকার সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হলেও তাদের একধরনের সাংবিধানিক বৈধতা দেয়া হয়েছে; কিন্তু এখন যদি তারা তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায় বা সত্যিই তারা একটি নির্বাচিত সরকারের মতো পুরো মেয়াদে থাকতে চায়, সেটির বৈধতা দেয়া হবে কোন পদ্ধতিতে?

৩. সারজিস আলম যে আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন, সেই আকাঙ্ক্ষা হয়তো দেশের আরও অনেক মানুষের রয়েছে। অর্থাৎ তারাও মনে করেন যে, ড. ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ- যিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, তিনি দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে দেশ বদলে যাবে। অতএব, তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকবেন- এই প্রত্যাশা থাকা অন্যায় বা অযৌক্তিক নয়; কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ যে সত্যিই এই সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চায়, সেটি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কী করে জানলেন?


তিনি বলেছেন, রাস্তা থেকে মানুষ তাদের বলছে। সেই মানুষ কারা এবং প্রায় ২০ কোটি লোকের দেশে সেই মানুষরা কত শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করেন?
জাতীয় নাগরিক পার্টির একজন শীর্ষ নেতার যে আকাঙ্ক্ষা- সেটি যদি তার দলেরও আকাঙ্ক্ষা হয়, তারপরও তারা দেশের মোট ভোটারের কত শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করেন- সেটি পরীক্ষিত নয়। কেননা, সামগ্রিক ভোটে জাতীয় নাগরিক পার্টির হিস্যা কত- সেটি একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত এবং সর্বোপরি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া জানার কোনো সুযোগ নেই।

এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে সবশেষ তিনটি বাদ দিলেও ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে কার কত শতাংশ ভোট- তার একটি মোটামুটি হিসাব পাওয়া যায়; কিন্তু এনসিপি যেহেতু একটি নতুন দল এবং এখনো তারা কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি, ফলে এটি বোঝা যাবে না যে, কত শতাংশ মানুষ তাদের ওই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একমত। সুতরাং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ভাষায় ‘রাস্তা থেকে মানুষ তাদের বলছে’ দিয়ে সামগ্রিক চিত্র তো বটেই, মোটামুটি ধারণা পাওয়াও সম্ভব নয়। কেননা তিনি তার পেশাগত কারণে যখন যেখানে গিয়েছেন, সেসব জায়গায় যদি কিছু মানুষ স্লোগান দিয়ে কিংবা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ও এটা বলে থাকেন যে আপনারা আরও পাঁচ বছর থাকুন- সেটি ঠিক কত মানুষের আকাঙ্ক্ষা তা বোঝার উপায় নেই। তাছাড়া এই কথাগুলো কারা বলছেন, কেন বলছেন- সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। তার চেয়ে বড় কথা, গত ৮ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের যে পারফরম্যান্স, সেটি নিয়ে পাবলিক পারসেপশন বা জনধারণা কেমন- সেটি গণমাধ্যমের রিপোর্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়া নানা ঘটনা ও বক্তব্যে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়।
সরকারের অগ্রাধিকার

এই সরকারে গত ৮ মাসে কয়েকটি শব্দ খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে; যেমন সংস্কার, সংলাপ, ঐক্য, বিচার। বিভিন্ন সময়ে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কথায় এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, নির্বাচন দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দ্রুত ক্ষমতায় হস্তান্তর তাদের প্রধান অগ্রাধিকার নয়। বরং তাদের প্রায়োরিটি তালিকাটি এরকম: বিচার, সংস্কার, নির্বাচন। অর্থাৎ জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যা, গণহত্যাসহ নানা অপরাধে বিগত সরকারের শীর্ষ থেকে নিম্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে; বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে- সেই মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন করাই তাদের প্রধান এজেন্ডা।


তাদের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার সংস্কার। এ পর্যন্ত ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে এবং ৬টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে। সুতরাং এসব প্রক্রিয়া শেষ করে একটি জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। তবে কতগুলোর সুপারিশে রাজনৈতিক ঐকমত্য হবে আর কতগুলোতে হবে না- সেটি বিরাট প্রশ্ন। তার চেয়ে বড় কথা, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিটি প্রতিবেদনের সঙ্গে এত বেশি সুপারিশ রয়েছে যে, এগুলো বাস্তবায়ন করতে কয়েক বছর লেগে যাওয়ার কথা। সুতরাং বিচার ও সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেয়া যেহেতু কয়েক মাসের মধ্যে সম্ভব নয়, সে কারণেই কি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বা সরকারের কর্তা ব্যক্তি এবং তাদের অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার জাতীয় নাগরিক পার্টি মনে করছে যে তাদের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা উচিত?

বিচার ও সংস্কারের বিষয়ে দ্বিমত পোষণের লোক কম; কিন্তু সংস্কার বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছে; এই ইস্যুতে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার মধ্যে অনেক ফারাক আছে তাতে সন্দেহ নেই।


বিশেষ করে সাধারণ মানুষ সংস্কার বলতে বোঝে তার নিজের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর সমাধান আগের চেয়ে সহজ হয়েছে কি না। তার জীবন আগের চেয়ে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়েছে কি না। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবা পেতে আগে তাকে যে ধরনের হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হতো সেখানে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে কি না। যদি এসব প্রশ্নের উত্তর হয় ‘না’- তাহলে তার কাছে সংস্কার কোনো অর্থবহন করে না।

যদি তার জীবিকার সংকট তৈরি হয়; যদি তার জীবনযাপনের খরচ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়; যদি তাকে আগের মতোই সরকারি অফিসে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়; যদি তাকে রাস্তায় বের হলে আতঙ্কে থাকতে হয়; যদি তাকে যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় যে কোনো ইস্যুতে মবের শিকার হতে হয়; যদি তাকে আগের মতোই কোনো না কোনো রাজনৈতিক ট্যাগের শিকার হতে হয়- তাহলে তার কাছে সংস্কারের সুন্দর সুন্দর কথাও তেতো মনে হবে। তার কাছে তখন সংসদের উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষ; সংবিধানের মূলনীতি; সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন; দেশের সাংবিধানিক নাম- ইত্যাদি বিষয়গুলো আকর্ষণীয় মনে হবে না।

সুতরাং, গত ৮ মাসে সরকার যেখানে মব বন্ধ করতে পারেনি; শুরুর কয়েক মাস যেখানে বিভিন্ন ঘটনায় মনে হয়েছে যে সরকার নিজেই মব উসকে দিচ্ছে বা মব থামাতে চাচ্ছে না; বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা ও নিষ্ক্রিয়তায় যেখানে জনমনে নানাবিধ প্রশ্ন তৈরি হয়েছে; ব্যবসায়ীদের কথাবার্তায় যেভাবে মনে হয়েছে যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নন; শুধুমাত্র রিজার্ভ ও নিত্যপণ্যের বাজার ছাড়া অন্য কোথাও সেরকম জনসন্তুষ্টির বিষয়টি দৃশ্যমান নয়- তখন এই সরকার দীর্ঘমেয়াদে থাকুক, সেটি আসলেই কতজন বা কত শতাংশ মানুষ চায়, সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে।
সরকার কীভাবে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করবে?

ধরা যাক সত্যিই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চায়। অর্থাৎ এই সরকারে যারা আছেন তাদের ওপর মানুষের এই আস্থা ও বিশ্বাস আছে যে তারা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকলে সত্যিই দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হবে, দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়বে। জীবনযাপনের খরচ কমার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষেরও সঞ্চয় করার সুযোগ তৈরি হবে; মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ কেটে যাবে; মব ও উগ্রপন্থা বন্ধ হয়ে দেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসবে- এই বিশ্বাস যদি জনমনে থেকে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই এই সরকারের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা উচিত; কিন্তু সেটি হতে হবে সাংবিধানিক উপায়ে।

এই সরকার এবং এই সরকারের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ওপর জনগণ সত্যিই কতটা আস্থা রাখছে সেটি প্রমাণ করার বা যাচাই করার একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্বাচন। যারা এখন সরকারে আছেন, তারা সরকারে থেকে নির্বাচন করতে পারবেন না। সেটি বৈধ হবে না। অতএব, তাদের ওপর যদি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আস্থা ও ভরসা থাকে তাহলে তাদের উচিত সরকার থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনো দলে যোগদান করা। তারপর আরেকটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা। জনগণ যদি তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায় তাহলে তারা অবশ্যই পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন এবং সেটি হবে বৈধ।

জনগণ সত্যিই তাদের চায় কি না বা কত শতাংশ মানুষের সমর্থন তাদের ওপর রয়েছে- ভোট ছাড়া সেটি যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই। আর ভোট ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকাটা যেমন বৈধ ও নৈতিক নয়, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোও সেটা মানবে না। বরং এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য যদি রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্দোলনে নামতে হয় সেটি হবে অত্যন্ত বেদনার।
গণভোটের সুযোগ নেই

জাতীয় নির্বাচন ছাড়া সরকারের বৈধতা ও জনসমর্থন যাচাইয়ের আরেকটি পদ্ধতি ছিল গণভোট। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনটি গণভোট হয়েছে। প্রথম গণভোট হয় ১৯৭৭ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি মানুষের আস্থা আছে কি না- এই প্রশ্নে। দ্বিতীয় গণভোট হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকায় জনগণের সম্মতি আছে কি না- এই প্রশ্নে। আর সবশেষ গণভোট হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেয়া উচিত কি না- এই প্রশ্নে। কোনো গণভোটেই বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দেয়নি; কিন্তু সরকার কাগজে-কলমে প্রচুর ভোট দেখিয়েছে এবং সরকারগুলো ভোটে যে ফলাফল চেয়েছে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিটি গণভোট বা হ্যাঁ না ভোটের ফলাফল নিরঙ্কুশভাবে সরকারের পক্ষে গেছে।

বস্তুত এই ধরনের গণভোটের আয়োজন করা হয় সরকারের মতামতকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সেটিকে আইনি বৈধতা দেয়ার জন্য। এসব গণভোটের প্রত্যক্ষদর্শী এবং গবেষকদের লেখায়ও এটি উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তিনটি গণভোটেই জনগণের অংশগ্রহণ ছিল অতি সামান্য এবং যে পরিমাণ ভোট পড়েছে বলে দাবি করা হয় সেগুলো আসলে ভোটের দায়িত্বে থাকা সরকারি লোকজনের সৃষ্ট।

সুতরাং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি তাদের ওপর জনআস্থা যাচাইয়ের জন্য গণভোটের আয়োজন করে, সেখানেও কী পরিমাণ মানুষ ভোট দেবে এবং তার ফলাফল কী হবে- তা বলা মুশকিল; কিন্তু কিছুটা হলেও ধারণা করা যায়। তবে এখানে মুশকিল হলো, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে গণভোটের বিধান নেই। বিধানটি বাতিল করা হয়েছে। অতএব, এই সরকারের ওপর কত শতাংশ মানুষের আস্থা আছে বা তারা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে সেটি কত শতাংশ মানুষ চায়, তা যাচাইয়ের কোনো সহজ তরিকা নেই।
সরকার কি জরিপ চালাবে?

নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দল, প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী জরিপ চালিয়ে থাকে; কিন্তু সেসব জরিপের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। অনেক সময় সেসব জরিপ হয় পক্ষপাতমূলক। একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে যেহেতু জরিপগুলো চালানো হয়, ফলে তাতে সত্যিকারের জনমতের প্রতিফলন ঘটে না।

অতএব, অন্তর্বর্তী সরকারের লোকজন যদি মনে করেন যে, বিচার ও সংস্কারের জন্য তাদের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা উচিত তাহলে তাদের উচিত হবে জনগণের ম্যান্ডেট নেয়া। সে জন্য অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। যে নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ধ্বংস করাই বিগত সরকারের পতনের একটি বড় কারণ ছিল।

সুতরাং, বিগত সরকারের মতো উন্নয়নকে গণতন্ত্রের বিকল্প দাঁড় করানোর মতো এই সরকার যদি বিচার ও সংস্কারকে নির্বাচনের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা বা উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্বই শুধু বাড়াবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ