Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

নিপীড়িত মানুষের লড়াই দেখে আমার ভেতরে দ্রোহের চেতনা জাগে

Mohon Raihan

মোহন রায়হান

রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

মোহন রায়হান কবি, সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা। প্রেম-প্রকৃতি ও দ্রোহের কবি হিসেবে খ্যাত। তবে, দ্রোহের চেতনাই তার কবিতার প্রধান আগুন। তিনি জন্মেছেন ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট, সিরাজগঞ্জের খোকশা বাড়ির দিয়াড়পাঁচিল গ্রামে। মাত্র ১০ বছর বয়সে ছয়-দফার মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, নিজের অজান্তে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় সচেতন সক্রিয় যোদ্ধা। এমন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন জানা কথা। কোনো দ্বিধা ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধের একদম প্রথম দিকে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। তখন তার মাত্র ১৫ বছর বয়স। ১৯৭৫ সালে এসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, বাংলা সাহিত্যে। সঙ্গী হিসেবে পান তৎকালীন সব প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের। ছোট বয়স থেকেই কবিতা লিখতেন, এবার ঝাঁপিয়ে পড়েন সাহিত্য-আন্দোলনে। স্বাধীন-বাংলাদেশের অনেক স্মরণীয়, বৈপ্লিক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষীই শুধু তিনি নন, অনেক ক্ষেত্রে পালন করেছেন প্রধান ভূমিকা। স্বৈরাচার বিরোধী-আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে। জীবনে বহুবার জেল খেটেছেন। এক সময় দেশ রাজনীতি ও সাহিত্যজগতের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন। যোগ দেন স্বাস্থ্যসেবায়। তিনি ‘সাওল হার্ট সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। তার জীবনযাত্রা, সাহিত্যচেতনা, দেশ-রাষ্ট্র-ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল আহসানমাহফুজ সরদার

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি কেমন আছেন?
মোহন রায়হান:
বেঁচে আছি বলা যায় আর কি। সাধারণত বলতে হয় ভালো আছি। আসলে ভালো নেই।

ভিউজ বাংলাদেশ: কেন ভালো নেই আপনি?
মোহন রায়হান:
ভালো নেই কারণ মানুষ ভালো নেই। মানুষ তার দেশ-প্রকৃতি-পরিবেশের মধ্যে যে ভালো থাকা প্রত্যাশা করে, তার যদি পূরণ না হয় তাহলে কি মানুষ ভালো থাকতে পারে?

ভিউজ বাংলাদেশ: দীর্ঘ লড়াইয়ের জীবন আপনার। এত লড়াইয়ের পর যদি আপনি বলেন ভালো নেই, তাহলে তো বিষয়টা আমাদের জন্যও দুঃখের। এই পরিস্থিতিটা আসলে কেন সৃষ্টি হলো এত লড়াইয়ের পর?
মোহন রায়হান:
স্কুলজীবন থেকেই আমি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। স্কুলে পড়ার সময় স্কুলের সামনে ১৯৬৬-এর ছয় দফার মিছিল আসছে, স্কুল থেকে বেরিয়ে মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। সেরকম সচেতনভাবে নয়, মিছিলের সৌন্দর্যে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় আমি সচেতনকর্মী। মার খেয়ে আমার পিঠ ফেটে যায়। বাংলাদেশর সমস্ত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক- আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে প্রথম কাতারে ছিলাম। বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছি। ১৩ বার আমি জেলই খেটেছি। এরশাদ-আমলে আমি পাঁচবার অ্যারেস্ট হয়েছি। এরশাদের প্রথম মার্শাল-ল আনুষ্ঠানিক ব্রেক করেছি আমি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ যখন মার্শাল-ল জারি হলো, সেদিন সকালে আমিই প্রথম মধুর কেন্টিন থেকে মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিলাম। সেকেন্ড মিছিল বের করেছিলেন নূরুল কবীর।

ভিউজ বাংলাদেশ: সাংবাদিক নূরুল কবীর?
মোহন রায়হান:
হ্যাঁ, তো সে লম্বা কাহিনী। সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় বলেছি, লিখেছি, ভবিষ্যতেও হয়তো বলব। একটা আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছে আছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার এই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চেতনা কীভাবে জাগল?
মোহন রায়হান:
এটা আসলে আমার রক্তের অন্তর্গত। পরিবার থেকে পাওয়া। আমার বাবা  মৌলানা ভাসানীর কাগমারি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তারপর সুভাস বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়েছেন।  বাঙালির সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামেই তিনি জড়িত ছিলেন।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার বাবা সম্পর্কে একটু কথা বলতে চাই। আমরা জানি তিনি দীর্ঘ সময় ধরে চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রায় ৩০ বছর। আপনার জীবনে আপনার প্রভাব কীরকম?
মোহন রায়হান:
 সিরাজগঞ্জের খোকশাবাড়ি হাসপাতাল, কওমী জুট মিলস্ লি: ও শৈলাবাড়ি গ্রোইন বাঁধের প্রতিষ্ঠাতা আমার বাবা। তিনি মানবকল্যাণে নিবেদিত একজন মানুষ ছিলেন। বার কাছ থেকেই সব পাওয়া। মানুষকে ভালোবাসা। দেশ-জাতি নিয়ে ভাবা। কিন্তু পরে বাবার সাথে আমার রাজনৈতিক বিরোধিতা শুরু হয়। আমরা যারা রাজনীতি করতাম তাদের অনেকের বাবাই মুসলিম লীগ করতেন। আমার বাবাও করতেন। আর আমি শুরু থেকেই ছাত্রলীগ করতাম। তো আমার প্রথম কবিতার বই ‘জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ’ উৎসর্গ করেছিলাম আমার বাবাকে। সেখানে লিখেছিলাম, ‘আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পিতা ফরহাদ হোসেনকে’। তবে আমার পিতা অসহযোগ আন্দোলনের আগে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেছিলেন। উনি মুসলিম লীগ থেকে নমিনেশনও পেয়েছিলেন ১৯৭০-এর নির্বাচনে; কিন্তু, তিনি যখন দেখলেন যে আমরা সবাই মুসলিম লীগবিরোধী, এবং দেশে একটা নতুন রাজনৈতিক-চেতনা আসছে, বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, স্বাধীনতা-আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে, তখন তিনি নির্বাচনের আগে আমাদের ঈদের মাঠে ঘোষণা দিলেন আজ থেকে তিনি আর মুসলিম লীগের সঙ্গে নেই। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে, নৌকার পক্ষে যোগ দিলেন।

ভিউজ বাংলাদেশ: মুক্তিযুদ্ধের কথা কিছু বলুন। আপনার বড় ভাইয়েও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আপনারা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন?
মোহন রায়হান:
আমাদের ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সংগঠিত করেন আমার বাবাই। তিনি ব্রিটিশ আর্মিতেও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরেই তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ছেলেপুলেদের ট্রেনিং দিতে শুরু করেন। আমাদের ইউনিয়নে ইপিআরের একজন সৈনিক ছিলেন, তিনি তখন ছুটিতে আসছেন। সোহরাব হোসেন। তিনিও আমাদের ট্রেনিং দিয়েছেন।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনারা যুদ্ধে গেলেন কবে?
মোহন রায়হান:
আমার বড় ভাই আগে গিয়েছিলেন।  তিনি ভারতের মাইনকারচর হয়ে ভারতে গিয়ে সর্বোচ্চ ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তাদেরই একটা গ্রুপ ট্রেনিং নিয়ে দেশে আসলে আমি তাদের সঙ্গে গেরিলা গ্রুপ গঠন করি। 


ভিউজ বাংলাদেশ: আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে আপনার দীর্ঘজীবনের বিস্তৃত বর্ণনা দিতে আমরা অপারগ। যদি একটু সংক্ষেপে বলি, আপনি প্রথম ঢাকা এলেন কবে?
মোহন রায়হান:
প্রথম ঢাকা আসি ১৯৭২ সালে। পল্টন ময়দানে অস্ত্র জমা দিতে আমি আর আমার বড় ভাই আসি অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে।

ভিউজ বাংলাদেশ: বঙ্গবন্ধুকে আপনি প্রথম কাছে দেখেন কবে?
মোহন রায়হান:
১৯৭০ সালে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলেন। তিনি সিরাজগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে একটা লঞ্চে ছিলেন। আমাদের লঞ্চে উঠতে দেয়া হচ্ছিল না; কিন্তু আমি লঞ্চের পেছন দিয়ে উঠে পড়ি। খুব দুরন্ত ছিলাম তো। আমাদের নেতা ছিলেন আমির হোসেন ভুলু।  তিনি আমাকে ধাওয়া করেন। আমি দৌড়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কেবিনে ঢুকে পড়ি। বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বসে ছিলেন। আমাকে সবাই ধাওয়া করছে দেখে বঙ্গবন্ধু এসে আমার হাত  ধরলেন। তারপর ভুলু ভাই তেড়ে আসতেছে দেখে আমি আবার দৌড়। একটা নাটকীয় দেখা তার সাথে আর কী!

ভিউজ বাংলাদেশ: বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলে আপনার প্রথমে কী মনে হয়? তার তার পুরো ব্যক্তিত্বটি আপনার চোখে কীরকম ধরা দেয়?
মোহন রায়হান:
একটা ঘটনা বলি, মুক্তিযুদ্ধের আগে একটা গেঞ্জি বের করেছিলাম আমরা। গেঞ্জিতে বঙ্গবন্ধু আর নৌকার ছবি। নিচে লেখা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। আমরা সবাই সেই গেঞ্জি পরতাম। যখন সিরাজগঞ্জে আর্মি আসলো বন্ধুরা সবাই সেই গেঞ্জি খুলে ফেলল। আমি বললাম, ‘এখানে বুলেট ভেদ করে যাবে, তবু বঙ্গবন্ধু নামবে না।’

ভিউজ বাংলাদেশ: কিন্তু আপনি তো পরে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে জাসদে যোগ দেন?
মোহন রায়হান:
মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন রেডিওতে ওই গানটা বাজতো, ‘মুজিব বাইয়া যাওরে নির্যাতিত দেশের মাঝে জনগণের নাওরে...’ তখনে কেঁদে আমি স্টেনগান ভিজিয়ে ফেলতাম। সেই আমি ১৯৭২-এর পর পরিবর্তন হয়ে গেলাম। সেই সময় আমাদের একটা স্বপ্নভঙ্গ হলো। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি দেশের মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। আমরা ভেবেছিলাম আমরা স্বাধীনভাবে লিখব, চিন্তা করব; কিন্তু স্বাধীনতার পর যখন দেখলাম দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্নগুলো পূরণ হচ্ছে না, একটা দলই সবকিছু ভোগ-দখল করছে, তখন জাসদ গঠন হলো। আমিও জাসদে যোগ দিলাম।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার প্রথম বই কবে বেরোয়?
মোহন রায়হান:
১৯৭৮ সালে। জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আবিদ রহমান এবং আলী রিয়াজের প্রথম বইও সেবার বেরোয়। আমরা চারজন একসঙ্গে বই বের করি। রুদ্রর কবিতা বইয়ের নাম ছিল ‘উপদ্রুত উপকূল’,  আলী রিয়াজের প্রবন্ধের বই ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ; আর আবিদ রহমানের ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’। 

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাদের সে সময়টা নিয়ে কিছু বলুন।
মোহন রায়হান:
সে সময়ের কথা বললে তো সংক্ষেপে শেষ করা যাবে না। সে এক অন্য সময়। বাংলাভাষায়-সাহিত্যে আজ যারা বিখ্যাত সে সময় সবাই এসে ঢাকা ভিড় করেছেন। সেই সময়ে ছাত্র-আন্দোলন ছিল তুঙ্গে।  পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালই ছিল আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের লেখালেখির বিষয় ছিল তখন দেশ, মানুষ, লড়াই। নতুন কিছু করার একটা চেতনা, তাগিদ ছিল সব সময়।

ভিউজ বাংলাদেশ: সে সময় বাংলা একাডেমি বইমেলা কীরকম ছিল?
মোহন রায়হান:
খুব সুন্দর ছিল। ছিমছাম সুন্দর। একাডেমির প্রাঙ্গনে পুকুর ঘিরে স্টল বসতো। বয়রাতলার ওদিকটা দু-একটা চায়ের দোকান। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ,  আহমেদ শরীফ, সৈয়দ শামসুল হক, আহমেদ ছফা, ড. হুমায়ুন আজা, রফিক আজাদসহ আমরা তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা আড্ডায় বসতাম। সে সময় আমরা যারা সাহিত্য করতাম, বাংলা একাডেমি তখন মেলা পরিচালনা করতে আমাদের সঙ্গে রাখত। মেলা কমিটিতে আমাদের রাখত।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার কবিতা দ্রোহের কবিতা হিসেবে খ্যাত? কেন?
মোহন রায়হান:
আমার যে দ্রোহের চেতনা এটা আসছে পরিবেশ থেকে। নিপীড়িত মানুষের লড়াই দেখে আমার ভেতরে দ্রোহের চেতনা জাগে। মানুষ যে এত বঞ্চিত, শোষণ-নির্যাতনের স্বীকার, তারপরও তারা লড়াই করছে। লড়াই না করলে তো মানুষ টিকতে পারত না। আমার জীবনও লড়াইয়ের ইতিহাস। আমার জীবনই আমার কবিতা। আমি কখনো বানিয়ে কবিতা লিখিনি। ভেতর থেকে যে বোধ জাগ্রত হয়েছে তা-ই লিখেছি।

ভিউজ বাংলাদেশ: এই যে আপনি এক আপোষহীন জীবন কাটিয়েছেন। কখনো সুবিধাবাদের কাছে মাথা নত করেননি। এর লড়াই করতে গিয়ে আপনাকে কীরকম ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছে?
মোহন রায়হান
: প্রতিটি মুহূর্তে, পরিবারে, বন্ধুদের মধ্যে, রাজনৈতিক মাঠে সব জায়গাতেই লড়াই করতে হয়েছে। অনেক বন্ধুদের দেখেছি কিছু সুবিধা পেলে চুপ হয়ে যায়। পরিবারেও নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছি। আমার বাবাকে আমি বুর্জোয়া বলে গালি দিতাম। বাবাও আমাকে উল্টো বলতেন, এত বড় বড় কথা বলো, কোথাও তো একটা খোটাও গাঁথতে পারো না।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহন রায়হান:
আপনাদেরও ধন্যবাদ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ