অমর একুশে বিশেষ সংখ্যা ২০২৪
ভাষার রাজনীতি
এমন একটা পরিস্থিতি কল্পনা করা যাক, যেখানে কোনো উপলক্ষে একটি কেক কাটা হবে। কেক ছোট, খানেওয়ালা বেশি। কেকের বেশির ভাগ আমি কিংবা আমার ছেলেমেয়ে, আমার আত্মীয়স্বজন, আমার পক্ষের লোকজন খেলে আমার বা আমাদের জন্য ভালো। কেকের সিংহভাগ আমার প্রতিপক্ষ খেয়ে নিলে তাদের জন্য ভালো। সবাই মিলে খেলে সবার জন্য ভালো। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!’ প্রতিপক্ষ কিংবা বাকি সবার সঙ্গে কেক ভাগ করে খেলে নিজের কিংবা নিজেদের পুষ্টি নিশ্চিত হবে কি না, সে প্রশ্ন উঠবেই। ‘আপনি বাঁচলে তবে তো বাপের নাম!’ কেক বাটোয়ারা নিয়ে কোন সিদ্ধান্তটি শ্রেয়তম, ব্যক্তিক, গোষ্ঠীক ও সামাজিক পর্যায়ে সেটা নির্ধারণ করার নামই রাজনীতি।
১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফালিয়া চুক্তির পূর্বে পৃথিবীতে ‘রাষ্ট্র’ বা ‘জাতিরাষ্ট্র’ বলে কিছু ছিল না। বিভিন্ন সাম্রাজ্য ছিল এবং কোনো একটি ভাষা বিচিত্র কারণে সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দাপ্তরিক ভাষাটি যেসব সময় শাসকের বা সংখ্যাগুরুর ভাষা হতো, তা কিন্তু নয়; কিন্তু চাকরিপ্রত্যাশী লোকজন সেই ভাষাটি, যেভাবেই হোক, শিখে নিতো। মধ্যযুগের সুলতানী ও মোঘল আমলে ভারতবর্ষের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফার্সি। হিন্দু ও মুসলমান উভয় জনগোষ্ঠীই ফার্সি শিখতো সাম্রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি পাবার আশায়। ইওরোপেও লোকজন লেখাপড়া করে রাজসরকারে একটি চাকরি পাবার আশায় ল্যাটিন শিখতো। অষ্টাদশ শতক থেকে ভারতবর্ষে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা করা হয়েছিল। ইংরেজি ছিল অতি সংখ্যালঘু বিদেশি শাসকের মাতৃভাষা।
ফরাসি বিপ্লবের পর যখন ইউরোপে একেকটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করল, তখন দেখা গেল, কাকতালীয় বা আর্বিত্রিক সীমানাভাগের কারণে একই জাতিরাষ্ট্রের সীমানার অভ্যন্তরে একাধিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। সাম্রাজ্যের সঙ্গে জাতিরাষ্ট্রের দাপ্তরিক ভাষার অন্যতম পার্থক্য হচ্ছে, জাতিরাষ্ট্রে ভাষীর সংখ্যার ওপরে ভাষার গুরুত্ব নির্ভর করে, যার মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাই জাতিরাষ্ট্রের দাপ্তরিক বা রাষ্ট্রভাষা হয়। এই ভাষাতেই প্রশাসনের কাজ চলে, বিচারালয়ে বিচার হয় এবং শিক্ষার মাধ্যমও হয় রাষ্ট্রভাষা।
এর একটা সুবিধাও আছে, অসুবিধাও আছে। যে জাতির ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়, সে জাতিকে ভাষাটি আর নতুন করে শিখতে হয় না। তাছাড়া মাতৃভাষা বা প্রথম ভাষা বলে ভাষাটির ওপর তাদের দখলও বেশি থাকে; কিন্তু যে জাতির মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষা হয় না, সে জাতির সমূহ বিপদ। তাকে বাধ্য হয়ে নতুন একটি ভাষা শিখতেই হয়। ভাষা না শিখলে বা শিখতে না পারলে সেই জাতি বহুবিধ সুবিধা বঞ্চিত হয়ে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। ঠিক এই কারণেই ১৯৪৮-৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ না, পাকিস্তানিরা আমাদের মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চায়নি। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার না করে ‘হয়তো’ আমাদের সুবিধাবঞ্চিত করতে চেয়েছিল। বাঙালি উর্দু শিখে সরকারি কাজকর্ম পেতে এতটাই দেরি হয়ে যেত যে, ততদিনে যাবতীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকিস্তানের উর্দুভাষী লোকজনের কুক্ষিগত হয়ে যেত।
উপরে ‘হয়তো’ বললাম এ কারণে যে উর্দু পাকিস্তানের কোনো ভাষা ছিল না। পাকিস্তানের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন সিন্ধি, পাঞ্জাবি, বালুচ, পাঠানকেও উর্দু শিখতে হতো। তবে এদের শিক্ষিত সমাজ আগে থেকেই উর্দু কিছুটা জানতো, কারণ উর্দু/হিন্দি দেশভাগের বহু আগে থেকেই ভারতবর্ষের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল। এ ছাড়া যেহেতু আরবি বর্ণমালা দিয়ে উর্দু লেখা হয়, আরবি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয়ও তাদের উর্দু শেখার পথ সুগম করত। আরবি বর্ণমালা দিয়ে লিখিত হবার কারণে পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী ও শাসকরা আরবির সঙ্গে উর্দুকে গুলিয়ে ফেলেছিল এবং উর্দুকে তারা ইসলামী ভাষা মনে করত। উত্তর ভারতের লোকজন পূর্বভারতের অধিবাসীদের যে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ঈর্ষা ও ঘৃণা করে আসছে, তার প্রমাণ মহাভারত ও পুরাণে আছে। পূর্বভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে উন্নত একটি ভাষা, যে ভাষায় ইতিমধ্যে নোবেল পুরস্কারও এসে গিয়েছিল, সেই বাংলা ভাষার প্রতি উত্তর ভারত তথা পাকিস্তানিদের অজ্ঞতা ও অপরিচয়জনিত জাতঘৃণাতো ছিলই। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই অপরিচয় ও ঘৃণার কথা আছে।
সাধারণত মনে করা হয় যে জাতিরাষ্ট্রের একটাই দাপ্তরিক ভাষা থাকা উচিত, কারণ একাধিক দাপ্তরিক ভাষা ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠনের অন্তরায়।এই অজুহাতে ১৯৫২ সালে বাঙালি শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল পাকিস্তানিরা। ‘ও তুই ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি!’ জাতিগঠনের জন্য এক রাষ্ট্রভাষা থাকা অপরিহার্য নয়। বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, ফিলিপাইন ইত্যাদি রাষ্ট্র যেখানে একাধিক রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃত, সেই রাষ্ট্রগুলোর সমৃদ্ধিও এক রাষ্ট্রভাষার দাবিকে ভুল প্রমাণ করে। ভাষার সংখ্যার বিচারেও একাধিক ভাষা, যেমন উর্দু এবং বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে কোনো বাধা ছিল না।
বেলজিয়ামে ফরাসি এবং ডাচ উভয়েই দাপ্তরিক ভাষা, কারণ গুরুত্বপূর্ণসংখ্যক লোক এই দুই ভাষার কথা বলে। সুইজারল্যান্ডে ফরাসি, জার্মান ও ইতালিয়ান দাপ্তরিক ভাষা হবার কারণও ভাষার সংখ্যা। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে সর্বমোট ১৯৫টি জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে ১৭৮টির স্বীকৃত দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে, যার মধ্যে ১০১টি রাষ্ট্রে একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং অস্ট্রেলিয়ার কোনো স্বীকৃত বা ডি জুরো দাপ্তরিক ভাষা নেই। ইতালিরও ছিল না, তবে অতি সম্প্রতি, ১৯৯৯ সালে, ইতালীয় ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইতালির সরকার। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে ডি জুরো দাপ্তরিক ভাষা একটিই: বাংলা। ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইন অনুসারে বাংলায় শিক্ষা, বিচার ও দাপ্তরিক কাজকর্ম না করা শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।
ওপরের পরিসংখ্যানের অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ রাষ্ট্র অন্তর্ভুক্ত জাতির ভাষিক অধিকার স্বীকার করে এবং প্রায় ৪০ শতাংশ রাষ্ট্র এই অধিকার স্বীকার করে না। বাকি ১০ শতাংশ রাষ্ট্র ডি জুরো দাপ্তরিক ভাষার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। এর মানে হচ্ছে, ৫০ শতাংশ রাষ্ট্র কেক সবার সঙ্গে ভাগ করে খেতে চায়। ৪০ শতাংশ অন্যকে কেকের ভাগ দিতে চায় না। ১০ শতাংশ ডি ফ্যাক্টো ভাগ দিতে চায় কিংবা চায় না, তবে ডি জুরো এ ব্যাপারে কিছু স্বীকার করতে চায় না।
প্রতিটি ভাষা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতার লিপ্ত। স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে এই প্রতিযোগিতা। একটি ভাষার চার ধরনের স্বীকৃতি থাকতে পারে: ১) সামাজিক স্বীকৃতি, ২) রাজনৈতিক স্বীকৃতি, ৩) অর্থনৈতিক স্বীকৃতি এবং ৪) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ইংরেজি ভাষার এই চারটি স্বীকৃতিই আছে। গারো কিংবা ককবরোক ভাষার একটি স্বীকৃতিও নেই। যে ভাষার সামাজিক স্বীকৃতিটুকুও নেই সে ভাষা সাধারণত সাহিত্যের বাহন হয় না।
মধ্যযুগে বাংলার সুলতানেরা তৎকালীন প্রমিত বাংলায় সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দিয়েছিলেন, কারণ বাংলার একটা সামাজিক স্বীকৃতি ছিল। গারো, ককবরোক কিংবা চট্টগ্রামী উপভাষায় সাহিত্যচর্চায় তারা উৎসাহ দেননি, কারণ এসব ভাষা-উপভাষার সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না, কিংবা বাংলার তুলনায় কম ছিল। ত্রয়োদশ শতকে জার্মানিতে মার্টিন লুথার প্রমিত জার্মানের পরিবর্তে সাধারণ মানুষের কথ্য জার্মানে বাইবেল অনুবাদ করার ফলে এই উপ-ভাষাটির সামাজিক স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছিল। সেই কথ্য জার্মানই আধুনিক জার্মানে বিবর্তিত হয়েছে।
যে ভাষার যত বেশি স্বীকৃতি, সে ভাষা রাজনৈতিকভাবে তত সফল। রাজনৈতিকভাবে সফল বা ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে অসফল ব্যক্তিকে দাবিয়ে রাখতে চাইবেই। একইভাবে, যে ভাষার স্বীকৃতি বেশি, সে ভাষা অন্য ভাষাকে দাবিয়ে রাখতে চায়। ভাষা কিংবা ভাষী জনগোষ্ঠী মাত্রই রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেতে চায়, যদি তারও ক্ষমতা থাকে। ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন চলাকালীন ফরিদপুর জেলে বঙ্গবন্ধুর অনশন-ধর্মঘট ছিল মূলত বাংলা ভাষার রাজনৈতিক স্বীকৃতি অর্জনের সংগ্রাম।
ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে দুটি ভিন্ন ভাষা যখন পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখন অধিক স্বীকৃতিবান ভাষাটিকে বলা যেতে পারে ‘উত্তমর্ণ’ বা সুপারস্ট্র্যাট ভাষা এবং তুলনামূলকভাবে কম স্বীকৃতিবান ভাষাটিকে বলা হয় ‘অধমর্ণ’ বা সাবস্ট্র্যাট ভাষা। উত্তমর্ণ ভাষার শব্দ অধমর্ণ ভাষায় ব্যবহৃত হয়, এর বিপরীতটা প্রায় কখনই হয় না। এর প্রমাণ, মধ্যযুগে উত্তমর্ণ ফার্সি থেকে প্রচুর শব্দ বাংলা শব্দকোষে প্রবেশ করেছে। ইংরেজ আমলের শুরু থেকেই থেকে প্রচুর ইংরেজি শব্দ বাংলা শব্দকোষে প্রবেশ করে আসছে। একইভাবে প্রচুর বাংলা শব্দও গারো কিংবা ককবরোক ভাষায় প্রবেশ করছে, কারণ বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতিতে বাংলা উত্তমর্ণ এবং গারো অধমর্ণ ভাষা।
অনেক রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা নয়- এমন একটি উত্তমর্ণ ভাষাকেও দাপ্তরিক ভাষা করে। উদাহরণ: ভারত বা নাইজেরিয়া যেখানে ইংরেজি ডি ফ্যাক্টো বা কাজেকর্মে দাপ্তরিক ভাষা। ভারতের ভাষা উর্দু পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা। এই ভাষা পরিস্থিতির নাম ‘এক্সোগ্লসিক’ বা ‘বহির্ভাষিক’ ভাষা পরিস্থিতি। অনেক রাষ্ট্র অন্তর্ভুক্ত কোনো একটি জাতির ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। এমন ভাষাপরিস্থিতির নাম ‘এন্ডোগ্লসিক’ বা ‘আন্তর্ভাষিক’ ভাষাপরিস্থিতি। বার্মায় এই ভাষাপরিস্থিতি বহাল আছে- বর্মী, কারেন, রোহিঙ্গা, চীন ইত্যাদি জাতির নিজ নিজ ভাষা থাকা সত্ত্বেও বর্মী জাতির মাতৃভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উপরোক্ত দুই পরিস্থিতিতে জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকরা নিজের মাতৃভাষা নয়- এমন একটি ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে মেনে নেয়। প্রথমত, যখন তাদের নিজের ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা দাবি করার মতো ক্ষমতা থাকে না। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের ক্ষমতা ছিল মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করার। সিন্ধি কিংবা বালুচদের সেই ক্ষমতা ছিল না। দ্বিতীয়ত, কোনো মাতৃভাষায় যদি লিপি না থাকে এবং মাতৃভাষায় যদি উন্নত সাহিত্য রচিত না হয়, সেক্ষেত্রেও সেই মাতৃভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি উঠে না। বিশেষ ভাষায় সাহিত্য রচিত হওয়া সেই ভাষায় বিচিত্র ভাব প্রকাশের ক্ষমতার প্রমাণ বটে।
চট্টগ্রামের লোকসংখ্যা পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বেশি, অন্ততপক্ষে ইসরায়েলের চেয়ে বেশি; কিন্তু চট্টগ্রামীরা নিজেদের মাতৃভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি কখনো করেনি, কারণ তারা বিশ্বাসই করে না যে চট্টগ্রামী ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হবার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে একটি কৃত্রিম ভাষা আধুনিক হিব্রুকে ইহুদিরা ইসরায়েলের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আধুনিক হিব্রু কৃত্রিম ভাষা, কারণ ইদ্দিশ বাক্যবিন্যাসের ওপর হিব্রু শব্দ বসিয়ে প্রথমে একটি পিজিন ভাষা সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর পর একাধিক প্রজন্ম যখন এই পিজিন মাতৃভাষা হিসেবে শিখেছে, তখন সেই ভাষা ক্রেওল-এ বা স্বাভাবিক ভাষায় পরিণত হয়েছে। বার্মার বিশেষ রাজনৈতিক প্রতিবেশের কারণে রোহিঙ্গারা মনে করে যে তাদের মাতৃভাষা এবং মূলত চট্টগ্রামীর একটি উপভাষা রোহিঙ্গা বার্মার অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হওয়া উচিত।
যে সমাজে একটি উত্তমর্ণ এবং একটি অধমর্ণ ভাষা সহাবস্থান করে, সে সমাজের লোকজন চায়, উত্তমর্ণ ভাষাটিই শিক্ষার মাধ্যম হোক, সব বিষয়ে না হলেও অন্তত কিছু কিছু বিষয়ে। এই মানসিকতা পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যায়। বাংলাদেশে অনেকেই একটি বহির্ভাষিক বা এক্সোগ্লসিক ভাষাপরিস্থিতি চায়, অর্থাৎ ইংরেজিকে তারা দাপ্তরিক ভাষা করার পক্ষে। ভারতের ভাষা উর্দুকে দাপ্তরিক ভাষা করে পাকিস্তানিরাও অনুরূপ একটি ভাষাপরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
আফ্রিকার অনেক দেশে, মাগরেব অঞ্চলে (আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া এবং মরক্কো) ফরাসি অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। ইংরেজি ৫৮টি দেশের, ফরাসি ২৮টি দেশের, আরবি ২৩টি দেশের এবং স্পেনিশ ২০টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা। ভারতের মতো বহুভাষী একটি দেশের ক্ষেত্রে ইংরেজিকে অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে রাখার বা বহির্ভাষিক ভাষাপরিস্থিতি বজায় রাখার পক্ষে যুক্তি আছে বটে, কারণ জাতিগঠনের প্রয়োজনেই হোক, কিংবা হোক যোগাযোগের প্রয়োজনে, ভারতের বিচিত্রভাষী মানুষের একটি সাধারণ ভাষার অপরিহার্য। এই প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে বাংলা বা তামিলভাষী জনগণের কাছে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এবং লিঙ্গুয়া একাডেমিকা ইংরেজিকে যত সহজে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাবে, তামিল বা মারাঠিকে বাংলাভাষীদের কাছে বা ভারতের সব জাতির কাছে অত সহজে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাবে না। তবে বলিউডের কারণে হিন্দির প্রচার ও প্রসার বাড়ছে।
আগেই বলেছি, যে ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হবে, সে ভাষা ব্যবহারকারীরা রাষ্ট্রের বহুবিধ সুবিধা ভোগ করবে। বাংলাদেশের সুবিধাভোগী শ্রেণি ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা করার পক্ষে (ঠিক যেভাবে পাকিস্তানের সুবিধাভোগী শ্রেণি উর্দু বা ইংরেজির পক্ষে ছিল), কারণ প্রথমত, তারা নিজেরা ইংরেজি জানে বলে ‘ভাবে’ এবং বাংলাকে তারা ছোটলোকের ভাষা মনে করে। ইংরেজি যদি দাপ্তরিক ভাষা হয়, তবে তারা এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা রাষ্ট্রের সব সুবিধা ভোগ করতে পারবে, কারণ দেশের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কখনই ইংরেজি শিখে উঠতে পারবে না কিংবা শিখতে পারলেও ভাষিক যোগ্যতার বিচারে সুবিধাভোগী শ্রেণির তুলনায় পিছিয়ে থাকবে। এ ছাড়া বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা করার পিছনে যে খরচ ও বিনিয়োগ আছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণি সেই খরচ ও বিনিয়োগ করতে রাজি নয়। এই খরচ ও বিনিয়োগ না করার অন্যতম কারণ, এর ফলে সুবিধাভোগী শ্রেণি নয়, বরং তাদের চোখে যারা ছোটলোক, তারা উপকৃত হবে। পঞ্চাশের দশকের পাকিস্তানে সমজাতীয় ভাষা-পরিস্থিতি বিরাজ করছিল এবং এমন এক পরিস্থিতিতেই ভাষা আন্দোলন হয়েছিল।
পার্থক্য শুধু এ টুকুই যে পাকিস্তানপন্থিরা বাংলা ভাষার সঙ্গে শত্রুতা করত প্রকাশ্যে, ঘোষণা দিয়ে। বাংলাদেশের বাংলাবিরোধীরা বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে গোপনে। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দিবস। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!’ এই দিবস হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষার অধিকার নিয়েতো কারও দ্বিমত নেই। মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে কিনা, কিংবা মাতৃভাষাকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হবে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন। যে ভাষার সব স্বীকৃতি আছে সে ভাষা সসম্মানে দীর্ঘজীবী হবার কথা। যে ভাষার একটি স্বীকৃতিও নেই, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সে ভাষার জীবন-সংকট।
শ্রেণির জন্য যা সুবিধাজনক, জাতির জন্য তা সুবিধাজনক হবে, এমন কোনো কথা নেই। বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণকে কখনই এতটা ইংরেজি শেখানো যাবে না যে ইংরেজিকে একটি কার্যকর ও গণমুখী দাপ্তরিক ভাষা করে তোলা সম্ভব হবে। ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা করার মানে হচ্ছে, ভাষাটিকে শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনের মাধ্যম করে তোলা। দ্বিতীয়ত, ইংরেজি নির্ভর প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা হবে একান্তভাবে জনবিমুখ, কারণ প্রথমত, জনগণ যে ভাষা জানে না, সেই ভাষায় তাকে সেবা দেয়া মানে জনগণের অর্থের অপচয় এবং দ্বিতীয়ত, অজানা একটি ভাষায় সুবিচারও আশা করা যায় না।
ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা করার প্রচেষ্টা যদি কমবেশি সফল হয়, তবে তার ফলে কার্যকর ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যাহত হবে। শিক্ষা ব্যহত হলে ব্যহত হবে টেকসই উন্নয়ন। উন্নয়ন ব্যহত হলে যে বাঙালি আজ মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে কামলা দিচ্ছে, তারা বার্মায় গিয়ে কামলা দিতে বাধ্য হবে। পঞ্চাশের দশকে মালয়েশিয়া আর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় সমান ছিল। এখন বাঙালি মালয়েশিয়ায় গিয়ে কামলা দেয়। এর পেছনে মালয়েশিয়ার ভাষানীতির একেবারেই প্রভাব নেই, সে দাবি করা যাবে না। ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্ত বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রমাণিত হবে।
পাকিস্তানিরা জোর দেখিয়ে বাংলা ভাষার অধিকারকে অস্বীকার করেছিল। বাঙালিরা পাল্টা জোর দেখিয়ে নিজেদের মাতৃভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে। স্বাধীনতার পর সেই বাংলাদেশই হেরে যাচ্ছে তার সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাসীন শ্রেণির কাছে, যারা বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হতে দেবার বিপক্ষে। একই বাংলাদেশ আবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করছে।
কেকের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কেক হয় শুধু আমি বা আমার লোক খাবে, কিংবা সবাই মিলে খাবো। প্রথম সিদ্ধান্তটি প্রেয়, দ্বিতীয়টি শ্রেয়, কারণ (রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন) ‘তুমি যাবে নিচে ফেলো সে তোমারে বাঁধিছে যে নিচে। পশ্চাতে ফেলিছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে জাতিরাষ্ট্রে ভাষার রাজনীতি কমপক্ষে দুই প্রকার হতে পারে : ১) ‘জোর যার মুলুক তার’, এবং ২) ‘শত ফুল ফুটতে দাও’। এই দুই রাজনীতির মধ্যে কোনটি ভবিষ্যতে প্রাধান্য পাবে, সে কথা বলার সময় এখনো আসেনি, তবে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিই সার্বিক বিচারে শ্রেয়তর মনে হচ্ছে।
লেখক: ভাষাবিদ ও অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে