পুরস্কার বিতর্কের লাভ-ক্ষতি
সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন দুটি বিষয় খুব চলছে; ১. সপ্তম শ্রেণির একটি পাঠ্যবইয়ে মানুষের লৈঙ্গিক পরিচয়সম্পর্কিত একটি গল্প নিয়ে সৃষ্ট ধূম্রজালজনিত বিতর্ক এবং ২. বাংলা একাডেমির পুরস্কার। দুটির সঙ্গেই বই বা জ্ঞানের সম্পর্ক রয়েছে। এটি এক অর্থে ভালো লক্ষণ যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ বই তথা জ্ঞানের আলাপ করছে। যদিও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় এবার কারা বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন, সেই আলোচনাকে ছাপিয়ে গেছে পুরস্কার গ্রহণের ১০ বছর পরে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের পুরস্কার ফেরত দেয়ার ঘটনাটি। ফলে এই নিবন্ধে আমরা বাংলা একাডেমির পুরস্কার-বিতর্কের লাভ-ক্ষতির দিকগুলো খতিয়ে দেখতে চাই।
এবার সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় মোট ১৬ জন লেখককে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। কে কোন শাখায় কী যোগ্যতায় পুরস্কার পেলেন, সেটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় টুকটাক আলাপচারিতা, খুনসুটি আর তীর্যক মন্তব্যের ভিড়ে ২৮ জানুয়ারি আকস্মিত বজ্রপাতের মতো হানা দেয় জাকির তালুকদারের একটি ফেসবুক পোস্ট—যেখানে তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বরাবর তার পুরস্কার ফেরত দেয়া-সম্পর্কিত একটি চিঠি এবং পুরস্কারের অর্থমূল্য বাবদ গৃহীত ১ লাখ টাকা ফেরত দিয়ে তার স্বাক্ষরিত একটি চেকের ছবি তুলে দেন। সেখানে জাকির তালুকদার লিখেছেন: ‘পাঠিয়ে দিলাম। খুব ভারমুক্ত লাগছে।’ ব্যস, শুরু হয়ে গেলো শোরগোল। ১০ বছর পরে কেন তিনি পুরস্কারটি ফেরত দিলেন, এ প্রশ্ন যেমন ছিল, তেমনি অনেকে তাকে এই বিলম্বিত অথচ সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দনও জানান।
এদিন গণমাধ্যমে তার পুরস্কার ফেরত দেয়া সংবলিত একটি ব্যাখ্যাও প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি দাবি করেছেন, ‘বাংলা একাডেমির গণতন্ত্রহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা, ২৫ বছর ধরে কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচন না করে ইচ্ছেমতো একাডেমি চালানোর জন্য বাংলা একাডেমি সচেতন মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।’ তার ভাষায়, ‘প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কমে গেলে পুরস্কারের গুরুত্ব থাকে না। এ জন্য এই পুরস্কার এখন আমার কাছে অর্থহীন বোঝা বলে মনে হচ্ছে। বাংলা একাডেমি নিজের মান ধরে রাখতে পারেনি, এটা দুঃখজনক।’ (প্রথম আলো, ২৮ জানুয়ারি ২০২৪)।
প্রশ্ন হলো, জাকির তালুকদার যখন এই পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলেন তখন কি বাংলা একাডেমিতে খুব গণতন্ত্র ছিল? আমলাতন্ত্র ছিল না? বাংলা একাডেমি কি তখন সচেতন মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল? যদি না হয়, তাহলে ১০ বছর পরে তার কাছে এই পুরস্কারটি ‘অর্থহীন বোঝা’ বলে মনে হচ্ছে কেন? এর মধ্য দিয়ে তিনি তার সৎ সাহসের পরিচয় দিলেন নাকি মানুষকে মনে করিয়ে দিলেন যে, তিনিও ১০ বছর আগে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন? এ নিয়ে ফেসবুকে তীর্যক মন্তব্যকারীদের কেউ কেউ লিখেছেন, ১ লাখ টাকা ফেরত দিয়ে তিনি ১ কোটি টাকার প্রচার পেলেন। যারা এতদিন তার এবং তার লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, তারাও নতুন করে তাকে চিনলেন। তবে জাকির তালুকদার যদি সত্যিই বাংলা একাডেমির গণতন্ত্রহীনতা ও আমলাতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এই পুরস্কার ফেরত দিয়েও থাকেন, তারপরও যে প্রশ্নটি সামনে আসবে তা হলো, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে কি বাংলা একাডেমি অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ও আমলাতন্ত্রমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে? আপাতত সে আশায় গুড়েবালি।
কেননা কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন বিবেচনায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়, সেটি বরাবরই একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এই পুরস্কারে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ নয়। কোনো নির্দিষ্ট বই নয়, বরং একজন লেখকের সামগ্রিক সাহিত্য কীর্তির জন্য পুরস্কার দেয়া হয়। ফলে ‘মাঝারি মানের’ লেখকরাও ‘সামগ্রিক কীর্তি’র জন্য পুরস্কার পেয়ে যান। আবার যে প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দেয়, অর্থাৎ বাংলা একাডেমিতে কর্মরত লেখকরাও এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। অথচ এটি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা এখানে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলা একাডেমিতে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কোনো লেখক চাকরি করতে পারবেন না বা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য লেখকরা শুধু একাডেমিতে চাকরি করার কারণে অযোগ্য বিবেচিত হবেন? এটি একটি বিরাট তর্ক। কেননা, যে প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দেয়, সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ওই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন না, এটিই আন্তর্জাতিক রীতি। নৈতিকতার বিচারে এটিই সঠিক। কেননা যারা বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেন, তারা নানাভাবেই এই পুরস্কারের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন। অবশ্য বাংলা একাডেমি থেকে অবসর গ্রহণের পরে কিংবা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চাকরিসূত্রে যুক্ত না থাকলে তিনি নিশ্চয়ই বিবেচিত হতে পারেন। ফলে যে বিতর্কটি এখন শুরু হয়েছে, সেখানে এই প্রশ্নগুলোও এখন উত্থাপন করা প্রয়োজন এবং প্রশ্নগুলো উঠছে। তবে এর সমাধান প্রয়োজন।
এটা ঠিক যে, ভালো লেখক বা যোগ্য মানুষ হলেই তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়ে যাবেন, বিষয়টা এমন নয়। কেননা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার কারা পাবেন, সেটি নির্ধারণের জন্য একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ বেশ পুরোনো। যে সিন্ডিকেটে আমলাদের একটি অংশ এবং সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ বেশ সক্রিয়। অতএব, শুধু ভালো লেখক হলেই তিনি বাংলা একাডেমি, একুশে কিংবা স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন—এমনটি নাও হতে পারে। অর্থাৎ একজন লেখক শুধু তার ভালো লেখা বা দারুণ গবেষণার কারণেই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়ে যাবেন—এমন সরল উপসংহারে পৌঁছানোর সুযোগ নেই।
তার মানে কি যারা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পান তাদের সবাই অযোগ্য? নিশ্চয়ই না। নিশ্চয়ই প্রতি বছরই যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন, তাদের অনেকেই লেখক ও গবেষক হিসেবে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য; কিন্তু অনেক যোগ্য লেখকও পুরস্কারের বাইরে থেকে যান। বছরের পর বছর ধরে তাদের পাঠকরা অপেক্ষায় থাকেন এই বুঝি তাদের প্রিয় লেখক একটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন; কিন্তু প্রতি বছরই তাদের আশাভঙ্গ হয়। হয়তো তাদের কেউ কেউ ভবিষ্যতে পাবেন। অনেকে হয়তো পাবেন না। আবার এমনও অনেকে পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়ে যান বা হয়তো নানাবিধ কায়দা-কানুন করে পুরস্কার বাগিয়ে নেন, যাদের লেখার সঙ্গে অধিকাংশ পাঠকের ন্যূনতম কোনো পরিচয় নেই।
আবার এটিও ঠিক যে, নীরবে নিভৃতে অনেকেই ভালো লেখেন; কিন্তু নানা কারণেই আলোচিত হতে পারেন না। খুব বেশি পাঠকপ্রিয়তা পান না; কিন্তু লেখার গভীরতা আছে। গবেষণার গুরুত্ব আছে। এরকম নিভৃতচারী কোনো লেখককে খুঁজে যদি বাংলা একাডেমি পুরস্কৃত করে, সেটিও মন্দ নয়; কিন্তু সেটি হয়েছে বলে শোনা যায় না। কেননা বাংলা একাডেমিসহ সব রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের পেছনেই অনেক হিসাব-নিকাশ থাকে। সে হিসাব-নিকাশে উত্তীর্ণরাই পুরস্কৃত হন। এর প্রধান কারণ, বাংলাদেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো যে ধরনের দলীয় রাজনীতি এবং আমলতন্ত্রের দুষ্টুচক্রে খাবি খায়, বাংলা একাডেমি সেই চক্রের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন পর্যন্ত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
ফলে শুধু বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারই নয়, বরং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার এবং একুশে পদকও নানা সময়ে বিতর্কিত হয়েছে। তার প্রধান কারণ পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা এবং সিন্ডিকেট। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারা তাদের ঘরানার লোকদেরই এসব পুরস্কার দেয়। তাতে তিনি কবি হন আর বিজ্ঞানীই হন। তবে বিজ্ঞান ও সাহিত্যে যারা পুরস্কৃত হন, আশা করা হয়, সরকার এখানে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে; কিন্তু বাস্তবতা হলো অনেক অযোগ্য ও ‘অখ্যাত’ এমনকি ‘কুখ্যাত’ ব্যক্তি এসব রাষ্ট্রীয় পদক পেলেও অনেক যোগ্য ব্যক্তি এসব সম্মাননা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এমন অনেক ব্যক্তি স্বাধীনতা বা একুশে পদক পাননি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লেখকের লেখা বা সৃষ্টিকর্মের চেয়ে তার রাজনৈতিক বিশ্বাস, আনুগত্য ও যোগাযোগ পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে পুরস্কারগুলো নিয়ে বিতর্ক হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ ট্রল করে, সমালোচনা করে। ফলে যারা প্রকৃতই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য এবং পুরস্কৃত হন, তাদের জন্যও বিষয়গুলো বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়।
সমাধান কী?
একটি বিষয় অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন প্রতি বছর যারা সাহিত্যের নানা শাখায় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, তাদের কেন এবং কোন কোন মানদণ্ড বিবেচনায়, কোন কোন গ্রন্থের জন্য কেন মনোনীত করা হলো, সে বিষয়ে বাংলা একাডেমি একটি লিখিত বিবৃতি দিতে পারে, যেটি পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। তখন ওই বইগুলো সংগ্রহ করে পাঠকরা পড়ে বুঝতে পারবেন যে, তাদেরকে কেন পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলো। তাতে করে যারা পুরস্কার পাননি, তাদের সঙ্গেও ওই পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের লেখার তুলনা করার সুযোগ তৈরি হবে। কারণ যে বাংলা একাডেমিকে বলা হয় জাতির মেধা ও মননের প্রতীক, তাদের প্রতিটি কাজ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকা উচিত। কারণ পুরস্কারটি দেয়া হয় জনগণের টাকায়। সেই টাকা একাডেমি কাকে দিচ্ছে এবং কেন দিচ্ছে, সেটি জানার অধিকার তাদের থাকা উচিত।
মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন বলেই তিনি বিরাট লেখক—তার কোনো মানে নেই। আবার আপনি পড়েননি বলে তিনি ভালো লেখক নন কিংবা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন, সেটিও ভাবার কোনো কারণ নেই। এবারও যারা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের অনেকের লেখাই হয়তো আপনি পড়েননি। কারো কারো নামও হয়তো আগে শোনেননি। তার অর্থ এই নয় যে, তারা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন। কেননা এক জীবনে আমরা খুব কম লেখকের খুব কম লেখাই পড়তে পারি।
তবে রাষ্ট্রীয় এমনকি সাহিত্যে নোবেলও বরাবরই একটি বিতর্কিত ইস্যু। অতএব, পুরস্কার দিয়ে সাহিত্যের মান বিবেচনার সুযোগ নেই। কেননা একজন লেখক নানা কারণেই পুরস্কার পেতে পারেন। তিনি তার লেখার মানের কারণে পেতে পারেন। জনপ্রিয়তার কারণে পেতে পারেন। আবার পুরস্কারদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগসূত্রেও পেতে পারেন। বিশেষ কোনো মহলের সুপারিশেও পুরস্কার পেতে পারেন। সুতরাং কে কোন যোগ্যতায় পেলেন—সেটি সব সময় জানা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধারণা করা যায়। তবে সব সময় সেই ধারণা সঠিক নাও হতে পারে।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে