মামলার সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফৌজদারি মামলার সত্যতা প্রমাণিত হয় আদালতে; কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ডাকাতি, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হতে চান না। সহিংসতার ভয়, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাব, আসামিপক্ষ থেকে ভীতি প্রদর্শন, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার অভাব ও বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাক্ষী আদালতে যেতে আগ্রহী নন। ফলে মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়, অনেক ক্ষেত্রে মামলা খারিজ হয়ে যায়। এতে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও বেশি উৎসাহী হয়।
গতকাল সোমবার (১৫ জুলাই) পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সাক্ষীদের ৪৩ শতাংশই সাক্ষ্য দিতে চান না, ২৪ শতাংশ সাক্ষী হতে ভয় পান। আসামিপক্ষের কাছ থেকে হুমকির কথা জানিয়েছেন ২৮ শতাংশ সাক্ষী। ‘ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীর অনুপস্থিতি: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক পুলিশ সদর দপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও আইনি-প্রক্রিয়ার জন্য এটা অত্যন্ত নেতিবাচক একটি দিক। এভাবে চলতে থাকলে অনেক বিচার-প্রক্রিয়া কমে যাবে এবং সমাজে নানা ধরনের অপরাধ বাড়বে।
আমরা জানি বাংলাদেশের বিচার-প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই এটি একটি প্রধান সমস্যা। অনেক নাটক-সিনেমায়-গল্পেও এসব সমস্যা উঠে এসেছে। চোখের সামনে অপরাধ ঘটতে দেখলেও এদেশের মানুষ চুপ করে থাকে। সাক্ষী দেয়ার ভয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। যদিও বা সাহস করে কেউ সাক্ষ্য দিতে চান, তাকেও অনেক ধরনের হেনস্তার মুখোমুখি হতে হয়। অনেক সময় প্রাণনাশের হুমকিরও সম্মুখীন হতে হয়।
কিন্তু সাক্ষীর উপস্থিতি ছাড়া ফৌজদারি মামলা চলতে পারে না। আর মামলার সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারেরই দায়িত্ব। সরকারকে অবশ্যই সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় দেশে অপরাধীর রাজত্ব কায়েম হবে। বিশেষ করে খুন ও ধর্ষণের মামলায় অনেক সময়ই সাক্ষীদের অনাগ্রহ দেখা যায়। নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এসব মামলা থেকে সাক্ষীরা দূরে থাকেন। বাংলাদেশ সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, মামলার সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাও কেন সাক্ষী অনিরাপত্তায় ভোগেন? তার কারণ সংবিধানের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা হয় না।
সাক্ষীদের নিরাপত্তা প্রদানসহ সমাগ্রিক বিচার-ব্যবস্থায় নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা সরকারেরই দায়িত্ব। সরকার যদি এই দায়িত্বে অবহেলা করে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরেই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কীভাবে সাক্ষীদের যথাযথ সুরক্ষা দেয়া যায়, এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, ভিডিও কনফারেন্স সাক্ষ্য নেওয়া, সাক্ষীদের যাতায়াত ও খাওয়ার খরচ দেয়া, মামলার শুনানি নিয়মিত ও দ্রুত করা এবং আদালতে বিশ্রামাগার, পরিচ্ছন্ন টয়লেট, প্রার্থনা ও খাবারের ব্যবস্থা করলে সাক্ষীদের উপস্থিতি বাড়ানো যাবে।
অপরাধ প্রমাণ করা যেমন আদালতের দায়িত্ব, তেমনি সাক্ষীদেরও আইনি-সহযোগিতায় দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, সমাজে-রাষ্ট্রে আইন-ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা যে কোনো সময় নিজের ওপরও এসে পড়তে পারে। আমরা চাই সাক্ষীদের নিরাপত্তাসহ সব ধরনের সুবিধা দিয়ে মামলা পরিচালানায় সরকার দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রাখবে। সাক্ষীর অনুপস্থিতে যদি কোনো মামলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত না হয়, তা আইন ব্যবস্থার ব্যর্থতাকেই স্পষ্ট করবে। আর বিচারব্যবস্থার ব্যর্থতা মানেই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। কারণ আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েই আইনিব্যবস্থায়। সেই আইনিব্যবস্থায় সাক্ষী একটি বড় অনুষঙ্গ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে