Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের মূল্যবৃদ্ধিঃ প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা সংকট

Md Mizanur Rahman Himadri

মো. মিজানুর রহমান হিমাদ্রী

শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন এক উদ্বেগজনক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিম্ন আয়ের লোকদের জীবনকে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে তুলেছে। চাল থেকে শাকসবজি, রান্নার তেল থেকে শুরু করে সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধসহ জীবনধারণের প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় এদেশের জনসাধারণের কাঁধে ভারী বোঝা চেপেছে। এই অবস্থা শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে অসুবিধা তৈরি করে এমনটি নয় বরং সারাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন, জীবিকা ও ভালো থাকার জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করে।

আরিফুর রহমান, যিনি পেশায় একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, সাধারণত প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিন ৫০০ টাকা নিয়ে ঢাকার রামপুরার রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কেনাকাটা করতে বাজারে যান। কয়েক মাস আগে তার চার সদস্যের পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য এই পরিমাণ টাকা যথেষ্ট ছিল কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরও বেড়ে যাওয়ায় এই টাকায় তার পরিবারের প্রয়োজন মিটছে না।

বাজারে সকল পণ্যের সাথে সাথে সবজির দামও বেড়েছে। ৩০ টাকা কেজির কমে কেনা যায় এমন কোনো সবজি নেই। কাঁচা বাজারে বেশিরভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৫০ টাকা বা তার বেশি দামে। মাসিক ৩০ হাজার টাকা বেতন পাওয়া আরিফের মতো ব্যক্তির জন্য এই মূল্যবৃদ্ধি আসলেই কষ্টের। সবজি হোক, ডিম হোক, মাছ হোক বা মুড়ি, এমন কোনো জিনিস নেই যার দাম বাড়েনি।

চলমান মূল্যবৃদ্ধির পিছনের কারণগুলি জটিল এবং বহুমুখী। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান দাম, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জটিলতা, এমনকি কোভিড-১৯ মহামারির মতো কারণগুলিও খরচ বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। তার উপর চলমান যুদ্ধের কারণে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সাথে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে বিকল্প বাজার থেকে ক্রয় আদেশ বেড়েছে, ব্যবসায়ীরা তেমনটা দাবি করেছেন বলে দেশের বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট প্রচার করেছে।

যাই হোক, সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করা এবং টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার জন্য এই কারণগুলিকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের উপর প্রভাব ফেলে। একটি দেশ যেটি বিভিন্ন পণ্যের জন্য আমদানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে ওঠানামার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন প্রায় প্রতিটি পণ্যের আমদানিকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে। আর সেটির সরাসরি প্রভাব পড়ছে প্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ওপর। এটি মোকাবিলা করার জন্য সরকারকে সচেতনতার সাথে অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করতে হবে, যা মুদ্রাকে স্থিতিশীল করে এবং আমদানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করে।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিও এই সমস্যায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। জ্বালানি তেল পরিবহন ও উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেলে ভোক্তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলিতে বিনিয়োগ করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর দেশের নির্ভরতা কমাতে দক্ষতার প্রচার করা। স্বল্প সময়ের জন্য জ্বালানিতে ভর্তুকি বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ গ্রাহকদের জন্য সাময়িক স্বস্তি প্রদান করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, যার ফলে ফসল নষ্ট হয়েছে এবং সেইসাথে ফলন কমে গেছে। ঝড়, নদী ভাঙন, বন্যা এবং খরা এদেশে ঘন ঘন আক্রমণ করছে, যা কৃষকদের পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। স্থিতিস্থাপক কৃষি পদ্ধতিতে বিনিয়োগ এবং শস্য বৈচিত্র্য কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমিয়ে আনতে এবং খাদ্যের দাম স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারে।

কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনগুলিকে ব্যাহত করেছে, যা বিভিন্ন পণ্যের যোগান এবং মূল্যকে প্রভাবিত করেছে। যদিও মহামারি সম্পূর্ণ মাত্রা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এদেশের আরও একটি শক্তিশালী উৎপাদন ব্যবস্থা বাংলাদেশকে এই ধরনের আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে। স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করা এবং প্রয়োজনীয় খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরতা কমাতে এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে পারে।

যদিও এটি স্পষ্ট যে বাইরে থেকে দেখা কারণগুলি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলির মূল্যবৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা স্বীকার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির বোঝা কমাতে লক্ষ্যবস্তু নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নাগরিকদের সুযোগ সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এই ব্যবস্থাগুলির মধ্যে সরাসরি নগদ স্থানান্তর বা দুর্বল জনসংখ্যার জন্য ভর্তুকি, অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বাধিক প্রান্তিকদের রক্ষা করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জালে বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

তা ছাড়াও সরবরাহ শৃঙ্খলে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধি মুনাফাখোরদের বাধা দিতে এবং ভোক্তাদের ক্ষতি কমাতে সহায়তা করতে পারে। ন্যায্য নয় এমন মূল্যবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলিকে অবশ্যই বাজারের কার্যক্রম নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চলমান মূল্যবৃদ্ধি শুধু একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নয়; এটি একটি মানবিক সংকট, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা এবং সরাসরি সরকারি সহযোগিতাসহ সম্মিলিত পদ্ধতির প্রয়োজন। এখন সময় এসেছে সরকার থেকে সুশীল সমাজ পর্যন্ত সকল স্টেক হোল্ডাররা টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার জন্য একত্রিত হওয়া এবং কোনো বাংলাদেশি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ঊর্ধ্বগতির কারণে যাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে না যায় সেটি নিশ্চিত করা। এর উপর নির্ভর করছে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ।

লেখক একজন সাংবাদিক।

[email protected]

 

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ