রাষ্ট্রব্যবস্থাটাই এমন নড়বড়ে গত তিপান্ন বছর ধরে তো কিছুই দাঁড়ায়নি
জি এইচ হাবীব বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য অনুবাদক। তার অনূদিত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’, উমবের্তো একোর ‘গোলাপের নাম’, ইয়স্তেন গার্ডারের ‘সোফির জগত’, আইজ্যাক আসিমভের ‘ফাউন্ডেশন’, ব্রিজিত ভাইনির ‘ইংরেজি ভাষার ইতিহাস’ ইত্যাদি গ্রন্থ দুই বাংলায়ই সমাদৃত। বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। আপাত অর্থে তিনি অনুবাদক নন, একজন নিরলস সাধক। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার তিনি অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। পুরস্কার প্রাপ্তির অনুভূতি ও অনুবাদ সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে তার সঙ্গে কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক কামরুল আহসান।
ভিউজ বাংলাদেশ: প্রথমেই আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, এবার অনুবাদ সাহিত্যে আপনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন। যদিও এই পুরস্কার আপনাকে অনেক আগেই দেয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও বাংলা একাডেমি আপনাকে সম্মান জানাতে পারল। আপনার অনুভূতি আমাদের সঙ্গে ভাগ করার অনুরোধ করছি।
জি এইচ হাবীব: অনেক ধন্যবাদ। অনুভূতি তো অবশ্যই খুশি হয়েছি। স্বীকৃতি পেলে কে না খুশি হয়। কিন্তু পুরস্কার নিয়ে এবার যে অনাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল, খুশি অনেকখানিই ম্লান করে দিয়েছে। এতে দুঃখ পেয়েছি। এই হচ্ছে ব্যাপার, অনুভূতি বলতে সেটাই।
ভিউজ বাংলাদেশ: এবার পুরস্কার নিয়ে যে অনাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল তা নিয়ে আপনি কোনো মন্তব্য করতে চান?
জি এইচ হাবীব: মন্তব্য হলো এটাই যে, এই অনাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটাই উচিত ছিল। তার মানে হচ্ছে, বাংলা একাডেমি যে তালিকাটা ঘোষণা করেছিল, সেখানেই তারা স্থির থাকতে পারত। তার কারণ এখানে তো কোনো ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে এই তালিকা নির্মিত হয়নি। একটা দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে এটা করা হয়েছে, এখানে নানাজনের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে; সুতরাং এখানে স্থির থাকা দরকার ছিল। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, সব ধরনের পুরস্কার নিয়েই বিতর্ক হয়। এরকম পুরস্কার সাধারণত কম দেখা যায় যেটা নিয়ে বিতর্ক হয়নি। কারণ সবাইকে খুশি করা সম্ভব না।
ঘোষণা দেয়ার পরও যাদের নাম বাদ পড়েছে তাদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বলে আমি মনে করি। তাদের নাম বাদ দিয়ে তাদের একধরনের মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক হেনস্তার মধ্যে ফেলা উচিত হয়নি। বাংলা একাডেমি যে তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অটল থাকতে পারেনি সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। ঘোষিত তালিকাতেই তাদের স্থির থাকা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হোক বা সশরীরে বাংলা একাডেমিতে গিয়ে যারাই প্রতিবাদ করুক, সেই প্রতিবাদ করার অধিকার তাদের আছে; কিন্তু সেই মব-জাস্টিসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা একাডেমির এটা করা উচিত হয়নি। বাংলা একাডেমির এটা মনে রাখা উচিত ছিল, বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের জন্য পারিবারিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে স্বীকৃতি একটা বড় ঘটনা। সেটা তাদের বই বিক্রির ব্যাপারে সাহায্য করে; তাদের যে সাধনা থাকে, সেটার জন্য তারা কী পান? বাংলাদেশে তো বইপত্র খুব একটা বিক্রি হয় না। কেউ সেসব বই নিয়ে রিভিউ করে না, কথাবার্তা বলে না, যদি না বিশেষ কোনো দলভুক্ত হয়। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের পুরস্কারের একটা বড় ভূমিকা আছে। তারা সারাজীবন কাটান এর সাধনায়। তারা অনেক কিছুই করতে পারতেন সে সময়; অলাভজনক এই কাজ না করে তারা এমন কিছু করতে পারতেন যাতে আর্থিকভাবে উপকৃত হতে পারতেন।
অন্য কিছু না করে তারা যে সাহিত্যসাধনা করছেন; আমি এমন কিছু বলছি না যে, যারা সাহিত্য করেন তারা সবাই ধোয়া তুলসি পাতা; তারা দলাদলি করেন না, বা তারা স্বৈরাচারের দোসর থাকেন না, বা ইত্যাদি ইত্যাদি; সেটা আমি বলছি না, আমি ইন জেনারেল বলছি, ফলে তাদের মূল্যায়ন যখন করছেন তখন আমার মনে হয় খুব সাবধানে করা উচিত ছিল। মূল্যায়ন যখন করে ফেলেছে তখন সেখান থেকে সরে যাওয়াটা একটা অবিবেচনাপ্রসূত কাজ হয়েছে বলে আমি মনে করি।
এ ক্ষেত্রে আমার প্রিয় কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে, Tread softly because you tread on my dreams. আপনি আমার স্বপ্নের ওপর দিয়ে হাঁটছেন বা স্বপ্নের ওপর পা দিয়ে চলে যাচ্ছেন; সেখানে খুব নরমভাবে পা ফেলবেন বলেই তিনি আশা করছেন।
এ ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা তাই। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে কি, বাংলা একাডেমি রাষ্ট্রীয় একটা প্রতিষ্ঠান। সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের একটা অংশীদারিত্ব আছে। এটা যদি কোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান হতো সেটা নিয়ে কোনো কথার অধিকার আমার থাকত না, বা ভাবতাম না; কিন্তু, যেখানে আমার অংশীদারিত্ব আছে সেখানে একজন সাহিত্যিক হিসেবে, একজন নাগরিক হিসেবে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আমার কিছু বলার থাকতেই পারে। এটা নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার আছে বলে মনে হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: অনেকেই বলছিলেন পুরস্কারাপ্রাপ্ত সবার এবার এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিল। এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত কি জানাতে চান?
জি এইচ হাবীব: প্রত্যাখ্যান করলে কী হতো? প্রত্যাখ্যান করলেই কি বাংলা একাডেমি যে পদ্ধতিতে পুরস্কার দেয় সেটা বদলে যেত? ঘটনা তো সেটা না। এখন আপনি অভিমান করে সরে গেলেন, মূল জায়গায় হাত দিলেন না; তখন তো সেখানে আরও বেনোজল ঢুকবে। তাই না? এটাই আমার মনে হয় সব মিলিয়ে, বাংলা একাডেমির আসলে তাদের রায়ে স্থির থাকা উচিত ছিল।
ভিউজ বাংলাদেশ: আরেকটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকরা বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা এবং উপদেষ্টাদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন, এটা নিয়েও খুব সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
জি এইচ হাবীব: এই রেওয়াজটা বাংলা একাডেমিতে বা বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে আছে, এটা দৃষ্টিকটু সেটা ঠিক; এর জন্য তো যারা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা দায়ী না। এই রেওয়াজটা যারা তৈরি করেছেন তারা দায়ী। ওই মুহূর্তে স্টেজ থেকে নেমে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। যারা পুরস্কারটা নিয়েছেন ওই মুহূর্তে তাদের করার কিছু ছিল না। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু বটেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: পুরস্কার গ্রহীতাদের সমালোচনা করা হচ্ছে না, সমালোচনা করা হচ্ছে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ও উপদেষ্টাদেরই।
জি এইচ হাবীব: না, পুরস্কারপ্রাপ্তদের বিশেষ একজনকে টার্গেট করে ট্রল করা হচ্ছে, যে তিনি এত বিপ্লবী, তিনি কেন এটা মেনে নিলেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকমও বলা হয়েছে, তিনি যেহেতু অনেক বিপ্লবাত্মক কথাবার্তা বলেন তার জন্য এটা একটা শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে, এরকম কথাও শুনেছি আমি। হ্যাঁ, বাংলা একাডেমিকেও সমালোচনা করা হয়েছে। তবে, এই সমালোচনার একটা পজিটিভ দিক হচ্ছে, পরবর্তীতে এই দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা আর হয়তো ঘটবে না। এই প্রথার পরিবর্তন হবে। সংস্কৃতি উপদেষ্টার কথায় এরকমটাই দেখলাম, এর পর যে একুশে পদক দেয়া হবে সেখানে এই ধরনের অবমাননাকর ফটোসেশন আর হবে না। আমার ধারণা, এর পর অন্যান্য জায়গায় যে ফটোসেশন হবে তারাও এটা মাথায় রাখবেন।
ভিউজ বাংলাদেশ: এবার একটু আপনার ব্যক্তিগত লেখালেখির জীবনে প্রবেশ করি। অনুবাদক হিসেবে আপনি তো বাংলাদেশে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি অর্জন করেছেন, আপনার দীর্ঘযাত্রা সম্পর্কে সংক্ষেপে আমাদের একটু বলুন। কেন অনুবাদে ঝুঁকলেন, কীভাবে শুরুটা করলেন?
জি এইচ হাবীব: প্রথমে ‘কিংবদন্তিতুল্য’ শব্দ নিয়ে আমার আপত্তি আছে। সেরকম কিছু না। বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই অনুবাদ করেছি বলে পাঠক আমাকে ভালোবাসেন। ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন। কীভাবে যাত্রা করলাম এ নিয়ে আগের কিছু সাক্ষাৎকারে বলেছি। সেটা হচ্ছে যে, একটা পরিবারে দেখা যায় একটা শিশু ছোটবেলা থেকেই সেসব বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয় যেগুলো তাদের পিতামাতাকে বা আশপাশের দু-একজনকে করতে দেখে। সাহিত্যচর্চা করেন এমন কাউকে আমি আমার পরিবারে দেখিনি। বা বই পড়ার সংস্কৃতিও খুব একটা ছিল না। তবে কোনো না কোনোভাবে আমি বইয়ের সংস্পর্শে এসেছিলাম এবং সেসব বই ছিল অনুবাদ। অনুবাদ ছিল, সেইসঙ্গে অন্যধরনের কিছু বই ছিল- রোমাঞ্চকর, যেমন রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর, তারপর কুয়াশা সিরিজ, মাসুদ রানা- এ ধরনের কিছু বইপত্র পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সেবা প্রকাশনী থেকে যেসব বই প্রকাশিত হতো সেগুলো তো অনুবাদ বা এডাপটেশন; তারপর রাশিয়া থেকে যেসব বইপত্র আসতো, প্রগতি বা রাদুকার সেগুলোও অনুবাদ, সেগুলো পড়ার পরে এবং সেবা প্রকাশনীর ক্ল্যাসিক বইয়ের অনুবাদ বা এডাপটেশনগুলো পড়ার পরে আমার মনে হলো অনুবাদই যেহেতু বেশি পড়েছি তাহলে আমি বোধহয় অনুবাদ করার দিকে একটু চেষ্টা করতে পারি। অনুবাদ না পড়ে আমি যদি মূলধারার বইগুলো বেশি পড়তাম তাহলে হয়তো চেষ্টা করতাম মৌলিক লেখালেখির।
ভিউজ বাংলাদেশ: মৌলিক লেখার চেষ্টা করেছিলেন কি কখনো?
জি এইচ হাবীব: একেবারেই যে চেষ্টা করিনি তা না, কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। ক্যাডেট কলেজে যখন পড়েছি, ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টুয়েলভ তখন কিছু চেষ্টা করেছি; কিন্তু প্রধান প্রবণতা ছিল অনুবাদের দিকেই। মৌলিক লেখার দিকে ঝোঁকটা যায়নি।
সেই শুরু আর কি, তারপর সেবা প্রকাশনীর রহস্য পত্রিকায় আমার কিছু অনুবাদ গল্প প্রকাশিত হলো। আরেক ধাপ এগিয়ে সেবা প্রকাশনী থেকে বইয়ের অনুবাদ বের হলো- শার্লক হোমসের একটা গোয়েন্দাকাহিনী- দ্য সাইন অফ ফোর। তারপর একটা সায়েন্স ফিকশন। তারপর আস্তে আস্তে মূলধারার সাহিত্য অনুবাদের দিকে ঝোঁকটা চলে যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি তো বেশ কিছু চ্যালেজিং কাজ করেছেন। বিশেষ করে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর, উমবের্তো একোর গোলাপের নাম, ইয়স্তেন গার্ডারের সোফির জগৎ, তো কোন কাজটা করতে গিয়ে আপনি বেশি চ্যালেঞ্জ বোধ করেছেন?
জি এইচ হাবীব: আমার মনে হয় গোলাপের নামটাই এ ক্ষেত্রে প্রথমে আসবে। তার কারণ, বইটির যে বিষয়বস্তু, যে ভাষা এবং সেখানে যে ধরনের প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে; তা যেমন জটিল ও তেমনি আকর্ষণীয়। ভাষাটিও আকর্ষণীয় ছিল; কিন্তু সেটা বাংলায় পরিবেশন করা খুবই কষ্টদায়ক বা পরিশ্রমসাধ্য ছিল। যদিও কষ্টের তুলনায় আনন্দও ছিল অনেক। আনন্দদায়ক না হলে কাজটি আমি করতে পারতাম না।
ভিউজ বাংলাদেশ: আনন্দ ছিল; কিন্তু আপনার যে বিপুল শ্রম তার তুলনায় তো এ দেশে প্রাপ্তি খুব কম। অর্থনৈতিক প্রাপ্তিও কম, বইও যে খুব বেশি বিক্রি হয় তা না। আপনি কখনো হতাশ বোধ করেছেন কি না এই দীর্ঘ যাত্রায়, যে কী আর হবে এসব করে?
জি এইচ হাবীব: হতাশা আসেই। মানুষের জীবনে হতাশা যে আসে না তা না। আমিও যে হতাশ মাঝেমধ্যে হয়ে যাই না তা না। আবার যখন দেখা যায় যখন কোনো একটা ভালো বই পড়ি, তখন মনে হয় এই বইটা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে একটা পরিতৃপ্তি পাব তখন আর হতাশাটা খুব একটা কাজ করে না। এটা একটা রোগ। একটা ব্যাধি। নিরাময়-অযোগ্য ব্যাধি। যার কোনো চিকিৎসা নেই। এটা হয়তো জিনগত ব্যাপার। সারা জীবনই থাকবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশের বর্তমান অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আপনার কী অভিমত? কী হচ্ছে, কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
জি এইচ হাবীব: বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আমার শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ স্যার একটা কথা বলেছিলেন, বাংলাদেশে অনুবাদ হচ্ছে এটাই তো একটা বড় কথা। এর মানটান নিয়ে আর এত ভাবাভাবির কী আছে!
বাংলাদেশের সার্বিক দিক বিবেচনা করেই তিনি সম্ভবত কথাটা বলেছিলেন। এখানে যে ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে অস্থিরতা সব মাথায় রেখেই সম্ভবত তিনি এই মন্তব্যটা করেছিলেন। এই দুঃখজনক মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে অনুবাদ খুব একটা পরিকল্পনা বা দূরদৃষ্টির মাধ্যমে করা হয় না। যদি করা হতো তাহলে হয়তো রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো একটা ব্যবস্থা করা হতো। যার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য ভাষা থেকেও প্রচুর অনুবাদ পেতাম। মূল ভাষা থেকে অনুবাদ পেতাম। আমাদের এখানে সেসব অনুবাদ হয় তার ৯৯ শতাংশ বই ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ হয়। যে দোষে আমিও দোষী। কিন্তু ইংরেজি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানা লোক নেই বলে আমরা তো থেমে থাকতে পারি না। একদিকে অন্য ভাষা শেখার চেষ্টা চলবে; এর সঙ্গে ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদও চলবে। এভাবে একদিন আমরা অন্য ভাষা থেকে অনুবাদের লোকজন পেয়ে যাব।
আরেকটা ব্যাপার, যান্ত্রিক যে ব্যাপারগুলো ঘটছে, প্রযুক্তির যে নতুন নতুন উদ্ধাবন; তাতে করে অনুবাদশিল্প কোন দিকে যাবে তার একটা সংকটাপন্ন চেহারাই বোধহয় আমি দেখতে পাচ্ছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের দরিদ্রতার কারণ কী?
জি এইচ হাবীব: এ ক্ষেত্রে আমি বলব রাষ্ট্রের একটা বিশাল দায় আছে। রাষ্ট্রব্যবস্থাটাই এমন নড়বড়ে, এই যে গত পঞ্চাশ-তিপান্ন বছর ধরে তো কিছুই দাঁড়ায়নি। আমাদের দেশে তো শিক্ষাই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অনুবাদের সঙ্গে তো শিক্ষা, ভাষার প্রতি আনন্দের বা পড়াশোনার বা সংস্কৃতির একটা যোগ আছে। কিন্তু গত ১৫ বছর ধরে বা সম্প্রতি আমরা দেখছি বই পড়ার সংস্কৃতিটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এরকম একটা অবস্থায়, যেখানে গ্রন্থাগার নেই বা গ্রন্থাগার থাকলেও দলীয় বইপত্র কিনে ভর্তি করে রাখা হয় সেখানে পাঠকের আগ্রহ তো থাকার কথা না। অথচ দোষটা দেয়া হচ্ছে সাধারণ পাঠককে, যে এই জেনারেশন কোনো বইপত্র পড়ে না। তাদের সামনে কিন্তু কোনো বইপত্র নেই।
পৃথিবী এখন কোথায় চলে গেছে, কত আকর্ষণীয় বই চারদিকে, তাদের সামনে সেসব বই নেই। আমাদের পাঠ্যপুস্তকেরও ভগ্নদশা। আকর্ষণীয় বই একটু দাম দিয়ে কিনে দেয়ার সঙ্গতি অনেক বাবা-মার থাকে না। আমাদের জীবনযাত্রা এখন এমন জায়গায় চলে গেছে যে, জীবনের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ ছাড়া আর কোনো কিছু নিয়ে আমরা ভাবতে পারি না।
শিক্ষা বলতে যে আমরা শুধু ভালো ফলাফল বুঝি, সে দিকে বাচ্চাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে এরও একটা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমি আছে। অভিভাবকরা এমনি এমনি সেটা করেন না। তারা দেখছেন যে, যদি একটা ভালো চাকরি না পাওয়া যায় তাহলে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে যে দুর্বিষহ অবস্থা- সেখানে তো অনুবাদ আর এমনি এমনি ভালো হতে পারে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে