আফ্রিকান ‘গদার’ হায়নার গল্প
আফ্রিকান সিনেমা সম্পর্কে যদি আপনার ভালো ধারণা থাকে, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই সেনেগাল চলচ্চিত্রকার এবং ঔপন্যাসিক ওসমানি সেম্বেনেকে চিনেন। তাকে বলা হয় আফ্রিকার সিনেমার জনক। সমসাময়িক আরও কজন চলচ্চিত্রকারকে আপনি চিনবেন- মালির সোলেইমান সিসে, নাইজেরিয়ার উমারু গান্ডা এবং মৌরিতানিয়ার মেড হোন্ডোকে। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল। এতসব উজ্জ্বল নক্ষত্রের ভিড়ে সেনেগালের চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি জিব্রিল ডিওপ মামবেটি স্পষ্টতেই আলাদা। তাকে বলা হয় ‘আফ্রিকার জাঁ-লুক গদার’। যদি তিনি নিজে কখনো গদারের সঙ্গে দেখা করেননি।
গত বছর মামবেটির সবচেয়ে বিখ্যাত সিনেমা ‘তাওকি বাওকি’র পঞ্চাশতম বার্ষিকী পালন করা হয়। ১৯৭৩ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। এটা ছিল মামবেটির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এর কাব্যিক সৌন্দর্য এবং বিপ্লবী গল্প বলার শৈলী অসামান্য। সিনেমাটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কার এবং একই বছর মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ফিপ্রেসি পুরস্কার অর্জন করেছিল। ছবিটি এখনো আফ্রিকার সেরা একটি ছবি হিসেবে বিবেচিত; কিন্তু এই ছবিটির তাৎপর্যপূর্ণ কী?
সেনেগালের ভাষায় ‘বাওকি’ মানে ‘হায়না’। তাওকি বাওকির বাংলা হলো ‘হায়নার যাত্রা’। আফ্রিকার লোকগল্প থেকে নামটি অনুপ্রাণিত। হায়েনার একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কখনো তার অঞ্চল ছেড়ে কোথাও যায় না। এই ছবিতে আমরা মোরি (মেগেই নিয়াঙ্ক) নামে একজনকে দেখি, গরুর শিং আটকানো একটি মোটরসাইকেল নিয়ে যে সারাক্ষণ ঘোরে। আফ্রিকায় গরু এক অপরিহার্য সম্পদ। কৃষি জীবনধারার প্রতীক। মোরির মোটরসাইকেল আফ্রিকার পরিচয় বহন করে। সে এর রাখাল।
চলচ্চিত্রটি শুরু হয় এভাবে- এক অল্প বয়সি রাখাল গরুর পাল নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তখন দেখি কয়েকটি গরুকে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানে তাদের গলা নৃশংসভাবে কাটা হচ্ছে- একটি অস্বস্তিকর দৃশ্য; কিন্তু কেন মামবেটি এমন একটি দৃশ্যধারণ করলেন?
উত্তর-ঔপনিবেশিক সেনেগালের রূপক হলো কসাইখানা। যেখানে নতুন স্থানীয় শাসকশ্রেণি প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশকারীদের জায়গা দখল করেছে। দেশকে তারা কসাইখানায় পরিণত করেছে। এই বর্বরতা থেকে বাঁচতে মরিয়া হয়ে অনেক তরুণ ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। বিশেষ করে ফ্রান্সে। মোরিও তার বান্ধবী আন্তার (মারেমে নিয়াঙ্ক) সঙ্গে প্যারিসে পালানোর স্বপ্ন দেখে; কিন্তু ঋণের ভারে তার জীবন জর্জরিত। তার জীবন পতিত হয় চুরি-ডাকাতি এমনকি পতিতাবৃত্তির মধ্যে।
প্যারিসের ফ্যান্টাসিতে ভুগে ভুগে যখন তারা অপরাধ বোধে জড়িয়ে পড়ে, তখন পেছনে বারবার বেজে ওঠে জোসেফাইন বেকারের একটি ফরাসি গান- ‘প্যারিস, প্যারিস, স্বর্গের মধ্যে আরেকটি স্বর্গ!’ শেষ পর্যন্ত মোরির স্বপ্ন ভেঙে যায়। তিনি আসলে ভূমিতে আবদ্ধ রাখালের মতো। প্যারিসের উদ্দেশে রওনা হওয়ার মুহূর্তে তিনি ফিরে আসেন ডাকারে। স্থানীয় বুর্জোয়াদের দেখানো স্বপ্নের বিভ্রম যখন তরুণ-তরুণীদের মনে ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই মামবেটি এই ছবিটি বানিয়েছিলেন।
এটাও মনে রাখা দরকার যে, মামবেটি সেনেগালের বিপ্লবী ইয়া ডিকোনোর ভক্ত ছিলেন, যিনি ছিলেন অনেকটা রবিন হুডের মতো। তার চলচ্চিত্র তাওকি বাওকির সম্পাদনা এবং গল্প বলার ধরন সবই বিপ্লবী। একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে যে, মোরি মার্কিন পতাকা শোভিত সুন্দর একটি গাড়িতে ঘুরছেন, হঠাৎ পোশাক খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যান। নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নগ্নতাই দেখানো হয়েছে এতে। আরেকটি দৃশ্যে, মোরি এবং আন্তা ধনী ইউরোপীয়দের মতো কাজ করে, তাদের মনোরঞ্জন করার জন্য স্থানীয়রা যখন নাচে-গান গায়, তখন তারা চারপাশে টাকা ছিটাতে থাকে। এই দৃশ্যগুলোর মধ্য দিয়ে মামবেটি নব্য ধনীদের অবস্থা যেমন তুলে ধরেছেন, অন্য দিকে সাধারণ মানুষের মানসিক দারিদ্র্যতাও ফুটিয়ে তুলেছেন।
অন্যদের মতো মামবেটিরও চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা ছিল না। তিনি তার প্রথম ছবিটি বানিয়েছিলেন ২৮ বছর বয়সে। অনেকটাই অপুট তখন। তাও তার ছবিতে ছিল কাব্যিক আর সামাজিক ভাবনার সংমিশ্রণ। এমন একটি দৃশ্য কল্পনা করুন- মোরি আর আন্তার মিলন মুহূর্তে একটি অবোধ প্রাণীর গলা কাটা হচ্ছে। কতটা নির্বিঘ্নে মামবেটি একসঙ্গে বেঁধেছেন।
মামবেটি তার সারাজীবনের চলচ্চিত্রজীবনে মাত্র দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য এবং পাঁচটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। তাও তিনি আলোচনা দাবি করেন। অল্প কিছু সৃষ্টির মাধ্যমেই মামবেটি চলচ্চিত্র ইতিহাসের একটি স্বতন্ত্র দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সেনেগালের চলচ্চিত্র-পণ্ডিত দিয়া থিয়ের্নো ইব্রাহিমা একবার বলেছিলেন, ‘সেম্বেনের কাজ যেন বাস্তবতার ধমনী। লুই লুমিয়েরের মতো সেম্বেনের কাজের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল বাস্তবতার চিত্র। যেখানে মামবেটি ছিলেন মেলিয়াসের মতো কাব্যিক, জাদুময় আর বাস্তববাদী।’
বিধান রিবেরু: চলচ্চিত্র সমালোচক, বিচারক, ফিপ্রেসি, কান চলচ্চিত্র ৭৫তম উৎসব।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে