মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চম বাহিনী
তিব্বতি সেনাদের অজানা বীরত্বগাঁথা
১৯৭১ সালে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল চট্টগ্রাম। সমুন্দ্রবন্দর, মিয়ানমার সীমান্ত, পাহাড়, ঘন বনাঞ্চল ও বিদ্রোহী মিজোদের সহযোগিতার কারণে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে এটি ছিল একটি ভিনটেজ পয়েন্ট। যে কারণে যুদ্ধদিনে এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে সব ধরনের চেষ্টাই করেছে পাকিস্তান। আর অন্যদিকে কৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ এই জায়গা দখলের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। বিশেষ করে চীনের প্রভাববলয়ে থাকা মিয়ানমারের সঙ্গে যে কোনো ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করতে চট্টগ্রামের দখল বা নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি ছিল যৌথ-বাহিনীর কমান্ডারদের কাছে।
মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনীর পাশাপাশি এই চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিতে অত্যন্ত গৌরবজনক ভূমিকা ছিল পঞ্চম বাহিনী নামে পরিচিত একটি বাহিনীর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিক্রমায় যে বাহিনীর অবদান ও আত্মত্যাগ অনেকটায় অনুচ্চারিত, কম আলোচিত। যদিও যুদ্ধের শেষ দিকে কৌশলগত আরাকান সড়কের দখল নিয়ে এ কে নিয়াজীকে দ্রুত আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল এই বাহিনী। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে সড়ক পথ বন্ধ হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ ভিন্ন আর কোনো পথ খোলা ছিল না। পালানোর স্থল পথও ছিল বন্ধ। পঞ্চম বাহিনী নামে পরিচিত এই বাহিনীটি গঠিত হয়েছিল তিব্বতের যুবাদের নিয়ে গঠিত স্পেশাল ফন্ট্রিয়ার্স ফোর্সের সদস্যদের নিয়ে। যারা একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বীরবিক্রমে যুদ্ধে করেছেন। নিজের যুদ্ধ অন্যদের জন্য যুদ্ধ করেছেন। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর অন্তত ৫০ জন সেনা শহীদ হন, গুরুতর আহত হয়েছিলেন অন্তত ২০০ জন। ডিসেম্বরে পাহাড় জঙ্গল থেকে এই বাহিনী যখন প্রকাশ্য লোকালয়ে চলে আসে তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ভূত দেখার মতোই চমকে উঠেছিলেন। যে কারণে অনেকেই এই বাহিনীকে উল্লেখ করেন ফ্যান্টমস্ অব চিটাগং বা চট্টগ্রামের ভূত নামে। আলোচিত এই বাহিনীর মূল কারিগর ছিলেন মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান।
এস এস এফ, পঞ্চম বাহিনী ও জেনারেল এস এস উবান
এই বাহিনীর জন্ম ইতিহাস জানতে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ শেষে ১৯৪৯ সালে চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতা সংহত করেন কমিউনিস্ট নেতা মাও-সে-তুং। এরপর এক বিতর্কিত চুক্তির মাধ্যমে পৃথীবির ছাদ হিসেবে পরিচিত তিব্বতে নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করে বেইজিং। এর আগে তিব্বত শত শত বছর ধরে স্বাধীন এক রাজ্য ছিল। এ ছাড়া তিব্বত প্রাকৃতিক সম্পর্কে পরিপূর্ণ এক পাহাড়ি অঞ্চল। যেখানে মাও সে তুং-এর চীন নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারে ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চালায়। যদিও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে চুক্তির শর্ত ও বিশ্বাসভঙ্গের। এক পর্যায়ে দালাইলামার সরকার ভারতের ধর্মশালায় আশ্রয় নেয়। জোরদার হয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এমন বাস্তবতায় ১৯৫৯ সালে চীন তিব্বতে সামরিক আগ্রাসন চালায়। শুরু হয় চরম দমনপীড়ন। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে তিব্বতিদের মন্দির ও সংস্কৃতির বহু নিদর্শন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে দলে দলে তিব্বতিরা আশ্রয় নিতে শুরু করেন ধর্মশালায়। এদিকে ধীরে ধীরে তিব্বতীয় যুবাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। এর মধ্যেই ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ বেঁধে যায়। যে যুদ্ধে বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় ভারত। বলা যায়, এই যুদ্ধে চীনাদের কাছে প্রবলভাবে মার খায় ভারতীয় সেনারা। এরপর ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতি যুবাদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করে। যে বাহিনীর নাম হয় ‘স্পেশাল ফন্ট্রিয়ার্স ফোর্স’, সংক্ষেপে এস এফ এফ। এই বাহিনী গড়ে তুলতে দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষ অফিসার এসএস উবানকে। তার তত্ত্বাবধায়নে এই বাহিনীটি যাত্রা শুরু করে ১৯৬২ সালের ১৪ নভেম্বর। যাতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সুজান সিং উবান বা এস এস উবান ছিলেন কমান্ডো ট্রেইনিংপ্রাপ্ত, গেরিলা যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষভাবে পারদর্শী এক সেনা কর্মকর্তা। একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে ব্রিটিশ বাহিনীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। একজন অভিজ্ঞ ও যোগ্য কামান্ডার হিসেবে শুরু থেকেই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই এস এফ এফ গড়ে তোলেন উবান। দেরাদূনে ছিল এই বাহিনীটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বাহিনীটির সদস্যদের চীনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের পরিকল্পনা থাকলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তান। এতে শরণার্থী চাপ বেড়ে যায় ভারতে। যার ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানামুখী তৎপরাতার মধ্যে বিশেষ এই বাহিনীকে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এ সময় বাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বাহিনী প্রধানের কাছে চিঠি লিখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
তিব্বতীয়রা বা এস এফ এফ সদস্যরা শারীরিক গঠনে ছিলেন পাহাড়ি মিজোদের মতো। এ ছাড়া তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। একই সঙ্গে তারা খুব নিখুঁতভাবে ভবিষ্যতের বিপদ আঁচ করতে পারতেন বা বলা যায় বিপদের গন্ধ পেতেন। যে কারণে এই বাহিনী সেনারা ছিলেন গেরিলা যুদ্ধের জন্য একেবারে যথাপোযুক্ত।
চট্টগ্রামের ভূতের দুঃসাহসী অভিযান
এস এফ এফ বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রামে যে অভিযান পরিচালনা করে যার নাম ছিল ‘অপারেশান ঈগল’। যে অভিযানের মূল দায়িত্বে রণাঙ্গনে ছিলেন সুজান সিং উবান। ১৯৭১ সালের মধ্য অক্টোবরে এই বাহিনী ‘অপারেশান ঈগল’-এর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মূলত তিনটি ভাগে এই বাহিনীটি বাংলাদেশে অভিযানে যায়। বাহিনীর প্রথম দলের লক্ষ্য ছিল দক্ষিণের আরাকান মহাসড়কের দখল নেওয়া, দ্বিতীয় দলটি পাঠানো হয় কাপ্তাই-চট্টগ্রাম রোডে আর তৃতীয় দলটির লক্ষ্য ছিল রাঙামাটি-চট্টগ্রাম রোড দখল নিয়ে চট্টগ্রামকে ঘিরে ফেলা। মুক্তিযুদ্ধে ফলাফল নির্ধারণী এই অভিযানে নিয়মিত মুক্তিবাহিনী অর্থাৎ সেক্টর-১-এর সদস্যদের পাশাপাশি মুজিবাহিনীর যোদ্ধারাও অংশ নেন। সমন্বিত এই বাহিনীটি ১১ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তীরকে লক্ষ্য করে অভিযান শুরু করে। তাদের ধারণা ছিল কর্ণফুলী নদীর তীরে পাকিস্তানিরা শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। যদিও বিনা বাধায় তারা কর্ণফুলী নদীর তীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। অন্যদিকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে তারা বরকল দখল করে নেয়। এরপর দখলে আসে খাগড়াছড়ি। পরের দিনগুলোতে বাহিনীটি দখলে নেয় শুভলং খাল, কাশিলং খাল ও পুরোপুরি রাঙামাটি। কৌশলগত এই জায়গাগুলো দখলে যোদ্ধাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যুদ্ধে শহীদ হন ২০ জনের বেশি তিব্বতি যোদ্ধা। এদিকে সর্বাত্মক যুদ্ধের শেষ দিকে ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় শীর্ষ সেনা নেতৃত্ব কঠোর বার্তা পাঠায় আরাকান রোড বন্ধ করে দেয়ার জন্য। কারণ পলায়নপর পাকিস্তানি সেনারা এই সড়ক ব্যবহার করে মিয়ানমারে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। পাকিস্তানি সেনারা যখন দোহাজারি ব্রিজ অতিক্রম করতে যায়, তখন এস এফ এফ ও মুজিববাহিনীর সেনাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পড়ে। সর্বাত্মক এই আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একেবারে হতভম্ভ হয়ে পড়ে। পিছু হটে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর তখন কোনো উপায় ছিল না নিয়াজী বাহিনীর।
এদিকে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পর জেনারেল উবানের নির্দেশে প্রকাশ্যে আসে এস এফ এফ-এর তিব্বতি সেনারা। হঠাৎ করেই সুসজ্জিত এই বাহিনীর সদস্যদের দেখে চট্টগ্রামের মানুষ অবাক হয়ে যান। তারা ভূত দেখার মতো বিস্মিত হন; কিন্তু জেনারেল উবান তার এই বাহিনীকে বেশিক্ষণ প্রকাশ্যে রাখেননি। কিছু সময় পরই জেনারেল স্যাম মানেক শ-এর নির্দেশে আবার জঙ্গলে মিলিয়ে যান তিব্বতি গেরিলারা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য এস এস এফ বা পঞ্চম বাহিনীর ৫৮০ জন সেনাকে বিশেষ পদক দেয় ইন্দিরা গান্ধী সরকার। যদিও বাংলাদেশে তাদের অবদানের কথা অনেকেই কথা জানেন না। যে ভিনদেশি গেরিলারা বাংলাদেশের যুদ্ধকে নিজেদের যুদ্ধ জ্ঞান করে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন তাদের অবদান স্বীকার করা আমাদের ঐতিহাসিক দায়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে