Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বিচারালয়ে বেড়েছে বাংলার প্রচলন

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ঢাকা হাইকোর্ট স্বাধীনতার পর হয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। এই হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে যুগ যুগ ধরে ইংরেজি ভাষায়ই বিভিন্ন মামলার রায় লেখা হচ্ছে। নিম্ন আদালতও এর ব্যতিক্রম নয়। দীর্ঘদিনের প্রথা ও রায় লেখার ক্ষেত্রে জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনার কারণে ইংরেজিতে রায় লেখা হয়ে আসছে। তবে ভাষা শহীদদের ও বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে অনেক বিচারকই এখন বাংলায় রায় দিচ্ছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত অনেক মামলার রায় বাংলায় প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। পিলখানা হত্যা মামলার ২৯ হাজার পৃষ্ঠার রায় ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায় এর মধ্যে অন্যতম। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারপতিদের বাংলায় রায় লেখার উদ্যোগ উৎসাহব্যঞ্জক এবং ইতিবাচক। সর্বোচ্চ আদালতে মাতৃভাষা বাংলার আরও বেশি প্রচলনে উদ্যোগ নেয়া উচিত।
এদিকে, ভাষার মাসের প্রথম দিনে গত ১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের পৃথক দুটি বেঞ্চ। বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১ ফেব্রুয়ারি একটি মামলায় (সিভিল রিভিশন) বাংলায় রায় ঘোষণা করেন। একই দিন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ দুটি মামলায় বাংলা ভাষায় রায় দিয়েছেন। ওই দিন আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে সকালে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন আজ। আমরা আজ বাংলা ভাষায় সিদ্ধান্ত দেব।’ অন্যদিকে, চলতি ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বাংলায় আদেশ ও সিদ্ধান্ত দেয়া শুরু করেন, যা আপিল বিভাগে দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথম।

গত বছর থেকেই ইংরেজি ভাষায় দেয়া সুপ্রিম কোর্টের সব রায়-আদেশ বাংলা ভাষায় দেখাতে প্রযুক্তিসেবা সংযোজন করা হয়েছে। তাই গত ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ওয়েবসাইটে সুপ্রিম কোর্টের সব রায় বাংলায় দেখা যাচ্ছে। এ প্রযুক্তির সংযোজন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক সময়োপযোগী নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকজন আইনজীবী। এ প্রযুক্তিসেবার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ভিউজ বাংলাদেশকে জানায়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত সব রায়-আদেশ গুগলের প্রযুক্তির সহায়তায় আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, বা যে কোনো ব্যক্তি নিজে নিজেই বাংলায় অনুবাদ করে দেখতে পারছেন। এ জনমুখী প্রযুক্তি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এমনভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি ইংরেজি ভাষায় দেয়া যে কোনো রায় বা আদেশ, তা যত বড়ই হোক না কেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তা বাংলায় অনুবাদ করে দেখতে পারছেন। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন আরও জানায়, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিচারপতি নিয়মিতভাবে বাংলা ভাষায় রায়-আদেশ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত ‘আমার ভাষা’ নামে প্রযুক্তির মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত রায়-আদেশ বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে ২০২১ সাল থেকেই। দেশের নিম্ন আদালতে কিছু কিছু ক্ষেত্র ছাড়া শুনানিসহ বেশির ভাগ মামলায় রায় ও আদেশ বাংলায় দেয়া হয়। ব্রিটিশ ল-এর আধিক্যসহ নানা কারণে সুপ্রিম কোর্টে ইংরেজি চর্চা সুদৃঢ় ছিল। দিনে দিনে সুপ্রিম কোর্টে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের বাংলায় শুনানি ও যুক্তি উপস্থাপন বেড়েছে। ইংরেজির পাশাপাশি শুনানিকালে আদালতের নানা জিজ্ঞাসায়ও দেখা যায় বাংলার ব্যবহার।

প্রয়াত বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী নব্বইয়ের দশকে হাইকোর্টে বাংলায় আদেশ দেয়া শুরু করেন। এরপর সাবেক বিচারপতিদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বেশ কয়েকটি রায় বাংলায় দেন। বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, চার নদী সংরক্ষণসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় বাংলায় দেন। বর্তমানে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগে) রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালে বাংলায় রায় লিখেছেন। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি থাকাকালে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বাংলায় অসংখ্য রায় ও আদেশ দিয়েছেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথেরও (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) হাইকোর্টে থাকাকালে বাংলা রায় দেয়ার নজির রয়েছে। আপিল বিভাগের বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী হাইকোর্টে থাকাকালে বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় বাংলা রায় দেন। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের (বর্তমানে আপিল বিভাগে) নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলায় রায় ও আদেশ দেয়া শুরু করেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন বাংলায় রায়-আদেশ দিচ্ছেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল বাংলায় রায়-আদেশ দেন। বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে আরও বেশ কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহ, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী, বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান, বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান, বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে বাংলা ভাষায় রায় ও মামলা শুনানির প্রবণতা আগের থেকে অনেক বেড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অনেক কাজ বাংলা ভাষাতে হয়। এখন অনেক বিচারপতি স্বেচ্ছায় বাংলা ভাষায় রায় দিচ্ছেন। এটা ইতিবাচক পরিবর্তন। অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কারণ বাংলা ভাষায় রায় হলে সাধারণ মানুষও বুঝতে পারেন আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে কী বলতে এবং বোঝাতে চেয়েছেন।’ সর্বোচ্চ আদালতে মাতৃভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাচর্চা সমৃদ্ধ করতে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। সাইনবোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে বাংলা ব্যবহার বিষয়ে রায় রয়েছে হাইকোর্টের। যদিও এ রায় পুরোপুরি বাস্তবায়নে এখনো ঘাটতি বিদ্যমান।’ তিনি বলেন, ‘দেশের প্রচলিত আইনগুলো বাংলা ভাষায় নিশ্চিত করা গেলে বিচার বিভাগে বাংলার প্রচলন শতভাগ নিশ্চিত হবে।’

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘এক সমৃদ্ধ ও গৌরবের ইতিহাস রয়েছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার। তাই আদালতের রায় ও আদেশ বাংলায় হলে সাধারণ মানুষেরও বুঝতে সুবিধা হয়। হাইকোর্টে এখন বাংলায় রায় দেয়া বাড়ছে। ফলে বিচারপ্রার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছেন। উচ্চ আদালতসহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাকে আরও সমৃদ্ধ করতে এর চর্চা বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ইংরেজি, স্প্যানিস, চাইনিজ, জাপানিজ, জার্মানি, আরবি, হিন্দি ভাষা যেমনি বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে তেমনি আমরাও পারি বাংলাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও সমৃদ্ধ করতে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ