সালতামামি ২০২৪
প্রকৃতির রুদ্ররূপ দেখলো দেশ
একের পর এক সামুদ্রিক ঝড়, তীব্র শীত, তীব্র তাপ প্রবাহ, খড়া, হঠাৎ অতিবৃষ্টি, মেঘ বিষ্ফোরণ ও ভয়াবহ বন্যায় বছর জুড়েই বিপর্যস্ত ছিলো দেশ। ঘটে আকস্মিক মেঘ বিষ্ফোরণের ঘটনা। যাতে তলিয়ে যায় দেশের বন্যা ঝুঁকিমুক্ত কুমিল্লা, নোয়াখালি ও ফেনী অঞ্চল। রেকর্ড দীর্ঘ মেয়াদী তাপ প্রবাহ চলে গত এপ্রিল মাস জুড়ে। আঘাত হানে প্রবল দুটি ঘুর্ণিঝড়। এক কথায় জলবায়ু পরিবর্তণের প্রভাবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ দেখলো প্রকৃতির রুদ্ররূপ।
চলতি বছরের শুরুতেই সারা দেশ তীব্র শীতের কবলে পড়ে। গত ২৬ জানুয়ারি চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় রেকর্ড হয়েছে ৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২৩ জানুয়ারি দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয় চুয়াডাঙ্গা ও সিরাজগঞ্জে। ওইদিন এ দুই জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছে ২০১৮ সালে। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি সৈয়দপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি এবং ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি রাজশাহীতে ৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়। সে হিসেবে এবছর তৃতীয় সর্বোনিম্ন তাপমাত্রা অনুভূত হলো দেশে।
এদিকে ১৮০০ সালের মাঝামাঝি থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরুর পর সবচেয়ে উষ্ণ ছিল ২০২৪ সালের জুন মাস। যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। গত এপ্রিল মাস জুড়েই ভয়াবহ দাবদাহে দুর্যোগ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাপযন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে সারা দেশের মানুষ। প্রকৃতিতে ছিলো মরুর গনগনে তপ্ত উত্তাপ। তাতানো সূর্যের খরতাপে প্রকৃতির কাছে অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ। বেঁকে যায় রেললাইন, গলে যায় সড়কের পিচ। খরায় ঝরে পড়ে আম-লিচুর গুটি, কাঁঠালের মুচি। বহু এলাকায় নলকূপে পানি উঠানো বন্ধ হয়ে যায়। জলীয় বাষ্পের আধিক্য দাবদাহকে দাহ্য করে তোলে। পুরো মাস জুড়েই ছিলো না ঝড় কিংবা বৃষ্টি। সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী তাপপ্রবাহের রেকর্ড গড়ে এবছরের এপ্রিল মাস।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। এটিই এখন পর্যন্ত দেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এ হিসেবে ১৯৭২ সালের পর প্রায় ৫২ বছরের মধ্যে গত ৩০ এপ্রিল যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
এর আগে ১৯৯৫ সালের পহেলা মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই বছরের ২৫ এপ্রিল তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ ডিগ্রি। আর ২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা উঠেছিলো ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
আবহাওয়া অফিস জানায়, ২০২৪ সালের এপ্রিল ও মে মাসে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিলো। অন্যদিকে সিথ্রিএসের আওতাধীন জলবায়ু গবেষণা সংস্থা বার্কলে আর্থের কর্মকর্তা জ্যাক হাউসফাদার রয়টার্সকে গত জুন মাসে বলেন, ‘এতদিন পর্যন্ত ২০২৩ সালের জুন মাসকে ইতিহাসের উষ্ণতম জুন বলে মনে করা হতো। কিন্তু ২০২৪ সালের জুন সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।’
রেকর্ড দীর্ঘ মেয়াদী তাপ প্রবাহের পর গত ২৬ মে দেশে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার। বিস্তৃতি ছিলো প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। এর অগ্রভাগ ২৬ মে সন্ধ্যা ছয়টায় খুলনা উপকূলের কাছে সুন্দরবন দিয়ে প্রবেশ করে। এর প্রভাবে উপকূলে ব্যাপক বৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ভোলা, পটুয়াখালী ও বাগেরহাট সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানকার অনেক উপজেলা ৬ থেকে ৮ ফুট উচ্চতায় প্লাবিত হয়। এছাড়া গত ২৫ অক্টোবর মধ্যরাতে দেশে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় দানা। ঝড়টির গতিবেগ ছিলো প্রতি ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পশ্চিম দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস দেশের পূর্বাঞ্চলের আকাশে প্রবেশ করে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা লঘুচাপ কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে কুমিল্লা-নোয়াখালীর সীমানায় চলে আসে। আর মৌসুমি বায়ুও এ সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই তিন মিলে বিপুল পরিমাণ মেঘ কুমিল্লা-নোয়াখালীর আকাশে স্তরে স্তরে জমা হয়। একসময় তা বিস্ফোরিত হয়ে জনপদে নেমে আসে। আবহাওয়াবিদরা এটাকে বলে মেঘ বিস্ফোরণ বা ‘ক্লাউড ব্লাস্ট’। ১৯ আগস্ট সকালে এই মেঘ বিস্ফোরণের শুরু। এরপর টানা তিন দিন প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে আসা ঢল দেশের পূর্বাঞ্চলকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। মেঘ বিস্ফোরণ বিস্তৃত ছিল ভারতের ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের কুমিল্লা নোয়াখালী ও ফেনী পর্যন্ত ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ১৯, ২০ ও ২১ আগস্ট এ এলাকায় অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে। ১৯ থেকে ২২ আগস্ট টানা চার দিনে শুধু ফেনীতে ৪৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। একই সময়ে কুমিল্লায় বৃষ্টি হয়েছে ৫৫৭ মিলিমিটারের বেশি। নোয়াখালীতে হয়েছে ৬০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি। যা দেশের ইতিহাসে বৃষ্টিপাতের অতীত রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
এবছরই দেশে এক সঙ্গে প্রভাব পড়ে এল নিনো ও লা নিনার। স্প্যানিশ শব্দ এল নিনোর অর্থ ‘ছোট বালক’। প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ স্রোত হলো এল নিনো। এই স্রোতের প্রভাবেই দক্ষিণ গোলার্ধে পূবালী বায়ুপ্রবাহ বদলে যায়। প্রতি দুই থেকে সাত বছর পর পর এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এতে বিপুল পরিমাণ তাপ উপকূলীয় এলাকার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। এর স্থায়ীত্ব হয় এক থেকে দেড় বছর। যার দেখা মেলে চলতি বছর। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। এর কারণে দেশে স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ কমে যায়। বাতাসহীন গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করে। কখনো বা বাতাস উল্টো দিকে বইতে থাকে। এল নিনোর বিপরীত আবহাওয়া পরিস্থিতি হলো ‘লা নিনা’ যার অর্থ ছোট মেয়ে। এর প্রভাবে পূবালী বাতাসের গতি বেড়ে যায়। ভারি বৃষ্টি এবং বন্যা হয়ে থাকে। চলতি বছর এই লা নিনার প্রভাবও পড়ে বাংলাদেশে। যার ফল স্বরূপ ঘটে মেঘ বিস্ফোরণ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে