Views Bangladesh Logo

ঈদ এলেই তাদের থাকতে হয় না খেয়ে

‘ঈদ আইছে, সবাই বোনাস পাইছে, বাড়ির সবার লাইগা নতুন জামা-কাপড় কেনতাছে, মোরা বোনাস পামু কই, পোলাপাইনের নতুন কাপড় তো দূরের কথা দুদিন পর থেকে একবেলা ভাত খামু কেমনে হেইড্যা লইয়া চিন্তায় আছি।’ কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ দিনমজুর পিয়ার আলী।

ঈদ সবার মাঝে খুশি নিয়ে আসে, ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে তুলতে প্রায় প্রতিটি পরিবারে চলে নানান প্রস্তুতি। তবে এমন হাজারো দিনমজুরের ঘরে ঘরে চলে শুধু একবেলা খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকার লড়াই। শ্রমিকের হাটের এক দিনের জন্য বিক্রি হওয়া এই মানুষগুলোর নুন আনতে পান্তা ফুরায়। প্রতিদিন কাজ করে কোনোরকমে দুবেলার আহারের জোগান করলেও, লম্বা ছুটির মধ্যে কাজের অভাবে থাকতে হয় উপোস। এই অবস্থা থেকে রেহাই পেতে স্থানীয় প্রশাসন এবং সমাজের বিত্তশালীদের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের বেশ কয়েকটি ‘শ্রমিক বাজার’ রয়েছে যেখানে দরদাম করে এক দিনের জন্য বিক্রি হয় মানুষ। ভোরের আলো ফুটতেই বসে এ বাজার, শেষ হয় সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। তিনটি থানায় রয়েছে প্রায় ১৬টি শ্রমিক বিক্রির বাজার। এসব বাজারে গড়ে কাজ করেন প্রায় ৪ হাজার নারী ও পুরুষ। জনপ্রতি পুরুষ ৫০০ থেকে প্রকার ভেদে ৮০০ টাকা আর নারীদের ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দিন হাজিরা। শ্রমিক বিক্রির বাজারের নেই কোনো ছুটির দিন। রোদ, বৃষ্টি কিংবা শীত সারা বছর চলে তাদের কেনাবেচা।

সাভারের বলিয়ারপুর, ফুলবাড়িয়া, সাভার বাসস্ট্যান্ড, নবীনগর, নয়ারহাট, রপ্তানি এলাকা, ধামরাই জয়পুর, ভাড়ারিয়া, ধানতারা, কালামপুরসহ বেশ কিছু স্থানে বসে এ হাট। পণ্যের মতো দরকষাকষি করেই কেনাবেচা হয় মানুষের শ্রম। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের খোঁজে দলে দলে মানুষ শ্রম বিক্রির জন্য আসেন এখানে। দুপক্ষের মধ্যে কেনাবেচার দফা-রফা হবার পর শেষ হয় বিক্রি পর্ব। শ্রমজীবী মানুষগুলো যেদিন নিজের শ্রম বিক্রি করতে পারেন না, সেদিন তাদের ফিরতে হয় খালি হাতে।

সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের শ্রমিক বাজার ঘুরে ঘুরে দেখা গেছে, নিজেকে বিক্রি করে দেয়া মানুষগুলোর ঈদ নিয়ে নেই কোন পরিকল্পনা, কোনো আনন্দ। নারী-পুরুষ উভয়ের শ্রম বিক্রি হয় দিন, সপ্তাহ কিংবা মাস চুক্তিতে। এদের মধ্যে অধিকাংশই নিজেকে বিক্রি করেন দিন চুক্তিতে। শ্রম কেনাবেচা এই হাটে কমবয়সীদের দাম বেশি। আর দুর্বল ও বয়স্কদের দাম কম। আবার নারীদেরও মজুরি কম। এই দুর্মূল্যের বাজারে তারা যে মজুরি পান, তা দিয়েই চলে না সংসার।

তার ওপরে ঈদ পর্ব এলে যেন মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা। এ বছরও রোজার শুরুতেই শ্রমিকের চাহিদা কমতে শুরু করে, বেকার হয়ে পড়েন অনেকেই। তাই ঈদে আনন্দ নয় বরং পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেয়াই যেন দুষ্কর হয়ে ওঠে। শ্রমিকরা হতাশা প্রকাশ করে জানালেন, এত মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই; কিন্তু নজর নেই কারোরই। তাদের আক্ষেপ, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের বিত্তশালী কেউই খোঁজ রাখেন না এসব খেটে খাওয়া মানুষদের।

নীলফামারীর লাল মিয়া, আশুলিয়ার ইপিজেড এলাকায় বেচা-কেনার হাটের নিয়মিত শ্রমপণ্য। তিনি বলেন, ‘আমরা বাবা গরিব মানুষ। দুইবেলা খাইতে হয় আর কামলা খাটতে হয়। পরিবারের পোলাপাইন আছে, বউ আছে। ঈদ আইছে। জামা-কাপড় কিনা দিমু কেমনে। এক দিন কাজ করলে তিন দিন বইসা থাকতে হয়। তারপরও কইছি যদি ভালো কাম হয়, কেউ যদি দেয় তাইলে মাইয়া দুইটারে নতুন কাপড় কিইনা দিমু। না হয় এখন যেভাবে চলতেছি তেমনি চলব, কোনোরকম খাইয়া না খাইয়া। আমাদের তো বাবা যেদিন ভালো মন্দ বাজার করতে পারি ওই দিনই ঈদ মনে হয়। এখন কাজ বন্ধ থাকলে ভালো মন্দ বাজার করাটা তো আমাদের জন্য কষ্টকর।’

শ্রমিক পিয়ার আলী বলেন, ‘গত ঈদে ছেলে মেয়েকে নতুন জামা দিয়েছি। এবারের ঈদে তা সম্ভব হচ্ছে না। রোজা মাসে তেমন কাজ হয়নি। উল্টা অসুস্থ থাকায় চিকিৎসা করতে ঋণ করতে হয়েছে। সরকার ও সমাজের বিত্তশালীদের পক্ষ থেকে যদি কোনো সহযোগিতা করে তাহলে পরিবার নিয়ে এই ঈদে কোনো রকমে চলতে পারব।’

কথা হয় নারী শ্রমিক সাথী আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে পোশাক কারখানায় কাজ করতাম, ‘চাকরি চলে যাওয়ায় কয়েক মাস হলো এই বাজারে এসেছি। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে এই পেশা বেছে নিয়েছি। এখানে এসে সুবিধা করতে পারছি না। একদিন কাজ হলে তিন দিন বসে থাকতে হয়। পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের কম টাকা দেয়। সেই টাকায় সংসার চলছে। ঈদ দূরের কথা, সংসার চালাব কীভাবে সেটাই জানি না। কেউ সহযোগিতা করতে আসে না। আমরাই এখন সবচেয়ে বঞ্চিত মানুষ।’

এ ব্যাপারে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা কে এম শহীদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘দেখেন আমাদের বেশ কিছু প্রজেক্ট চলে, আমরা চেষ্টা করব তাদের এই আওতায় আনতে। আমরা ঈদের পর অবশ্যই এটা নিয়ে কাজ করব।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ