Views Bangladesh Logo

সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির কোনো সংঘর্ষ থাকা উচিত না

Khairul Anam  Shakil

খায়রুল আনাম শাকিলএর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার

খায়রুল আনাম শাকিল। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ। সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সংগীতে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পহেলা বৈশাখ, চৈত্রসংক্রান্তিসহ কয়েকটি দিক নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অ্যাডিটরিয়াল অ্যাসিসট্যান্ট শাহাদাত হোসেন তৌহিদ

ভিউজ বাংলাদেশ: ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নাম দেওয়া হয়েছে- এটি কীভাবে দেখছেন?

খায়রুল আনাম শাকিল: আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, মঙ্গল শোভাযাত্রা দীর্ঘদিন ধরেই হচ্ছে। বহির্বিশ্বেও এটা একটা স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনটিকে ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতির সনদে এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি মিলেই আমি মনে করি যে নামটা থাকলে ক্ষতি তো কিছু নেই। তা ছাড়া হঠাৎ করে নাম পরিবর্তনে সুবিধা-অসুবিধার কোনো ব্যাপার নেই। ব্যাপরাটা হলো-একটি জিনিস একভাবে পরিচিতি পেয়ে আসছে, সেটাকে নতুন করে নামকরণ করার কি যুক্তি আছে, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিষয়টি যদি সবাই বুঝতে পারে, এতে ক্ষতি কী? আগের নামে থাকাটাই ঠিক আছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: এবার চৈত্রসংক্রান্তির শোভাযাত্রায় ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠনও অংশ নেবে, মাদ্রাসায় বর্ষবরণ ও বিদায় উদযাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি- বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

খায়রুল আনাম শাকিল: চৈত্রসংক্রান্তির তাৎপর্য বুঝে আমাদের দেশের বিভিন্নজন উদযাপন করতে চান, আমি কোনো অসুবিধা দেখি না। ধর্মীয়ভাবে এটাকে আমি আলাদা করে দেখছি না। আমরা ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই তো কাজ করি। আমি মনে করি, এ দেশের আমরা সবাই মানুষ। আমাদের বাঙালির যে ঐতিহ্য, সেটি বুঝে নিয়ে যে কোনো লোকই এটি উদযাপন করতে পারে। তবে দীর্ঘদিন ধরে যে অনুষ্ঠানগুলো যেভাবে আমরা উদযাপন করে আসছি, সেটা ঠিক রেখে সবাই আনন্দ করতে পারে। আমি মনে করি, এটাই হওয়া উচিত। আলাদা কোনো ভাবনা বা আলাদা কিছু ঢুকালে সেখানে তো কোনো অরজিনালিটি থাকল না।

ভিউজ বাংলাদেশ: পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সঙ্গে এ দেশের কিছু মানুষ ধর্মীয় বিষয় সামনে আনেন। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখবেন।

খায়রুল আনাম শাকিল: না, আমরা তো বরাবরই বলে এসেছি ধর্মের সঙ্গে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের কোনোরকম বিরোধ নেই। পহেলা বৈশাখে আমরা কি করি, ভালো কথা বলি, বাঙালির সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সেই ঐতিহ্যের মধ্যে যা কিছু রয়েছে- সংগীত রয়েছে, সেই সংগীত দিয়েই আমরা অনুষ্ঠান সাজাই। সেখানে কী থাকে? সেখানে বাণীর মধ্যে থাকে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেমের কথা, কীভাবে সুন্দর সমাজ গঠতে পারি এগুলো দিয়েই তো আমাদের গান সাজানো হয় এবং দেশের মধ্যে নানাভাবে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হই, সেগুলো থেকে কীভাবে আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি সেই সংগীতের মধ্যে সেই উদ্দীপনার মধ্যে তা খুঁজে পাই। সেই শক্তি সঞ্চয় করি। অতএব, বাঙালির নববর্ষ কেবল উদযাপন করা না; এটা আমাদের নিজেদেরও সমৃদ্ধ করা এবং পৃথিবীর কাছে জানান দেয়া যে, আমি বাঙালি। আমার ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আমি গর্ববোধ করি এবং এই দিনে আমি সব সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে এ দিনটি আমরা উদযাপন করি। বাঙালি হিসেবে আমাদের যে অহংকার, সেটিই আমরা এ বিশেষ দিনটিতে বিশ্বের কাছে সবাই মিলে একটা ঘোষণা দিই যে, আমি মনে-প্রাণে বাঙালি। আমার ঐতিহ্য, আমার সংস্কৃতির ব্যাপারে আমি গর্ববোধ করি।

ভিউজ বাংলাদেশ: এবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের স্লোগান ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’-বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

খায়রুল আনাম শাকিল: এটা আসলে আমি কী বলব? যে যেমনভাবে উদযাপন করছে, সে সেভাবে করবে। এটা ভালো না মন্দ সেটা মানুষ মূল্যায়ন করবে এখানে আলাদা করে বলার আসলে কিছু নেই। আমি বলতে চাই, পহেলা বৈশাখকে একটি আনন্দ উৎসব হিসেবে নিয়েছি। সেখানে যা কিছু করলে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা হয়, সেই কাজগুলোই করব এই দিনটিতে। বিশেষ করে আমাদের ছায়ানটের অনুষ্ঠান সেভাবে সাজাই। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ আমরা সবাইকে আহ্বান করি। বছরের প্রথম দিন আসুন আমরা এক হয়ে পহেলা বৈশাখকে উদযাপন করি।

ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কৃতির প্রতি সবসময় উদাসীন দেখা যায়; কিন্তু যখন সংকট-দুর্যোগ আসে, তখন আবার তারা সাংস্কৃতির আশ্রয় নিতে দেখা যায়- কারণটি কী?

খায়রুল আনাম শাকিল: যে সরকারই আসুক, তারা সংস্কৃতিটাতে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তারা সেভাবেই প্রকাশ করেন। তবে, সংস্কৃতি পালনের ব্যাপারে আরও বেশি গুরুত্ব দিলে আমি মনে করি, ভালো হয়। আমাদের বুঝতে হবে সংস্কৃতি একটি জাতির প্রধান পরিচয়। সেই সংস্কৃতির ব্যাপারে কারোর-ই কোনো উদাসীন হওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে জাতি হিসেবে পৃথিবীর কাছে আমরা গুরুত্ব হারাব। যে কোনো রাজনৈতিক দলের মানুষ আমি হই, আমাকে বুঝতে হবে কীভাবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, কীভাবে এ দেশটির জন্ম।

অন্যদিকে, সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির কোনো সংঘর্ষ থাকা উচিত না। সব রাজনৈতিক দলের বুঝতে হবে যে, সংস্কৃতি জাতির বিশেষ একটি পরিচয়ের জায়গা। আমাদের অহংকারের জায়গা। পৃথিবীর কোন দেশে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন অনেক মানুষ? সে কারণে সংস্কৃতিকে আমাদের উন্নত জায়গায় স্থান দিতে হবে এবং সেটা কে কীভাবে দেবে, তা তাদের ব্যাপার। আমি মনে করি, সবারই এ ব্যাপারে ভাবা উচিত। সংস্কৃতির ব্যাপারে উদাসীন হলে আমাদের সমাজ আরও ধ্বংসের দিকে যাবে। অতএব, সব রাজনৈতিক দলের উচিত সংস্কৃতিকে একটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আরও প্রচার এবং প্রসার করতে হবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে এবার বৈশাখ উৎসব হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে নববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে- যেটা আগে দেখা যায়নি।

খায়রুল আনাম শাকিল: যারা দেশ পরিচালনা করছেন, তাদের কাছে মনে হয়েছে, বিভিন্ন অঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন রয়েছেন তাদের আরও আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। পহেলা বৈশাখ বাঙালির ঠিক আছে; কিন্তু আপনি যদি তাদের বাংলাদেশর নাগরিক হিসেবে দেখেন, সেখানে তারা যদি যুক্ত হতে চায়, স্বেচ্ছায় যে তারা নিজের দেশকে দেশ হিসেবে দেখে, তারাও যদি নিজস্ব একটি উদযাপনের দিন মনে করে- এতে তো কোনো ক্ষতি নেই।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ