‘ওরা গ্রামের মাতব্বর, অমানুষ’
রাত ৯টা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। দরজায় কড়া নাড়তেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শাপলা বেগম। এখনো তার আতঙ্ক কাটেনি। তার কাছ থেকে ছেলে শাকিলকে ছিনিয়ে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। ৭ বছর বয়সী ছেলের চিৎকার-আকুতির সেই দৃশ্য এখনো ভাসছে তার চোখে।
শাপলা বলেন, ‘সেদিন রাতে ছেলেটা স্বপ্নের ঘোরে বারবার বলে উঠেছে; আমাকে আর মারেন না, আমি চুরি করিনি।’
শুধু শাপলার ছেলেকেই নয়, একই গ্রামের সামি নামে আরেক শিশুকেও নির্যাতন করা হয়েছে। দুজনকেই বেধড়ক মারধর করা হয়। সামির বয়স ৯ বছর। তার পালিত বাবার নাম রানা মিয়া।
ঘটনাটি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীকোলা গ্রামের। শাকিল লক্ষ্মীকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। সামিও একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) রাতে সরেজমিন লক্ষ্মীকোলা গ্রামে গিয়ে কথা হয় শাকিল ও সামির স্বজনদের সঙ্গে।
তারা জানান, সামি ও শাকিলকে এলোপাতাড়ি মারধর (কিল, ঘুষি ও লাথি) করা হয়েছে। তাদের চোখের সামনেই ঘটে এমন ঘটনা। গ্রামের কিছু লোক দুই শিশুকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। তারাও মারধরের শিকার হয়েছেন।
একই গ্রামের মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি আজাহার রহমান ও তার ভাই আনিসার মণ্ডল এবং আব্দুর রহীম বুলু দুই শিশুকে নির্যাতন করেন।
সামি ও শাকিলকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলেও তারা জানান।
শাকিলের মা শাপলা বলেন, ছেলেকে মারধরকারীরা গ্রামের প্রভাবশালী লোকজন। ওরা গ্রামের মাতব্বর, তাদের বিরুদ্ধে গেলে আমাদের বিপদ হবে। সেইসঙ্গে গ্রামে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
দুই শিশুকে নির্যাতনের কারণ
গত ২৮ মে দুপুরে লক্ষ্মীকোলা ডাক্তারপাড়া-স্কুলপাড়া যৌথ জামে মসজিদের দানবাক্স থেকে লুকিয়ে কিছু টাকা নেয় সামি। ওই সময় তার সঙ্গে শাকিলও ছিল। তবে শাকিল ঘটনাটি দেখলেও টাকা নেয়ার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। মসজিদের টাকা নেয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে আজাহার, আনিসার ও বুলু একই দিন বিকেলে শাকিলের বাড়িতে গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এসে মারধর করেন। মারধরের একপর্যায়ে তার মা শাপলা তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আকুতি করেও শাকিলকে রক্ষা করতে পারেননি। তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে মারধর করা হয়। এরই একপর্যায়ে গ্রামের মাতব্বররা শাপলার কাছে চার হাজার টাকা দাবি করেন। শাপলাও সেই টাকা নিয়ে এসে ছেলেকে নিয়ে যেতে চান। মারধর শেষে শাকিলকে মায়ের কাছে ফিরে দেয়া হয়। তবে সেই চার হাজার টাকা মাতব্বররা আর নেননি। একই সময়ে সামিকেও নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতিত শিশু সামির পালিত মা সিমা বেগম জানান, সামি মসজিদের দানবাক্স থেকে ৮০০ টাকার মতো নিয়েছিল। পরে তা ফেরত দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, দুই শিশুকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এতে তাদের মৃত্যুও হতে পারতো। তারা অনেক চেষ্টা করেও সামি ও শাকিলকে নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা করতে পারেননি। নির্যাতনকারীরা মানুষ নন, তারা অমানুষ। গ্রামের কয়েকজন দুই শিশুকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। তারাও মারধরের শিকার হয়েছেন।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে অভিযুক্ত আজাহার ও আনিসারের বড় ভাই মাদলা ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি আজিজার রহমান মণ্ডল জানান, ঘটনাটি আপস-মীমাংসা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, সামি ও শাকিলকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়ভাবে শিশুর বিচার করার এখতিয়ার কারও নেই।
দুই শিশুকে নির্যাতনের খবর পেয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে লক্ষ্মীকোলা গ্রামে যান উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী মো. আমিনূর রহমান।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই শিশুকে নির্যাতনের ঘটনা সত্য। মসজিদ থেকে টাকা চুরির ঘটনাও সত্য। তবে খুব যে বেশি মারধর করা হয়েছে তা কিন্তু নয়। এরপরও গ্রামের মাতব্বররা যা করেছেন তা অন্যায়। দুই শিশুর পরিবারের জোরালে কোনো অভিযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, আজ (৩০ মে) আমরা আবারও ওই গ্রামে যাব। বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে