Views Bangladesh Logo

মহাসড়কে তিন চাকার যান, দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ

দেশের প্রায় সব মহাসড়কে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ তিন চাকার বাহন। প্রতিনিয়ত এমন দৃশ্য দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, চালকদের উগ্রতা ও আইন না মানার প্রবণতা এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, থ্রি-হুইলার, টমটম ও অটোভ্যান দেদার চলছে মহাসড়কগুলোয়। এতে মহাসড়কে একদিকে যেমন ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।

গত ৫ এপ্রিল সকালে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার টরকী বন্দর এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের ধাক্কায় একটি অটোরিকশা রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান অটোর যাত্রী মরিয়র বেগম (৩২)। অন্য যাত্রী আরিফ হোসেন (২৭) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ওই দিন বিকেলে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের বড়তাকিয়া বাইপাসের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত রিকশার যাত্রী সাদিয়া ইয়াসমিন জুথি নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত হন। একইদিন দুপুরে মিরসরাই পৌর সদর বাইপাসে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে বাঁচাতে গিয়ে যাত্রীবাহী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এ সময় বাসে থাকা ১৫ যাত্রী আহত হন। কয়েকদিন আগে উপজেলার মস্তাননগর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় জসীম উদ্দিন নামে এক অটোরিকশাচালক নিহত হন।


গত ৩ এপ্রিল মাদারীপুরের টেকেরহাট এলাকায় বরিশাল-গোপালগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় দুটি অটোরিকশার। এতে সুভ্রা সরকার (২২) ও মালতি সরকার (১৫) নামে দুজন নিহত হন। মাদারীপুর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ রিজওয়ান ভিউজ বাংলাদেশকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এ ঘটনা ছাড়াও চলতি বছর গত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত মাদারীপুরের বিভিন্ন মহাসড়কে অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের তিন চাকার বাহনে দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও ৬৫ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া মহাসড়কের দুপাশে তিন চাকার বাহনের জটলার কারণে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যানজট লেগেই থাকে।


ট্রাফিক পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা করেও এই বিশৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ ব্যাপারে পুলিশ নিষ্ক্রিয় কি-না জানতে চাইলে ইন্সপেক্টর রিজওয়ান বলেন, ‘তেমনটা নয়। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেও তিন চাকার বাহন মহাসড়ক থেকে সরাতে পারছি না। তবে আমাদের অভিযান নিয়মিত চলছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা দিতে গেলে অটোচালকরা পুলিশের সঙ্গে উগ্রতা দেখায়। কেউ আইন মানতে চায় না। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি মহাসড়ক অবৈধ যানমুক্ত করতে।’

এদিকে উত্তরবঙ্গের নতুন চার লেন মহাসড়কও এখন দখল করে আছে সিএনজিচালিত টেম্পো ও অন্যান্য থ্রি-হুইলার। সংযোগ সড়কগুলোতে রয়েছে একাধিক অবৈধ স্ট্যান্ড। সেখানে এলোমেলো পার্ক করা হচ্ছে শত শত যান। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল, বগুড়ার শেরপুর, নন্দীগ্রামের কুন্দারহাট ও গোবিন্দগঞ্জের ফাঁসিতলায় রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের থানা ও ক্যাম্প। কিন্তু ওই এলাকার মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ করতে একেবারেই ব্যর্থ। স্থানীয়দের অভিযোগ হাইওয়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ঢাকা-রংপুর নতুন নতুন চার লেনের মহাসড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

মহাসড়কে তিন চাকার বাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। সেই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ওই বছরের ২ অক্টোবর এসব অনিবন্ধিত যানবাহন চলাচল বন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি রুল জারি করেছিলেন। ওই রুলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ চার দফা নির্দেশনা দেন। যাতে বলা হয়েছে, দেশের সব জেলার সব মহাসড়কে নসিমন, করিমন, ভটভটি ও অটোরিকশাসহ সব ধরনের তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি এবং সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারদের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।


দেশের সব মহাসড়কে এসব অনিন্ধিত যানবাহন চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে সরকারকে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়ে একটি পরিপত্র জারি করতে স্বরাষ্ট্রসচিবকে নির্দেশ দেয়া হলো। আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে কতটুকু অগ্রগতি হলো তা জানিয়ে ছয় মাস পর পর হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ওই ধরনের যান চলাচল করলে সংশ্লিষ্ট মালিক ও চালকের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’ এরপর ২০১৬ সালের ১ আগস্ট থেকে দেশের ২২টি মহাসড়কে তিন চাকার যে কোনো যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার; কিন্তু তা থাকে কাগজে-কলমেই। মহাসড়ক এখন দখলে তিন চাকার বাহনের।

এ ব্যাপারে হাইওয়ে রংপুর রিজিয়নের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘তিন চাকার যে কোনো ধরনের যান মহাসড়ক থেকে সরাতে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। আদালতের নির্দেশ পালনে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করছি।’

হাইওয়ে পুলিশ গাজীপুর রিজিয়নের পুলিশ সুপার ড. আ ক ম আখতারুজজামান বসুনিয়া ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘মহাসড়কে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ নিষিদ্ধ তিন চাকার বাহন চলছে। এটা জাতীয় ইস্যু। পুলিশ এর বিরুদ্ধে কাজও করছে। তবে আমরা আইনের প্রয়োগ ধীরে ধীরে করছি সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে। আশাকরি শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধান হবে। এর জন্য অবশ্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’

এ বিষয়ে রিটকারী হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে হাইকোর্ট বার বার আদেশ দিলেও কাজের কাজ খুব একটা হচ্ছে না। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে এটা প্রায়ই আসছে। এ বিষয়ে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। তাদের আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। কারণ মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল শুধু বেআইনিই না, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনকও। আমরা দেখছি সম্প্রতি মহাসড়কে যত প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশের জন্য দায়ী তিন চাকার যান।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ