ঘটনাপ্রবাহ: ২০ বছরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায় আজ রোববার ঘোষণা করবেন হাইকোর্ট। দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম ওই ঘটনার পর অনেক চড়াই উৎরাই পার করে উচ্চ আদালতে রায় দেয়া হবে আজ।
যা ঘটেছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট:
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ছিল লোকে লোকারণ্য। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা থাকায় মঞ্চ নির্মাণ না করে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সবশেষে বক্তৃতা দেন শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ করে ট্রাক থেকে নিচে নামার সিঁড়ির দিকে এগোতে থাকেন। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই চারপাশে একে একে ১২টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ জনে। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মারা যান। শরীরে ১ হাজারেরও বেশি স্প্লিন্টার নিয়ে ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ প্রায় দেড় বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান।
ঘটনায় নিহত হয়েছেন যারা:
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় নিহতরা হলেন- ১. শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুব, ২. রফিকুল ইসলাম ওরফে আদা চাচা, ৩. মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হানিফ, ৪. রতন শিকদার, ৫. হাসিনা মমতাজ রিনা, ৬. রিজিয়া বেগম, ৭. সুফিয়া বেগম, ৮. লিটন মুনশি, ৯. আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, ১০. আবুল কালাম আজাদ, ১১. আব্বাস উদ্দিন শিকদার, ১২. আতিক সরকার, ১৩. মামুন মৃধা, ১৪. নাসির উদ্দিন সরদার, ১৫. আবুল কাশেম, ১৬. বেলাল হোসেন, ১৭. আবদুর রহিম, ১৮. আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, ১৯. জাহেদ আলী, ২০. মোতালেব হোসেন, ২১. মোশতাক আহমেদ সেন্টু, ২২. মোমেন আলী, ২৩. এম শামসুদ্দিন, ২৪. ইসহাক মিয়া ও ২৫. আইভি রহমান।
মামলা দয়ের ও জজ মিয়া নাটক:
গ্রেনেড হামলার পরদিন ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে আলাদা দুটি মামলা হয়। পরে মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তৎকালীন সরকার তড়িঘড়ি করে মামলা দুটি হস্তান্তর করেন সিআইডির কাছে। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমান। মামলার সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে দরিদ্র পরিবারের সন্তান মো. জালালকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় আনা হয়। তাকে দিয়ে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সাজানো হয় ‘জজ মিয়া নাটক’। দিনমজুর জজ মিয়াকে তার পুরো পরিবারের আজীবন ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়ার লোভ দেখায় সিআইডি। এ প্রস্তাবে রাজি হননি তিনি। এরপর তার ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন।
সিআইডির কথামতো না চললে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানোর ভয় দেখানো হয়। এতেও রাজি না হলে তাকে চোখ বেঁধে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার প্রস্তুতি নেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যান জজ মিয়া। শেষ পর্যন্ত সিআইডির প্রস্তাবে রাজি হন। তার পরিবারকে আজীবন ভরণপোষণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন সিআইডি কর্মকর্তা তৎকালীন এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদ ও এসপি রুহুল আমিন। জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ার পর সিআইডি অফিসে দীর্ঘদিন আদর-আপ্যায়নে রাখা হয় সাজানো জজ মিয়াকে। মুখস্থ করানো হয় জবানবন্দি। তার পরিবারকে পাঠানো হয় মাসোহারা। ‘জজ মিয়া’ হিসেবে আদালতে গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় মো. জালালের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।
রাজনৈতিক পালাবদলে পাল্টে যায় সবকিছু:
২০০৭ সালে রাজনৈতিক পালাবদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে মামলার তদন্ত নতুনভাবে শুরু হয়। নির্দোষ প্রমাণিত হন সাজানো জজ মিয়া। ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই কারামুক্ত হন তিনি। এরপর এ মামলার সাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দেন। তাতে ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানোয় ওই তিন সিআইডি কর্মকর্তার নাম উঠে আসে। জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহ এবং মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগে আলোচিত তিন সিআইডি কর্মকর্তাকে আসামি করে পল্টন মডেল থানায় মামলা হয় ২০০৯ সালের ৩০ মার্চ। মামলার চার্জশিট দাখিলকারী কর্মকর্তা সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবীর বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এরপর ওই তিন সিআইডি কর্মকর্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। এ ছাড়া তাদের ২১ আগস্ট হামলার মূল মামলায় আসামি করা হয়।
মামলায় বিচারিক আদালতের রায়:
ঘটনারা ১৪ বছর পর ২০১৮ সালে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এ মামলায় ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের আদেশ দেন বিচারিক আদালত।
যাদের সাজা দেওয়া হয়েছে:
বিচারিক আদালতের রায়ে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষীসাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে- সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হরকাতুল জিহাদের সাবেক আমির শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল। জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জ্বল, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ও হানিফ পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ হানিফকে।
মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাড়াও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হরকাতুল জিহাদের সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।
এ ছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড এবং আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত।
হাইকোর্টে দীর্ঘ শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষা:
বিচারিক আদালতের রায়ের পর মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ২০১৮ সালে ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে এটি নথিভুক্ত হয়। অন্যদিকে, কারাগারে থাকা দণ্ডিত ব্যক্তিরা কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দুই মামলায় আলাদা জেল আপিল ও নিয়মিত আপিল করেন। হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর একটি দ্বৈত বেঞ্চে শুনানি শুরু করে। তবে সরকার বদলের পর দ্বৈত বেঞ্চের একজন বিচারপতি পরিবর্তন হলে আপিল শুনানির বেঞ্চ পুনর্গঠন হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ অক্টোবর নতুন করে আবারও আপিলের শুনানি শুরু হয় নবগঠিত বেঞ্চে।
গত ২১ নভেম্বর এই মামলার ডেথ রেফারেন্স এবং বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিল শুনানি শেষ হয়। ওই দিন মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন (সিএভি) হাইকোর্ট। গতকাল শনিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে রোববারের কার্যতালিকায় মামলাটি ৫৪ নম্বরে রায়ের জন্য রাখা হয়। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ এ রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে