থেমে গেল রুপালি পর্দার নূপুরের ঝংকার
সত্তর ও আশি দশকের বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমান। দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে হাতে গোনা যে কয়জন নায়িকা পেশাদার নৃত্যশিল্পী ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম অঞ্জনা। সিনেমায় তার নাচের দৃশ্য ঝড় তুলেছিল পুরো চলচ্চিত্র অঙ্গনে। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) রাতে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান প্রিয় মুখ অঞ্জনা। তার মৃত্যুতে শুধু চলচ্চিত্র অঙ্গনে নয়, দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী সবার মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
১৯৬৫ সালের ২৭ জুন ঢাকার এক সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অঞ্জনা। সিনেমা জগতে আসার আগেই অঞ্জনা পরিচিতি পান একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে। মাত্র ৫ বছর বয়সে নাচে মঞ্চ মাতিয়েছিলেন অঞ্জনা। ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল অভিনেত্রীর। যার কারণে তার বাবা মা ভারতের ওস্তাদ বাবুরাজ হীরালালের কাছে নাচ শিখতে পাঠান। সেখানে তিনি কত্থক শেখেন। অঞ্জনা নৃত্যে ৩ বার জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ভরতনাট্যম নৃত্যেও তিনি বেশ পারদর্শী ছিলেন। তার ঝুলিতে রয়েছে ১০ বার আন্তর্জাতিক শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পীর পুরস্কার। চিত্রনায়িকা উপাধি পেয়ে প্রয়াত হলেও অঞ্জনা নাচে ছিলেন সেরা একজন শিল্পী। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ডিস্কো ড্যান্সারের বাংলা রিমেইকে অঞ্জনার অভিনয় ও নাচ প্রমাণ করে অঞ্জনার নাচে কতটা প্রতিভা ছিল!
১৯৭৬ সালে বাবুল চৌধুরীর পরিচালনায় ‘সেতু’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার অভিনয় জগতে পদার্পণ হয়। যদিও তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’। নায়ক সোহেল রানার বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। তারপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি অঞ্জনাকে রহমানকে।
এরপর তার ক্যারিয়ারের গ্রাফ উঁচুতে উঠতে শুরু করে। তিনি তার অভিনয় জীবনে ৩০০ এর অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত বাংলা সিনেমাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘অশিক্ষিত’, ‘জিঞ্জীর’, ‘আশার প্রদীপ’, ‘আশার আলো’, ‘আনারকলি’, ‘সুখে থাকো’, ‘সানাই’, ‘বৌ কথা কও’, ‘অভিযান’, ‘রাম রহিম জন’, ‘রুপালি সৈকতে’, ‘মোহনা’, ‘পরিণীতা’ রাজার রাজা, বিস্ফোরণ, ফুলেশ্বরী ইত্যাদি। নিজের সময়ে ঢাকাই সিনেমার প্রায় সব প্রথম শ্রেণীর নায়কের বিপরীতে অভিময় করেছেন তিনি। নায়করাজ রাজ্জাকের সাথে জুটিবেধেঁ তিনি ৩০ টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার সঙ্গেই তিনি বেশি অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া ভারতের অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী, পাকিস্তানের অভিনেতা ফয়সাল, নাদিম, জাভেদ শেখ, ইসমাইল শাহ সহ নেপালের শীবশ্রেষ্ঠ এবং ভুবন কেসির সঙ্গেও অভিনয় করেছেন। ৯টি দেশের ১৩টি ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন অঞ্জনা।
১৯৮১ সালে গাংচিল সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর ১৯৮৬ সালে ‘পরিণীতা’ সিনেমায় ললিতা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আবার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়া বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) এর বিবেচনায় সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন প্রয়াত অঞ্জনা।
অভিনেত্রী অঞ্জনার সিনেমা যেমন দর্শকের মনে দাগ কেটেছে ঠিক তেমনি তার সিনেমার গানগুলো এখনো দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে। কিছু উল্লেখযোগ্য গান হলো ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইসে, ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, আমি যেমন আছি তেমন রবো, হ্যালো হ্যালো এভ্রিবডি, বাবারে বাবা কই দিলা বিয়া ইত্যাদি। এসব গান শুনলে এখনো দর্শকশ্রোতা আমাদের সিনেমার সোনালি দিনে ফিরে যান।
১৯৯২ সালের পর সিনেমায় অনিয়মিত হয়ে যান অঞ্জনা। ২০০৮ সালে মুক্তি পায় তার সর্বশেষ সিনেমা ‘ভুল’। এরপর তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে প্রযোজনাও করেছেন সেগুলো হলো নেপালী মেয়ে, হিম্মতওয়ালী, রঙীন প্রাণ সজনী, দেশ-বিদেশ, রাজা রাণী বাদশা, ডান্ডা মেরে ঠান্ডা, বন্ধু যখন শত্রু, শ্বশুরবাড়ী, লাল সর্দার।
অভিনয়ে সক্রিয় না হলেও চলচ্চিত্র অঙ্গনে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।।সর্বশেষ চলচ্চিত্র সমিতির নির্বাচনে সদস্যপদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিক অঙ্গনেও অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমানের পদচারণা ছিল। তিনি বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। অভিনয়, নাচ, প্রযোজনা, রাজনীতি নিয়ে এক বৈচিত্র্যময় জীবন পার করেছেন প্রয়াত এই অভিনেত্রী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে