Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

‘টাইটানিক’ কোম্পানি: প্রভাবশালী থেকে দেউলিয়া

Shimul  Zabaly

শিমুল জাবালি

রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪

মাই হার্ট উইল গো অন…। টাইটানিকের নাম শুনলেই নিশ্চয়ই লাখো দর্শকের কানের কাছে বেজে উঠবে সেলিন ডিওনের গানটি। চোখের সামনে ভেসে উঠবে জ্যাক আর রোজ দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জাহাজের মাথায়, হাতে হাত ধরে চার হাত দুদিকে প্রসারিত করে তারা তাকিয়ে আছে দূর নীল সমুদ্রের দিকে। লন্ডন থেকে জাহাজটি যাচ্ছে নিউইয়র্কের দিকে। আদিগন্ত আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে। কোনো এক স্বপ্নের ভূমিতে পা রাখবে তারা, তারপর রচনা করবে স্বাপ্নিক এক ভবিষ্যৎ; কিন্তু হঠাৎ জাহাজটি ধাক্কা খায় বিশাল এক বরফখণ্ডের সঙ্গে- আর তারপর! সবাই জানেন কী হয়েছিল তারপর।

জ্যাক যখন ডুবে যায় অতলান্তিক আটলান্টিকে পৃথিবীর এমন কোনো দর্শক নেই যে তখন কাঁদেননি। টাইটানিকের জন্য আরো একটি দুঃসংবাদ- কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত ‘টাইটানিক’ জাহাজ নির্মাণকারী কোম্পানিটি ১৮৬১ সালে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ঐতিহ্যবাহী এই কোম্পানিটি দেড়শ বছরের অধিক সময় ধরে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে, টিকে থেকেছে। কোম্পানিটি কখনো জন্ম দিয়েছে সমালোচনার, কখনো-বা আলোচনার। ১৬৩ বছরের এ কোম্পানিটি আবারও আলোচনায় উঠে আসে, হুট করে দেউলিয়া ঘোষণার কারণে। সম্প্রতি কোম্পানিটি থেকে জানানো হয়, ঋণ নিয়েও দৈনন্দিন খরচ মেটাতে পারছে না তারা। দেখে নেয়া যাক প্রভাবশালী কোম্পানি থেকে দেউলিয়া হওয়ার আদ্যোপান্ত কারণ।

টাইটানিকের শুরু
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেন্টাইল মেরিন কোম্পানির অর্থায়নে গ্রেট ব্রিটেনের বেলফাস্টের হারল্যান্ড এন্ড ওলফ শিপইয়ার্ডে শুরু হয় টাইটানিক জাহাজ তৈরির কাজ। প্রকৃতপক্ষে ‘টাইটানিক’ এবং ‘অলিম্পিক’ দুটি জাহাজের নির্মাণকাজ একই সঙ্গে শুরু হয়েছিল। জাহাজ দুটির গঠন এবং ডিজাইনও ছিল মোটামুটি এক। ১৫ হাজার মানুষ কাজ শুরু করেছিল সেই শিপইয়ার্ডে।

সেসময়ে এরকম বড় একটি স্ট্রাকচার দাঁড় করানো ছিল খুবই কঠিন একটি কাজ। নানারকম সতর্কতা অবলম্বন করলেও নির্মাণকাজ চলাকালীন সময়ে শ্রমিকদের প্রাণহানি থামাতে পারেনি। ৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পুরো সময়টাতে। আর গুরুতরভাবে আহত হয় প্রায় ২৪৬ জন শ্রমিক। টাইটানিক যাত্রার শুরু হয়েছিল মৃত্যু দিয়েই।


১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল। একটি ইতিহাস রচিত হলো ঐদিন। শেষ হলো টাইটানিক তৈরির পুরো কাজ। প্রায় ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন (বর্তমান প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন) ডলার খরচ হলো এতে।

টাইটানিকের সমুদ্রযাত্রা
টাইটানিক নির্মাণের পর সংস্থার তরফ থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, স্বয়ং ঈশ্বরও এই জাহাজটিকে ডোবাতে পারবে না। ভাগ্যদেবী তখনই হয়তো অলক্ষে হেসেছিলেন। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল লিভারপুল থেকে যাত্রা শুরু করে এই বিলাসবহুল প্রমোদতরী। ক্যাপ্টেন ছিলেন অভিজ্ঞ নাবিক এডওয়ার্ড জন স্মিথ; কিন্তু জাহাজ নিয়ে নিরাপদে গন্তব্য পৌঁছতে পারেননি তিনি। ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল আটলান্টিকের একটি হিমশৈলে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় টাইটানিক। সে ইতিহাস প্রায় সকলেই জানেন।


ওই দুর্ঘটনায় জাহাজের কর্মী ও যাত্রী মিলিয়ে ২ হাজার ২২৪ জনের মধ্যে ১ হাজার ৪৯৬ জনের মৃত্যু হয়। প্রাণ হারান জাহাজের ক্যাপ্টেনও। টাইটানিকে পর্যাপ্ত লাইফবোট ছিল না। জাহাজটিতে মাত্র ২০টি লাইফবোট থাকায় অনেককেই বাঁচানো যায়নি।

যেভাবে দেউলিয়া হলো কোম্পানিটি
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পরও কোম্পানিটি বন্ধ হয়নি। প্রযুক্তি ও আধুনিকতার মিশেলে একের পর এক চমক দেখিয়েছে তারা। সর্বশেষ তারা সমুদ্রের গভীরে যাত্রার জন্য তৈরি করেছিল ডুবোযান ‘টাইটান’। এইতো মাত্র এক বছর আগের ঘটনা। আটলান্টিকের গভীরে অভিশপ্ত টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায় ডুবোযান টাইটান। প্রাণ হারান এর ভেতরে থাকা পাঁচ যাত্রী। আবারও সমালোচনার মুখে পড়তে হয় কোম্পানিটিকে। সেই স্মৃতি মুছে যেতে না যেতেই এবার এলো মনখারাপের খবর। সেই বিখ্যাত কোম্পানিটি দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।

চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে ব্রিটিশ জাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা হারল্যান্ড অ্যান্ড উল্ফ। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ১১২ বছর পর কোম্পানিটির এ অবস্থা দেখে আর্থিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন হারল্যান্ড অ্যান্ড উল্ফের অন্তর্বর্তীকালীন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রাসেল ডাউন্স। তিনি জানিয়েছেন, সংস্থার প্রতিদিনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের হাতে নেই। এই অবস্থায় দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া তাদরে কোনও বিকল্প না থাকার কথা জানান। রাসেল ডাউন্সের দাবি, সংস্থার আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় সরকারের কাছে ২৬ কোটি ৪০ লক্ষ ডলার চাওয়া হয়েছিল; কিন্তু সরকার তা দিতে অস্বীকার করে। ফলে ঋণ নিয়েও আর্থিক সংকট সামলানো যায়নি।

এবারই প্রথম নয়
এ দিকে টাইটানিক নির্মাণকারী জাহাজ সংস্থা বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারকে তিনটি যুদ্ধজাহাজ তৈরিতে সাহায্য করছে। সংস্থা দেউলিয়া হয়ে গেলেও ওই প্রকল্পে কোনো সমস্যা হবে না বলে সংস্থার তরফে স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে হারল্যান্ড অ্যান্ড উল্ফ এবারই প্রথম আর্থিক সংকটের মুখে পড়ল এমনটা নয়। ২০১৯ সালেও সংস্থাটির বাজে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ওই সময় প্রশাসক নিয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার; কিন্তু প্রশাসক নিয়োগের এক মাসের মাথায় হারল্যান্ড অ্যান্ড উল্ফকে কিনে নেয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা ইনফ্রাস্ট্রাটা।

তার পর কিছুটা হালে পানি পেয়েছিল এই জাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা। যদিও গত ২০ বছর ধরে জাহাজ সংস্থাগুলো হারল্যান্ড অ্যান্ড উল্ফের থেকে একরকম মুখ ফিরিয়েই রেখেছে। ফলে সংস্থায় দেখা গিয়েছে আর্থিক সংকট। সেখান থেকে বেরোতে মোটা টাকা ঋণ নিয়েছেন তারা, যা সংস্থার দেউলিয়া হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ