Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

দাবায় খেতাব বাড়ছে, মান নয়

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

শুক্রবার, ১ মার্চ ২০২৪

দেশের ক্রীড়া ফেডারেশনের নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত জেলা ও বিভাগীয় সংগঠক নেতাদের মনোরঞ্জন করা। নির্বাচিত হওয়ার পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) এবং বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে (বিওএ) জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে ফেডারেশনগুলোর নীতিনির্ধারকরা সাফল্যের শর্টকাট খোঁজেন। শর্টকাটের ভুল পথে হাঁটতে গিয়েই ক্রীড়া উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রধান কাজটা হয়ে যাচ্ছে অপশনাল! দেশের অর্ধশতাধিক ক্রীড়া ফেডারেশনের অধিকাংশই চলছে এভাবে। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনও। রাজনৈতিক প্রভাবে ফেডারেশনের মসনদে আরোহণের বিষয়ও দেখা যাচ্ছে, যা খেলাটিকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ দাবার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

দাবা বোর্ডে মগ্ন উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ

উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার:
১৯৮৭ সালে কেবল বাংলাদেশের নয়, উপমহাদেশের দাবাড়ুদের পথপ্রদর্শক হয়েছিলেন নিয়াজ মোরশেদ। এ অঞ্চলের প্রথম দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে জন্ম নেওয়া এ দাবাড়ু।

নিয়াজের পর রানী:
গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পথে নিয়াজ আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব লাভ করেছিলেন ১৯৮২ সালে। তিন বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব লাভ করা রাণী হামিদ বাংলাদেশ দাবাকে সঠিক পথেই রেখেছিলেন; কিন্তু গেল প্রায় ৪২ বছর ধরে সেই আন্তর্জাতিক মাস্টার হিসেবেই আছেন রাণী হামিদ। ৮০ বছরের বর্ষীয়ান দাবাড়ু এখনো খেলে যাচ্ছেন।

এখনো খেলে যাচ্ছেন ‘দাবার রাণী’ খ্যাত রাণী হামিদ

নিয়াজের উত্তরসূরিরা:
৫৭ বছর বয়সী বাংলাদেশ দাবার আইকনের দেখানো পথ ধরে পরের ২১ বছরে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব লাভ করেছেন আরও চারজন- জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, মোল্লা আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব। উল্লিখিত চার গ্র্যান্ডমাস্টারের আগে সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন জিল্লুর রহমান চম্পক; কিন্তু ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব অর্জন করা এ দাবাড়ু খেলাটিকে সিরিয়াসলি নেননি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি।

ট্র্যাকেই ছিল দেশের দাবা:
জিল্লুর রহমানের প্রবাসে পাড়ি জমানোর নব্বই দশকে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব লাভ করেছিলেন জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার ও মোল্লা আবদুল্লাহ আল রাকিব। পরের দশকে তিন দাবাড়ুই আন্তর্জাতিক মাস্টার থেকে নিজেদের গ্র্যান্ডমাস্টারে পরিণত করেন। ২০০৮ সালে দেশের সর্বশেষ দাবাড়ু হিসেবে এ খেতাব লাভ করেন এনামুল হোসেন রাজীব।

দেশের দাবায় কালো অধ্যায়ের জনক মোকাদ্দেছ হোসাইন

কালো অধ্যায়:
বর্তমানের পরিবার-পরিজন নিয়ে ইউরোপে বসবাস করছেন বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের (অ্যাডহক) কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকাদ্দেছ হোসাইন। প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার সিঁড়ি হিসেবে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের মসনদকে বেছে নিয়েছিলেন সাবেক এ সৌখিন দাবাড়ু। রাজনৈতিক লবিং কাজে লাগিয়ে বসেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এ পদে। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিবার নিয়ে প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার পথটা চওড়া করলেও তা দেশের দাবাকে অচল করে দিয়েছিল। যে কারণে খেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব, এনামুল হোসেন রাজীবরা। মোকাদ্দেছ হোসাইনকে অপসারণে দাবা ফেডারেশনে তালা ঝুলিয়েছিলেন খেলোয়াড়রা। আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল, শামীমা আক্তার লিজা ও মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ সাগররা নিজেদের গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে গড়ার সুযোগ পাননি। এখনো সে জায়গায় আটকে আছেন তারা। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের কালো অধ্যায়ের যে ধাক্কা সেটা বাংলাদেশ দাবা এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে আছে! পরের এক যুগে সে ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার মতো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

দীর্ঘ বিরতি:
এনামুল হোসেন রাজীবের পর গেল ১৬ বছরে বাংলাদেশ যে কোনো গ্র্যান্ডমাস্টার পায়নি, তার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয় মুকাদ্দেছ হুসাইনের শাসনামলের কালো অধ্যায়কে। মাঝে এক বছরের ব্যবধানে আবু সুফিয়ান শাকিল, মিনহাজউদ্দিন আহমেদ সাগর এবং শামীমা আক্তার লিজা আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব লাভ করে সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন। ২০১১ সালে শাকিল ও লিজা এবং ২০১২ সালে সাগর এ খেতাব লাভ করেন; কিন্তু দেশের দাবার অচলাবস্থার কারণে শাকিল খেলা ছেড়ে কোচিংয়ে মনোযোগ দেন। প্রবাসী পাড়ি জমিয়েছেন লিজা। প্রতিভার কঙ্কাল হয়ে এখনো খেলে যাচ্ছেন সাগর। উল্লিখিত তিন দাবাড়ুর পর ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব লাভ করেন ফাহাদ রহমান ও শারমিন সুলতানা শিরিন।

দেশের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব

খেতাব বেড়েছে, মান নয়:
২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব লাভ করেছেন পাঁচ দাবাড়ু- শাকিল, সাগর, লিজা, শিরিন ও ফাহাদ। তাতে মনে হতে পারে বাংলাদেশ এ সময়ের মধ্যে খেলাটিতে অনেক উন্নতি করেছে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। ২০১১ সালের পর থেকে এশিয়ান জোনাল দাবায় পৃথক হয়ে যায় বাংলাদেশ ও ভারত। ভারতের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে জোন-৩ দশমিক ২-এ বাংলাদেশের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। জোনাল দাবার নারী ও পুরুষ ওপেন বিভাগের চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ুর সামনে সরাসরি আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব অর্জনের সুযোগ থাকে। এ সুযোগে খেতাবধারী বেড়েছে, এখনো বাড়ছে; কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মান বাড়েনি। সর্বশেষ জোনাল দাবা থেকে খেতাব লাভ করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস। রেটিংয়ের শর্ত পূরণ না হওয়ায় এখনো অবশ্য আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থা (ফিদে) থেকে আন্তর্জাতিক মাস্টারের স্বীকৃতি পাননি তিনি।

মান বৃদ্ধির অন্তরায়:
দাবাড়ুদের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের প্রচেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নিয়মিতই। অতীতে অর্থ সংকট ছিল বড় অন্তরায়। দাবা সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ফেডারেশন কর্মকর্তারা এখনো অর্থ সংকটকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে চাইবেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার পর থেকে অর্থ সংকট নেই; বিশেষ করে বিগত ৩-৪ বছর ধরে। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসবে- তাহলে দেশের দাবাড়ুদের মান বাড়ছে না কেন? তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, দাবাড়ুদের সামর্থ্য অনুযায়ী এমন প্রতিযোগিতা আয়োজিত হচ্ছে না যেটা তাদের পরের ধাপে নিয়ে যেতে পারে। দেশে এখন প্রচুর রেটিং, আন্তর্জাতিক মাস্টার ও গ্র্যান্ডমাস্টার দাবা প্রতিযোগিতা হচ্ছে; কিন্তু সেগুলো এমনভাবে সাজানো হচ্ছে না, যাতে দেশের নির্দিষ্ট খেলোয়াড়রা সুফল তুলতে পারে।

তাছাড়া দাবাড়ুদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ঘাটতির কথাও জানালেন বিশেষজ্ঞরা। একজন দাবাড়ুকে প্রচুর পড়াশোনা ও অনুশীলন করতে হয়। বাংলাদেশি দাবাড়ুদের মাঝে এ ক্ষেত্রে অনীহা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণে একটা পর্যায়ে গিয়ে আর সীমাবদ্ধতা জয় করতে পারছেন না অধিকাংশ দাবাড়ু।

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান ও সন্তান তাহসিন তাজওয়ার জিয়া

দাবার পৃষ্ঠপোষকতা:
নিয়াজ মোরশেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, মোল্লা আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীবরা যেটা পাননি, এখনকার মনন রেজা নীড়-তাহসিন তাজওয়ার জিয়ারা সে ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ আনসার ও বাংলাদেশ পুলিশ দলের হয়ে খেলছেন প্রায় ৩০ দাবাড়ু। তারা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলতে গেলে নিজ নিজ সংস্থা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পান। তারপরও উন্নতি করতে না পারাকে দুঃখজনক বললেন দাবার বিচারক মোহাম্মদ শামীম, ‘বিভিন্ন সংস্থার হয়ে খেলার সুবাদে মাসিক ভিত্তিতে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন এখনকার দাবাড়ুরা। অতীতে নিয়াজ ভাইরাও কিন্তু এমন সুবিধা পাননি। বিদেশে খেলতে গেলেও সংস্থা থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায়। তারপরও সে দাবাড়ুদের উন্নতি করতে না পারাটা দুঃখজনক।’

সংগঠক মুশফিকুর রহমান মোহনের কল্যাণে নৌবাহিনী দাবা দল গঠন করেছিল। তিনি অবশ্য এখন দাবা থেকে দূরে; কিন্তু বাংলাদেশ দাবার করুণ চিত্র নিয়ে হতাশ এ সংগঠকও, ‘নৌবাহিনীর দাবা দল গঠন করা ছিল একটা মাইলফলক। ওটাই ছিল কোন সার্ভিসেস দলের প্রথমবারের মতো দাবায় আগমন। নৌবাহিনী দল গড়ার পর বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের উচিত ছিল অন্যান্য সংস্থাকে এখানে যুক্ত করা। দাবার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে উদীয়মানরা এ খেলায় আগ্রহী হতেন; কিন্তু দুঃখজনকভাবে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’

প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিযোগিতা:
বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে ঘরোয়া কার্যক্রম নিয়ে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন বেশ ব্যস্ত। বছরজুড়ে নানা আয়োজনের সে ব্যস্ততা দেশের দাবা ও দাবাড়ুদের মান উন্নয়নে আদতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে— এ নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন উঠছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ পুলিশ প্রাইম ক্লাব আমন্ত্রণমূলক দাবা প্রতিযোগিতা’ ছিল তেমনই এক প্রশ্নবিদ্ধ আয়োজন। এ আয়োজনের উদ্দেশ্যে ছিল জান্নাতুল ফেরদৌসের আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব অর্জনের পথে রেটিংয়ের শর্ত পূরণ করা। আরও একজনের আন্তর্জাতিক মাস্টারের খেতাব অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন হয়তো ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবকদের বোঝাবে- আমরা সঠিক পথেই আছি; কিন্তু আদতে এমন আয়োজন দেশের দাবা ও দাবাড়ুদের পিছিয়ে দেবে বলেই জানালেন খেলাটির বিশেষজ্ঞরা। পাতানো এ প্রতিযোগিতা নিয়ে দাবা অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।

গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম করার কাছে গিয়েও বারবার ফিরে আসছেন ফাহাদ রহমান

ফাহাদকে ঘিরে স্বপ্ন:
পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের পর শাকিল, সাগর, লিজা, শিরিনকে ঘিরে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন কর্মকর্তারা একসময় স্বপ্ন দেখেছেন; কিন্তু সে স্বপ্ন রঙ হারাতে সময় লাগেনি। গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জনের অভিযানে এখন কাণ্ডারি হিসেবে ভাবা হচ্ছে ফাহাদ রহমানকে। ২০১৩ সালে ফিদে মাস্টার ও ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব লাভের পর এ দাবাড়ুকে ঘিরে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল সংশ্লিষ্টদের। ধারণা ছিল দ্রুতই গ্র্যান্ডমাস্টার-সংক্রান্ত আক্ষেপ ঘুচিয়ে দেবেন ফাহাদ রহমান; কিন্তু ২০ বছর বয়সি এ দাবাড়ু সে ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে এখনো কোনো গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম অর্জন করতে পারেননি।

ফাহাদকে ঘিরে হতাশা:
আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব অর্জনের পর ৬ থেকে ৭ বার গ্র্যান্ডমাস্টারের নর্ম করার কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন ফাহাদ রহমান; কিন্তু কেন যেন বারবার সেখান থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে। গত বছর ভিয়েতনামে ১ পয়েন্টের জন্য নর্ম অর্জন করতে পারেননি। তার আগে থাইল্যান্ডে পেটের পীড়ায় চাইনিজ প্রতিপক্ষকে ওয়াকওভার দিয়ে নর্ম মিস করেছেন। ফাহাদকে ঘিরে সময়ের সঙ্গে বাড়ছে হতাশাও। এ দাবাড়ু ব্যক্তিগতভাবে ২০২৪ সালের মধ্যে নিজেকে গ্র্যান্ডমাস্টারে পরিণত করতে ধনুর্ভঙ্গপণ করেছেন, ‘বারবার কেন কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। দাবাতে একটি কথা প্রচলিত আছে, কোন কাজ একবার করার পর সেটা শতবার করা যায়। তিনটি নর্মের মধ্যে প্রথমটি করা কঠিন। সেটা করতে পারলে বাকি দুটো হয়ে যাবে। আশা করছি, এ বছরের মধ্যেই সবকিছু হয়ে যাবে। আমি সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করছি।’

তৃণমূল আগ্রহ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না:
ডিসেম্বরে শেষ হওয়া জাতীয় অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণকারীদের দৈনিক ভাতা ছিল মাত্র ৪০০ টাকা। বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় এ অর্থ মফস্বল থেকে কোন দাবাড়ুকে ঢাকায় এসে খেলার বিষয়ে আকৃষ্ট করার কথা নয়। ছোটখাটো এসব বিষয় বাংলাদেশের দাবায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দিনের পর দিন এভাবে চলার কারণে বিষয়গুলো খেলাটি ওপর দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ঘাটতি:
অনেক ক্ষেত্রে বর্তমান দাবাড়ুদের মান যেমন প্রশ্ন উঠছে, প্রশ্নবিদ্ধ এখনকার দাবাড়ুদের উন্নতির জন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাও। নিয়াজ-জিয়ার মতো গ্র্যান্ডমাস্টাররা ন্যূনতম সুবিধা নিয়ে বেড়ে ওঠার পথে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। বর্তমান সময়ের দাবাড়ুরা বিভিন্ন সংস্থা ও ক্লাব থেকে সহায়তা নিয়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত ঘাম ঝরালেও পরবর্তীতে খেই হারাচ্ছেন বলে জানালেন খেলাটির বিশেষজ্ঞরা।

নিয়াজ মোরশেদের উদ্যোগ:
গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম অর্জনের কাছে গিয়ে ফাহাদের বারবার ফিরে আসায় অন্যান্যদের মতো হতাশ উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদও। এ দাবাড়ু ধারাবাহিকভাবে এমন কিছু প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে চান, যেগুলো থেকে ফাহাদ রহমান নর্ম অর্জন করতে পারেন, উন্নতি করতে পারেন অন্যান্য দাবাড়ুরাও। চাইলে স্বল্প বাজেটের মধ্যেও প্রতিবেশী দেশের দাবাড়ুদের এনে গ্র্যান্ডমাস্টার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যায়। নিয়াজ মোরশেদ সে চেষ্টাই করছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দাবার আইকনের কথা হচ্ছে, ‘ফাহাদ বারবার নর্ম অর্জনের কাছে গিয়েও ফিরে আসছে। আমি দেখতে চাই সে কতবার ফিরে আসতে পারে!’ কিন্তু নিয়াজ মোরশেদ যতো পরিকল্পনাই করুন, বোর্ডে খেলতে হবে ফাহাদ রহমানদেরই। প্রতিভাবান এ দাবাড়ুর চাওয়া একজন মানসম্পন্ন ট্রেইনার। ব্যক্তি উদ্যোগে ট্রেইনারের ব্যবস্থা করা কঠিন। এ জন্য বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। অতীতে বিদেশি ট্রেইনার এনে স্থানীয় দাবাড়ুদের পরিচর্যার প্রচেষ্টা ছিল। সেটা পুনরায় চালু করার দাবি অন্যান্য দাবাড়ুদেরও।

আলো ছড়াচ্ছেন উদীয়মান সাকলাইন মোস্তফা সাজিদ

উদীয়মানদের আবাসিক ক্যাম্প:
দাবা কোচ আবু সুফিয়ান শাকিলের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন খুদে দাবাড়ুকে নিয়ে আবাসিক প্রশিক্ষণ শিবির চালু করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। এক বছরের এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষ হবে আগামি এপ্রিলে। এরইমধ্যে এ কার্যক্রমে থাকা দাবাড়ু সাকলাইন মোস্তফা সাজিদ টানা দুটি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে সাড়া জাগিয়েছে। ১২ বছর বয়সি এ দাবাড়ু গেল বছরের ৩১ ডিসেম্বর জাতীয় জুনিয়র দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে ওয়ালটন আন্তর্জাতিক রেটিং দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পাবনার ফরিদপুর থেকে উঠে আসা সাকলাইন মোস্তফা। দুই আসরের মধ্যে দ্বিতীয়টির শিরোপা জয়ের পথে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান ও রিফাত বিন সাত্তার এবং আন্তর্জাতিক মাস্টার মিনহাজউদ্দিন আহমেদ সাগরকে ছাড়িয়ে গেছে সাকলাইন মোস্তফা।

আবু সুফিয়ান শাকিলের প্রত্যাশা:
পাইপলাইনে থাকা একঝাঁক খুদে দাবাড়ুকে নিয়ে আশাবাদী কোচ আবু সুফিয়ান শাকিল। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব অর্জনের পর কোচিংয়ে মনোযোগ দেওয়া শাকিল বলছিলেন, ‘পাইপলাইনে একাধিক প্রতিভাবান দাবাড়ু রয়েছে। সাকলাইন তাদের অন্যতম। দাবা ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক শোয়েব (শোয়েব রিয়াজ আলম) ভাই যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, তাতে হয়তো দ্রুতই আমরা আন্তর্জাতিক মাস্টার ও গ্র্যান্ডমাস্টার খুঁজে পাবো।’

ফেডারেশন কর্মকর্তাদের আহ্বান:
বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক শোয়েব রিয়াজ আলম বলছিলেন, ‘কেবল ফেডারেশন চেষ্টা করলেই হবে না। দেশের দাবাকে এগিয়ে নিতে হলে বিভিন্ন ক্লাব ও সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে একদিকের স্বদেশী দাবাড়ুদের উন্নতির পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে, অন্যদিকে মুনাফাও করছে বিভিন্ন ক্লাব ও সংস্থা। জাতীয় ফেডারেশন হিসেবে আমাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব আছে, পরিকল্পনাও সাজাচ্ছি আমরা। পাশাপাশি অন্যান্য ক্লাব ও সংস্থা এগিয়ে এলে কাজটা সহজ হয়।’

সম্ভাবনাময় আবু সুফিয়ান শাকিল (ডানে) হতাশায় খেলা ছেড়ে কোচিং বেছে নেন।

পাইপলাইনে একঝাঁক প্রতিভা:
হতাশার মাঝেও কিছু উদীয়মানের কল্যাণে সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসছেন। মনন রেজা নীড়, তাহসিন তাজওয়ার জিয়া, সাকলাইন মোস্তফা সাজিদ, রায়ান রশীদ মুগ্ধ, ওয়ারসিয়া খুশবু, স্বর্ণাভো চৌধুরী তাদের অন্যতম। এসব খুদে প্রতিভাকে পরিপূর্ণ দাবাড়ু হিসেবে গড়ে তুলতে নতুন পরিকল্পনার কথা জানালেন ফেডারেশন কর্মকর্তারা। এমন পরিকল্পনার কথা অবশ্য নিয়মিতই শোনা যায়; এবার তার বাস্তবায়ন জরুরি।

পরিশেষে:
দেশের অধিকাংশ ফেডারেশনে ক্রীড়াবিদদের উন্নয়নের চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে মসনদ টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। এ জন্য সব ক্রীড়া ফেডারেশনের দায়িত্বশীলরাই সাফল্যর শর্টকাট পথ খুঁজছেন। এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া কোনো ক্রীড়া ডিসিপ্লিনেই উন্নতি করা সম্ভব না। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ঘাটতি স্পষ্ট বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনেও। যে কারণে বছরজুড়ে নানা আয়োজনে দাবা কক্ষ সরব থাকার পরও আদতে উন্নতি নেই। খেতাবধারীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না দাবাড়ুদের মান!

লেখক: সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ