৭২৬ টাকার চোখের লেন্স প্যাকেজে হয়ে যাচ্ছে ৩০ হাজার টাকা
অনিয়ম ঠেকাতে ২০২৩ সালে তৎকালীন সরকার চোখের কৃত্রিম লেন্সের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, বেলজিয়াম, স্পেন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, বার্বাডোজ, হাঙ্গেরি ও গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশের যে ১২৯ ধরনের লেন্সের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এসব লেন্সের দাম ঠিক করা হয়েছিল ১৪৩ টাকা থেকে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকার মধ্যে। তবে কাগজ-কলমে ঠিক থাকলেও চোখের লেন্সের দাম নিয়ে অরাজকতা বন্ধ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি এখনো। অভিযোগ উঠেছে, প্যাকেজের মাধ্যমে অভিনব কায়দায় ভোক্তাদের প্রতারিত করা হচ্ছে। ভারতের সবচেয়ে কম দামি লেন্সের প্যাকেজও এখন ৩০ হাজার টাকা।
দীর্ঘদিন ধরেই চোখের লেন্সের দাম নিয়ে অনিয়ম ও অরাজকতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিলেন ভোক্তারা। কোনো নির্ধারিত দাম না থাকায়, ভোক্তাদের কাছে কৃত্রিম লেন্স বেচা হতো আসল মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে। এমনকি ৫০০ টাকার লেন্স ৫ হাজার টাকায় বেচা হলেও ক্রেতারা সেটা বুঝতে পারতেন না। কারণ দামের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। এই অরাজকতা ঠেকাতেই ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর চোখের লেন্সের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়, লেন্সের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) চোখের অপারেশনের প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
রোগীকে লেন্সের নাম, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ও উৎপাদক দেশের নাম উল্লেখ করে ক্যাশ মেমো দিতে হবে। এমনকি, সেইসঙ্গে ফ্যাকো সার্জারির পর রোগীকে লেন্সের প্যাকেটও সরবরাহ করতে হবে। আর নির্ধারিত দামের থেকে বেশি দাম নিলে ২ বছরের জেল বা ২ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিতের বিধান রাখা হয়েছে। এই নিয়মের তোয়াক্কা না করেই হাসপাতালগুলোতে লেন্স বিক্রি করা হচ্ছে প্যাকেজে। এখানে এসে ভারতের ৭৮০ টাকার অকুফ্লিস লেন্স ও ৭২৬ টাকার গ্লোফোল্ড লেন্স প্যাকেজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়।
অন্যদিকে ১৬ হাজার ৮০০ টাকার অ্যালকোন আইকিউ, জার্মানির ১৯ হাজার টাকা দামের সিটি-লুসিয়া লেন্স প্যাকেজ নামের ফাঁদে ফেলে বিক্রি করা হচ্ছে ৭০ থেকে ৮৫ হাজার টাকায়। এভাবেই সব লেন্সের দাম ৩ থেকে ৫ গুণ, কখনো তারও বেশি বাড়িয়ে বিক্রি করছে অসাধু চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলো। সরেজমিন দেখা যায়, ঔষধ প্রশাসনের বেঁধে দেয়া দামের সঙ্গে হাসপাতালের প্যাকেজের দামে আকাশপাতাল ব্যবধান।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প আয়ের কর্মকর্তা জাফর আহমেদ (ছদ্মনাম) তার মায়ের চোখের জন্য কৃত্রিম লেন্স কিনতে গিয়ে পড়েছেন বিপাকে। চোখের সমস্যায় ভোগা মাকে নিয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এলে তাকে দুই চোখেই লেন্স পরানোর কথা জানানো হয়; কিন্তু দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থেকেও অপারেশনের সিরিয়াল পাচ্ছিলেন না জাফর। বাধ্য হয়েই হাসপাতালের এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সেই কর্মচারী তাকে ধানমন্ডির বাংলাদেশ আই হসপিটালে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সেখানে গিয়ে অবশেষে ঈদের আগে লেন্স প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়।
ভিউজ বাংলাদেশকে জাফর বলেন, খরচের কথা মাথায় নিয়েই হাসপাতালগুলোতে ঘুরেঘুরে বিভিন্ন ধরনের লেন্স ও এগুলোর দাম সম্পর্কে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে গেলাম, ওরা রোগী ছাড়া কথাই বলতে চাইল না। পরে পান্থপথের রেটিনা গ্লোকোমা হাসপাতালে গেলে তারা আমাকে কয়েকটি প্যাকেজ ধরিয়ে দেয়। সেখানে মোটামুটি মানের একটি প্যাকেজ নিতে চাইলেও আমার অন্তত ছয় মাস ধরে প্রস্তুতি নিতে হবে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘স্বল্প আয়ের মানুষ হওয়ায় আমি লেন্সের দাম নিয়ে বেশ খোঁজখবর করি। তাতে যা বুঝি, সেটা হলো সরকার লেন্সের দাম নির্ধারণ করে দিলেও হাসপাতালগুলোর চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন।’
চোখের লেন্স নিয়ে এই নৈরাজ্য কিন্তু সহসাই তৈরি হয়নি, বলছেন ভুক্তভোগীরা। তারা মনে করেন, এরকম গুরুত্বপূর্ণ এক অঙ্গ নিয়ে অনৈতিক এই চর্চা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। তবে, বিষয়টি জীবনঘাতী না হওয়ায় এটি রয়ে যাচ্ছে আড়ালেই। মাঝে মধ্যে ঔষধ প্রশাসন কিছু নির্দেশনা দিলেও সঠিক তদারকির অভাবে সেসব নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয় না। সম্প্রতি রাজধানীর বাংলাদেশ আই হাসপাতাল, লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল, ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল, রেটিনা গ্লুকোমা সেন্টার ও হারুন আই ফাউন্ডেশনের মতো কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় লেন্সের দামে সরকারি নির্দেশনা মানছে না একটি হাসপাতালও। স্বল্প মূল্যের লেন্সকে বিভিন্ন প্যাকেজে নামকরণ করে রোগীদের সঙ্গে ভয়ংকর প্রতারণা করছে তারা। ওটি চার্জ, সিট ভাড়া ও ওষুধের খরচের বাইরেও সার্ভিস চার্জের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েক গুণ টাকা।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে তদারকির অভাবে এই অনিয়ম আরও বেড়ে যায়। ফলে, চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি ঔষধ প্রশাসন স্বপ্রণোদিত হয়ে মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং অপথালমিক প্রোডাক্ট ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে তাদের মেডিকেল ডিভাইসের দাম নিয়ে কড়া বার্তা দেয়া হয়। এর পরেও অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। বরং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ইম্পোর্টাররা একে অপরের কাঁধে দায় চাপাতে ব্যস্ত।
দাম নিয়ে অরাজকতার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের ড. মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালগুলো দাম বাড়াচ্ছে ব্যাপারগুলো ঠিক নয়। বেসরকারি হাসপাতালে গেলে ওটি চার্জ, সিট ভাড়া, নিয়োগকৃত জনবলের চার্জসহ নানা ধরনের চার্জ যুক্ত হয়। আবার হাসপাতালভেদে এই চার্জ কমবেশিও হয়, যা সরকারি হাসপাতালে লাগে না। তাই ঢালাওভাবে অভিযোগ করাটা ঠিক নয়। বরং সাপ্লায়ার কোম্পানিগুলো অতিলাভের চেষ্টায় অতিরিক্ত দামে এগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করছে বলেই আমরা বাধ্য হচ্ছি খরচ বাড়াতে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সরকারের বেঁধে দেয়া দামের থেকেও (সর্বোচ্চ এমআরপি থেকে) ১০ থেকে ২০ শতাংশ কম দামে লেন্স বিক্রি করি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ দাবি সঠিক নয়। হাসপাতালগুলো কেন আমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন।’ অপথালমিক প্রোডাক্ট ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে দেয়া দুটি ঠিকানার কোনোটিতেও কাউকে পাওয়া যায়নি। ডিজিডিএ/ওএসবি/বিএসসিয়ারএস-এর এক প্রতিনিধি বলেন, দাম কমই রাখা হয় কিন্তু হাসপাতালগুলো লাভ করতে গিয়ে এবং চিকিৎসকদের তাদের লভ্যাংশ (লেন্সপ্রতি একটা ভাগ থাকে) দিতে গিয়েই এই খরচ বাড়ছে। যদি তা না হতো, তবে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় এ খরচ সহনীয় পরিমাণেই বাড়ত। এত আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকত না।
যোগাযোগ করা হলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আকতার হোসেন বলেন, ‘চলতি বছরের প্রথম দিকে মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং অপথালমিক প্রোডাক্ট ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের মহাপরিচালক বসেছিলেন। সেখানে তাদের কথাও শুনেছি, আমরাও কিছু নির্দেশনা দিয়েছি। এর পরেও যদি কোনো সুনির্দিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আমরা হাসপাতালগুলোর তদারকি বাড়াচ্ছি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে