ছেলেবেলার ঈদ
সালামি হিসেবে আমি সব সময়ই ২ টাকার নোট পেতে চাইতাম
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ঈদুল ফিতর যে কোনো বিবেচনায়ই বিশেষত্বের দাবিদার। এক মাস কঠোর সিয়াম সাধন করার পর আসে পবিত্র এই ঈদ। রোজা পালনকারী অনেক মুসলমান এই ঈদ উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার তাগিদ অনুভব করেন এবং যথাসাধ্য দান খয়রাত করেন। বিত্তবান-বিত্তহীন সবার জন্যই ঈদ নিয়ে আসে আনন্দের বার্তা, তবে বিত্তবানরা এগিয়ে গেলেই বিত্তহীনদের জন্য সেই বার্তা বাস্তবে অধিক রূপ নেয়।
শিশু-কিশোরদের জন্য ঈদ আরেকটু বাড়তি আনন্দ নিয়ে আসে। অন্য দশ শিশু-কিশোরের মতো আমার শৈশবকালে ঈদ ছিল আনন্দে ভরা। কিশোরবেলার ঈদের কথা মনে হলে এখনো মনে আবেগ সৃষ্টি করে। কতই না আনন্দের ছিল সেইসব দিনের ঈদ। আমার জন্ম হয়েছে ব্রিটিশ আমলে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে। উপমহাদেশ যখন বিভক্ত হয় তখন আমার বয়স ৭ বছরের মতো। সেই সময়ের ঈদের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। আমাদের বাড়িটি ছিল বেশ লম্বা। টঙ্গি ঘর (যেখানে লোকজন এসে কথাবার্তা বলতেন) থেকে মূল বাড়িতে যেতে প্রায় ১ মিনিট লেগে যেত। মূল বাড়ি ছিল বিভিন্ন বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ। চাঁদ দেখার জন্য আমাদের টঙ্গি ঘরের কাছে যেতে হতো। সেখানে বাঁশঝাড় ছিল। সেই বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হতো। বিশেষ করে রোজার শেষ দিনে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে আমরা শিশু-কিশোররা দলবেঁধে সেই বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ঈদের চাঁদ দেখতাম। সেই সময় ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দ ছিল আলাদা রকমের। চাঁদ দেখা গেলে সবার মাঝে হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে যেত। কোনো কারণে চাঁদ দেখা সম্ভব না হলে বা চাঁদ ওই দিন না উঠলে মন খারাপ হয়ে যেত সবার। মনে হতো ঈদের আনন্দ অনেকটাই মাটি হয়ে গেল। ছোটবেলার ঈদের আনন্দ এখনো হৃদয়ে দোলা দেয়। সেই সব দিন ফিরে পেতে কার না মন চায়।
সেই সময় মানে ভারত বিভাগের আগে ২ টাকার একটি নোট ছিল সুন্দর রঙের। তখন দুই টাকার বাস্তব মূল্য ছিল অনেক বেশি। ঈদের সময় মুরব্বিরা ‘সালাম’ দিতেন। সালামি হিসেবে আমি সবসময়ই ওই দুই টাকার নোট পেতে চাইতাম। নোটটা খুব ভালো লাগতো। কেউ যদি বেশিও দিতে চাইতেন আমি খুশি হতাম না। সবাই মোটামুটি বিষয়টি জানতেন। তাই কেউ কেউ বেশি দেয়ার চেষ্টা করে মজা করতেন। মজা করার ব্যাপারটা তখন বুঝতাম না। অনেক পরে বুঝেছি। শার্টের বুকে পকেট ছিল। সালামি হিসেবে পাওয়া টাকা আমি সেই বুক পকেটে রেখে আনন্দ পেতাম। মাঝে মাঝে নোটগুলো বের করে দেখতাম। একটু বড় হওয়ার পর ঈদের বেশ কিছু দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতাম। অন্যদেরও, বিশেষ করে মাকে সহায়তা করতাম। কোরবানির ঈদের সময় পশু ক্রয়ের জন্য হাটে যেতাম হাইস্কুলে পড়ার সময়।
ছোটবেলায় ঈদের দিন এবাড়ি-ওবাড়ি বেড়ানোর প্রচলন ছিল। আমরা দলবেঁধে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। এখন তো এই রীতি প্রায় উঠেই গেছে।
ঈদের সময় প্রত্যেক বাড়িতে সাধ্যমতো ভালো খাবার তৈরি করা হতো। ঈদ ছাড়া অন্য একটা কথা বলি। হঠাৎ মনে পড়ল। ছোটবেলায় আমার মাঝে একটি প্রবণতা কাজ করত। তা হলো ডিমে লবণ দেয়া হলে আমি সেই ডিম খেতে চাইতাম না; কিন্তু আম্মা মনে করতেন ডিমে একটু লবণ দেয়া হলে খেতে ভলো লাগবে। তাই আমি সামনে থাকলে আমাকে কোনো ছুতায় দূরে সরিয়ে ডিমে লবণ দেয়া হতো। না দেখলে আমি লবণ দেয়া ডিম খেতাম, লবণ দেয়া-না দেয়া কিছুই বুঝতাম না।
সিলেটে ময়দা-চিনি দিয়ে এক ধরনের বিশেষ খাবার তৈরি করা হয় তেলে ভেজে, কোথাও কোথাও ‘বুলবুলা’ বলা হয়। চালের গুঁড়া দিয়েও করা হয়। ছোটবেলায় এটা আমার খুব প্রিয় খাবার ছিল। অবশ্য এখনো এই খাবারটি আমি বেশ পছন্দ করি; কিন্তু ডায়াবেটিস থাকায় খাওয়া তেমন যায় না। এ ছাড়া আমি প্রায় সব ধরনের খাবারই পছন্দ করতাম, এখনো করি তবে ওই যে ডায়াবেটিস।
আমার যখন ৪-৫ বছর বয়স তখন আব্বা ছিলেন আসাম এসেম্বির এমএলএ। আব্বা সেই সময় থেকেই আমাকে সঙ্গে করে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে নিয়ে যেতেন। আসাম প্রাদেশিক অনেক নেতাকে চিনতাম। যাত্রাপথে গল্পের ছলে আব্বা আমাকে পড়াতেন। অন্যত্রও সময় সুযোগ হলে। বিশেষ করে ইংরেজি এবং বাংলা পড়াতেন। একটি লম্বা খাতা তিন ভাগ করা হতো। প্রথম ভাগে থাকত মূল যেটাকে অনুবাদ করতে হবে। দ্বিতীয় ভাগে থাকত আমার অনুবাদ। তৃতীয় ভাগে সংশোধিত অনুবাদের কপি করতে হতো। এভাবে আমার অসংখ্য খাতা জমে গিয়েছিল। বাংলা ও ইংরেজি শেখার মূল চর্চাটা সেভাবেই আমার হয়েছে। অন্যত্র বলেছি আমি কখন প্রথম স্কুলে পড়তে যাই, যা ছিল অষ্টম শ্রেণিতে এবং পরে আমার পড়াশোনা কেমন চলেছে। এই লেখা এ পর্যন্তই। সবার প্রতি ঈদুল ফিতরের অশেষ শুভেচ্ছা।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে