Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বিমানের টিকিট জালিয়াতি

‘ওভার বুকিং’ কারসাজিতে ২১ হাজারের টিকিট ২ লাখ ৪০ হাজারে বিক্রি

Special  Correspondent

বিশেষ প্রতিনিধি

বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪

'ওভার বুকিং' কারসাজির মাধ্যমে একটি চক্র বিমান বাংলাদশ এয়ারলাইন্সে প্রায় দেড় বছর ধরে অবাধে টিকিট জালিয়াতি করছে। চক্রটির কবলে পড়ে গত মে মাসে কুয়ালালামপুরগামী যাত্রীরা ২১ হাজার টাকার টিকিট ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় কিনতে বাধ্য হয়েছেন। চক্রের সঙ্গে খোদ বিমানের কিছু কর্মকর্তাসহ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি জড়িত।

বিমান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত ও ভিউজ বাংলাদেশের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিমানের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওভার বুকিং কারসাজির সঙ্গে জড়িত বিমানের ১০ কর্মকর্তা। কারসাজিতে তাদের সহযোগিতা করেছে ১৪ ট্রাভেল এজেন্সি।

প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের মধ্যে কোন কর্মকর্তা সুনির্দিষ্টভাবে কী ধরনের জালিয়াতি করেছেন, তারও বিবরণ দেয়া হয়েছে; কিন্তু প্রতিবেদনে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা কীভাবে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সে বিষয়েও কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশি নতুন কর্মীদের কুয়ালালামপুর যেতে বেঁধে দেয়া সময় ছিল চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়সীমা সামনে রেখে এপ্রিল-মে মাসেই টিকিট নিয়ে বড় জালিয়াতি হয়।

একাধিক ট্রাভেল এজেন্সির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভিউজ বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসজুড়ে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে বিমানের ২০ হাজার ৪৭৫ টাকার টিকিট ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।

একই সময়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সসহ অন্যান্য দুই-তিনটি এয়ারলাইন্সের টিকিট ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

অনেকে ফ্লাইটে সরাসারি না গিয়ে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দিল্লি এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, শারজাহ কিংবা দোহাতে ট্রানজিটের মাধ্যমেও কুয়ালালামপুরে গেছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকিটের সেই চরম হাহাকারের সময়েও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রতিদিনের ফ্লাইটে ২০-৩০টি আসন ফাঁকা গেছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে বিমানের টিকিট অস্বাভাবিক দামে বিক্রির খবর একাধিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলে গত ৩ জুন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়।

আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালজুড়ে কয়েকটি রুটের টিকিট জালিয়াতি নিয়ে বিমান বাংলাদেশ আরও একটি তদন্ত করে। অভ্যন্তরীণ সেই তদন্ত প্রতিবেদন চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ে আসে। প্রতিবেদনে যেসব কর্মকর্তা অভিযুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তারা আবারও ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের টিকিট জালিয়াতিতে জড়ায়।

বিশেষ ফ্লাইটে অনিয়মের তথ্য
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গত ২৭ মে ২টি, ২৮ মে ১টি, ২৯ মে ২টি এবং ৩০ মে ২টিসহ মোট ৭টি ঢাকা-কুয়ালালামপুর বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে।

ফ্লাইটগুলোর মধ্যে ৫টিতে ২ হাজার ১৫০টি আসন ছিল। এর মধ্যে সর্বমোট ১ হাজার ১৪৬টি সিট ম্যানুয়ালি ওভারবুক করা হয়। অর্থাৎ উল্লিখিতসংখ্যক সিট বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির জন্য ব্লক করা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সিগুলো ব্লক সিট বিমান নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে সাধারণ যাত্রীদের কাছে বিক্রি করার সুযোগ পায়।

যেভাবে জালিয়াতি
বিমানের তদন্ত প্রতিবেদনে জালিয়াতির বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, বিমানের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন রুটের আসনসংখ্যা ও টিকিট বিক্রি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল। এই দায়িত্বের অংশ হিসেবে তারা বিমানের বিভিন্ন রুটের টিকিট ম্যানুয়ালি বুকিং কিংবা ওভারবুকিং করতে পারতেন।

বিদ্যমান এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিউর) অনুযায়ী, এসব কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হতো না। এই সুযোগ নিয়েই তারা দীর্ঘদিন ধরে বিমানের বিভিন্ন রুটের টিকিটে ওভারবুকিং করেছেন।

তদন্তে দেখা গেছে, ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে একটি ফ্লাইটে ব্যবহৃত উড়োজাহাজের আসনসংখ্যা ছিল ৪১৯টি। এর মধ্যে ৩৫টি বিজনেস ক্লাস এবং ৩৮৪টি ইকোনমি ক্লাস। অভিযুক্ত কর্মকর্তারা ৪১৯টি আসনই বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করে ‘নেস্টিং’ করেছেন।

নেস্টিং প্রযুক্তি হচ্ছে একটি কোড ব্লকের ভেতরে আরও একটি কোড ব্লক অন্তর্ভুক্ত করা। অর্থাৎ অভিযুক্ত কর্মকর্তারা প্রতিটি আসনের জন্য নির্ধারিত কোড ব্লকের মধ্যে নতুন কোড ব্লক ব্যবহার করে নিজেরাই সব টিকিট বুকিং দেখিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে টিকিট ওভারবুকিং দেখানো হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) তার কোড ব্যবহার করে ছয়বার বিমানের ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের আসনসংখ্যা নেস্টিংয়ের মাধ্যমে কম-বেশি করেছেন। এ সময় একটি ফ্লাইটে ব্যবহৃত উড়োজাহাজে ৩৫৪টি ইকোনমি আসন ছিল। সেই আসনসংখ্যাকে ওই সহকারী ব্যবস্থাপক একবার ৩৮৪, একবার ৩৮৯ এবং সর্বশেষ ৩৯২টি আসন দেখিয়ে ‘ওভার বুকিং’ করেন।

ওই কর্মকর্তারা ওভার বুকিং দেখিয়ে নির্দিষ্ট ফ্লাইটের সব টিকিট বিক্রি হয়েছে এমন তথ্য টিকিট কাটতে আসা যাত্রীদের সামনে হাজির করতেন। এরপর টিকিট না পাওয়া যাত্রীদের তাদের সঙ্গে যুক্ত ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাছে যেতে পরামর্শ দিতেন কর্মকর্তাদের ভাড়া করা কিছু দালাল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেও দালালরা যাত্রীদের টিকিটের জন্য কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন। যাত্রীরা সেখানে গেলে টিকিটের অতিরিক্ত দাম চাওয়া হতো।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকিটের দাম দুই থেকে তিন গুণ বাড়ানো হতো। ভিউজ বাংলাদেশকে একাধিক সাধারণ ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকর্তা এবং ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি ২১ হাজার টাকার টিকিটের দাম ন্যূনতম ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। গত মে মাসে কুয়ালালামপুর গন্তব্যে সর্বশেষ ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় ইকোনমি ক্লাসের টিকিট কিনতে হয়েছে।

ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, ওই এজেন্সিগুলোর কোনো অফিস তারা চিনতেন না। এমনকি সরাসরি এজেন্সির কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারতেন না। দালালদের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হতো এবং তারাই ক্যাশ টাকা হাতে নিয়ে টিকিট দিয়ে যেতেন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত এজেন্সিগুলো প্রকৃতপক্ষে ছায়া এজেন্সি। বিমানের অভিযুক্ত কর্মকর্তারাই নিজেদের চক্রের ব্যক্তিদের নামে ভুয়া কাগজপত্রের মধ্যেমে এজেন্সি খুলতেন। এসব ব্যক্তি কালোবাজারে অতিরিক্ত দামে টিকিট বিক্রি করতেন এবং বিমানের অভিযুক্ত কর্মকর্তারা সেই টিকিট কনফার্ম করতেন। ফলে অভিযুক্ত এজেন্সির নাম কখনোই কেউ জানতে পারত না। একই কারণে তদন্ত প্রতিবেদনেও তাদের নাম আসেনি।

টিকিট ওভার বুকড, ফ্লাইট ছাড়ার সময় আসন খালি
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত এপ্রিল-মে মাসে প্রতিদিনই ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের ফ্লাইটে টিকিট ওভারবুকিং থাকত। তবে মে মাসের শুরুতে কয়েকটি ফ্লাইটে আসনসংখ্যা খালি দেখতে পাওয়া গেছে। এ সময় ফ্লাইটগুলো ছাড়ার সময় বিজনেস ক্লাসের আসনগুলো সাধারণত ফাঁকা থাকত। কিছু ইকোনমি ক্লাসের আসনও ফাঁকা থাকত। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, টিকিটের দাম অস্বাভাবিক হওয়ায় কালোবাজারেও কিছু ফ্লাইটের সব টিকিট বিক্রি হতো না। আর কালোবাজারিরা বিজনেস ক্লাসের টিকিট পৃথকভাবে বিক্রি করত না। কারণ ইকোনমি ক্লাসের টিকিটই ২ থেকে ১০ গুণ দামে বিক্রি হতো। ফলে বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কালোবাজারিরা লাভবান হয়েছে।

অভিযুক্তরা যা বলছেন
প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ১০ জন কর্কমর্তার বক্তব্য পৃথকভাবে নেয়ার কথা উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি। প্রত্যেক অভিযুক্তই জানিয়েছেন, ‘ওভার বুকিং করার বিষয়টি’ তাদের মনে নেই। কিংবা সে সময়ে নিয়ম মেনেই কোনো বিশেষ প্রয়োজনে ওভার বুকিং করেছিলেন।

প্রতিবেদনে বিশেষভাবে বিমানের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের (বর্তমানে অবসরে রয়েছেন) নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি এ সময় বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তার সময়েই কয়েকজন কর্মকর্তা ‘ওভারবুকিং’ কারসাজির জন্য অভিযুক্ত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কখনোই ব্যবস্থা নেননি বা অভিযোগ আমলে নেননি। কারসাজির সঙ্গে জড়িত ট্রাভেল এজেন্সি চিহ্নিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং টিম লিডার হওয়া সত্ত্বেও তিনি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাকে সমর্থন করেছেন এবং কোনো লিখিত প্রমাণ না রেখে মৌখিক নির্দেশের ভিত্তিতে অধিকাংশ ফ্লাইটে ওভারবুকিং বা ম্যানুয়ালি কনফার্ম বুকিং রেখেছিলেন।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, এ ধরনের কোনো তদন্ত কার্যক্রমের কথা আমি জানি না।

তিনি জানান, তিনি অবসরে গেলেও তদন্ত কমিটির উচিত ছিল তার সঙ্গে সরাসারি যোগাযোগ করে বক্তব্য গ্রহণ করা এবং সেই বক্তব্য তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করা; কিন্তু তদন্ত কমিটি তা করেনি। ফলে তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি কিছুই অবহিত নন। এ কারণে তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে তার পক্ষে কোনো মন্তব্য করাও সম্ভব নয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ