বাংলাদেশে থাকতে হলে মুক্তিযুদ্ধ মেনেই থাকতে হবে
স্বাধীনতা যুদ্ধ সবসময়ই আমার কাছে ইমোশনাল ব্যাপার। যুদ্ধে গিয়েছি। যুদ্ধের বেদনা নিয়ে আমি সবসময় চলি। চোখের সামনে ভাসছে- সাথী পড়ে গেছে। গুলি খেয়েছে। তার মধ্যে লাফ মেরে উপরে উঠেছে। আমাকে বলেছে- ‘মামা, মাকে দেইখো আর তো।’ কেউ রইল না। মায়ের একমাত্র সন্তান পাগল হয়ে মরছে। গাঙ সাঁতরাইয়া পার হইছি, পাকিস্তানি বাহিনীর গুলি খাইছি। পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে একদিনে ১৫ হাজার লোক মারছে বুড়িগঙ্গাতে। বুড়িগঙ্গা লাল হয়ে গেছে। ১০ হাজার লোক মারছে জিঞ্জিরাতে। এক দিনে ২৫ হাজার লোক মারা গেছে শুধু কেরানীগঞ্জে। ২ মে জিঞ্জিরা-কেরানীগঞ্জে একটা বাড়িঘরও ছিল না, সব পুড়ে ফেলেছে পাকিস্তানি বাহিনী। সেই মুক্তিযুদ্ধে নদী সাঁতরিয়ে রাইফেলটা নিয়ে পার হয়েছি। শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করেছে, বাঙ্কারে ক্রলিং করে যাইতেছে। কারও পা গেছে। কারও চোখ গেছে। কারও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ গেছে। কেউ সম্ভ্রম হারিয়েছে। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে- তারপর পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়েছে।
আমার এলাকা কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার ৩৬ গ্রাম, চারশ মানুষ একসঙ্গে নৌকা দিয়ে ইন্ডিয়া যাচ্ছিল। ইটনা থানার সামনে দিয়ে আসার পর সব স্পিডবোট দিয়ে রাজাকার আর পাকবাহিনী ধরে চারশ লোককে মেরেছে। চারশ লোককে তিন ঘণ্টার মধ্যে গুলি করে পানিতে ফেলে দিয়েছে শ্রাবণের বর্ষায়। চারশ লোক একটা গ্রামে, একটা লোকও জীবিত ছিল না। এখন এটা মিঠামন থানার কাঠখালী ইউনিয়নে, তখন ছিল ইটনা থানার কাঠখালী ইউনিয়ন ৩৬। সেই গ্রামে ৪২৬ জন লোক একসঙ্গে মারা গেছে এক দিনে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের দু-একটা ঘটনার মধ্যে প্রথমদিকের যুদ্ধটা আমার কাছে কখনোই ভুলবার নয়। সেই যুদ্ধ ছিল ভারতের ডাউকিপাড় তামাবিল জাফলং মেঘালয়ে। ছিল জুন মাস। আমাদের কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী বীরউত্তম। এ পারে পাকিস্তানিরা আর আমরা ইন্ডিয়ার পারে। সেই প্রথম যুদ্ধে তিন থেকে চার দিন আমি বাঙ্কারে ছিলাম। তখন অতটা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিলাম না। নির্ভয়ে চলে গেছি জীবনটা দেয়ার জন্য যে, শহীদ যদি হতে হয় প্রথম যুদ্ধেই মারা যাব। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। আমরা জয়লাভ করি চার দিনের মধ্যে।
আমার আরেকটি স্মৃতিময় যুদ্ধ সেটি আমার শেষ যুদ্ধ। এরপর আমি আর যুদ্ধ করিনি। এটা কালনি-কুশিয়ারার যুদ্ধ। ৭ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে যখন পাকবাহিনীর পতন হলো, তারা যখন স্টিমার নিয়ে ঢাকার দিকে আসছিল। কারণ সব রাস্তা বন্ধ। তিনটা স্টিমার নিয়ে আসছিল তারা। সুনামগঞ্জের যে নদী দিয়ে তারা আসতেছিল সেই কালনি-কুশিয়ার নদী অনেক পথ। প্রায় একশ কিলোমিটারের নদীপথে কোনো মুক্তিযোদ্ধা তাদের বাধা দেয়ার সাহস পায়নি। সুনামগঞ্জের পরের থানা হলো জামালগঞ্জ। জামালগঞ্জের পর বিরল, তারপর শাল্লা। তারপর আজমেরীগঞ্জ। আজমেরীগঞ্জের পর আমি যেখানে বাধা দিয়েছি সেটি হলো ইটনা থানা। পাঁচটা থানা পার হয়ে এসে পড়ছে কেউ বাধা দেয় নাই পাকিস্তানি বাহিনীকে; কিন্তু আমি বাধা দিয়েছি। সেই যুদ্ধেও আমরা তাদের পরাজিত করেছি। সেই যুদ্ধে মূল মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম মাত্র তিনজন। কমান্ডার আমি, আমার সঙ্গে ডেপুটি কমান্ডার নেহারিন্দু দেবনাথ আর আরেক বিখ্যাত যোদ্ধা আবু তাহের ঠাকুর। আমাদের সহযোগিতা করেছে পাবলিক। পাবলিকদের মধ্যে আজমেরীগঞ্জ থানার কাকাইলছেও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নুরুল হক ভুঁইয়া, তার ভাই মেজবাহ ভুঁইয়া বন্দুক দিয়ে সহযোগিতা করেছে। কাটখাল ইউনিয়নের রইসউদ্দীন ইউছুপসহ অনেক পাবলিক লাইনডাউন করে শুয়ে গেছে। দেখা গেছে তারা বন্দুকের মুখে। সারেং পরে গেছে। এটা হলো গেরিলা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৮৯ জন আমার কাছে ধরা পড়েছে। এটা আমার শেষ ঐতিহাসিক স্মরণীয় যুদ্ধ। এই দুটি যুদ্ধ আমার স্মৃতিতে খুব ভাসে।
যাহোক, দেশ স্বাধীন হলো। ৫৫ বছরে যে কিছুই হয়নি, এটা বলা ঠিক হবে না। এটা বড় কৃপণতা হবে আমাদের। ভালো-মন্দ অনেক কিছু হয়েছে। আমরা যা ছিলাম না, তা হয়েছে। ১৯৫৮ সাল থেকে আমি দেখেছি, মানুষের একটা শার্ট পরতে খুব কষ্ট হতো। নতুন জামাই শ্বশুরবাড়িতে গেলে একজোড়া জুতা গ্রামের অন্য কারো আছে কি না, সেটা খুঁজে নিয়ে সেই জুতাটা হাতে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির কাছে গিয়ে পায়ে লাগাত- এটা ছিল আমাদের অনেকেরই গ্রামীণ অবস্থা।
১৯৭১ সাল। ‘রক্ত সূর্য উঠছে, বীর বাঙালি জেগেছে।’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ তখন আমাদের কী ছিল- একটা শার্ট, একটা প্যান্ট। হলে থাকতে খাইতে পারতাম না গরিব ছিলাম। কোনো বাঙালি কোটিপতি ছিল না। দুজন বাঙালি শুধু কোটিপতি ছিল বলে বলা হতো। এক চট্টগ্রামের এ কে খান, আরেকজন ময়মনসিংহের জহরুল ইসলাম। আর কি! ৫ কোটি টাকার মালিক নাকি তারা ছিল। সবাই বলতো ৫ কোটি টাকার মালিক জহরুল ইসলাম।
যুদ্ধ করলাম দেশ স্বাধীন হলো। লুট হয়েছে, ব্যাংক লুট হয়েছে, বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে। ২২ পরিবার চলে গেছে। আজকে যদি পাকিস্তান থাকত তাহলে গুলিস্তানের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতাম- কে যায়রে? আদমজীর নাতি যায়। কি তার নাম? তার নাম রাহাত খান। তার গাড়ি, আরেহ বাবা! আদমজীর নাতির গাড়ি দেখতাম, ইস্পাহানির গাড়ি দেখতাম। বাওয়ালিদের গাড়ি দেখতাম। এখন তো এটা আমাদের দেখতে হয় না। এখন তো বাঙালি ছেলের গাড়ি দেখি, হোক সে গণবিরোধী, গাড়িটা তো বাঙালির ছেলের। ব্যাংকটা তো বাঙালিদের। হাজার কোটি টাকা তো বাঙালিদের হয়েছে। লুটপাট হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। ১৯৭২ সালে সাড়ে সাতশ কোটি টাকার বাজেট ছিল। তাজউদ্দিন আহমেদ অর্থমন্ত্রী হিসেবে যে বাজেট পেশ করেন, তখন বাজেট ছিল সাড়ে চারশ কোটি টাকার। এখন, গত বছর বাজেট হয়েছে সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকার- পার্থক্যটা বুঝেন। কাজেই স্বাধীনতা হয়ে কিছুই হয় নাই এটা বলা ঠিক হবে না।
বাঙালির ছেলে কর্নেলের কেউ ওপরে ছিল না। উসমানির মতো ব্রিলিয়ান্ট অফিসার অব দ্য ওয়াল্ড; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্বর্ণপদক পাওয়া ব্রিটিশের সৈনিক মেজর ওসমানিকে ব্রিটিশ জেনারেল মন্টগোমারি বলেছিল - ‘দিস বয় ওয়ান সি ইউল বি দ্য জেনারেল অব ইন্ডিয়া। ‘ইন্ডিয়া ভেঙে পাকিস্তান হলো; কিন্তু বাঙালির ছেলে কর্নেলের ওপরে হতে পারল না; কিন্তু আজকে বাঙালির ছেলে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। শত শত জেনারেলের নামই মনে রাখতে পারি না। অথচ কোনো বাঙালির ছেলে কিন্তু মেজর জেনারেল ছিল না। অতএব; যুদ্ধ আমাদের বাঙালির ছেলেদের মেজর জেনারেল বানিয়েছে। বাঙালির একমাত্র সন্তান পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের লিংক ছিল তিনি জেনারেল হয়েছিলেন, তার নাম শফিউল আজম। সে ছিল তখন বাঙালির একজন সেক্রেটারি। কোনো বাঙালির ছেলে ডেপুটি সেক্রেটারির ওপরে ছিল না। এখন শত শত সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, ফরেন সেক্রেটারি এই সেক্রেটারি ওই সেক্রেটারি, পায়নি কে? এখন পাকিস্তান-ইন্ডিয়ার সঙ্গে সমানে সমানে বসে আমার সেক্রেটারি এবং তার সেক্রেটারি।
তখন ১৯টা জেলা ছিল যখন আমরা যুদ্ধ করি। ১৯ জেলার মধ্যে ৯টা জেলার ডিসি ছিল অবাঙালি। এসডিও যে কত অবাঙালি ছিল এটার কোনো ঠিকানা ছিল না। জিজ্ঞেস করতাম, বাড়ি কোথায়? সীমান্ত প্রদেশে। বাড়ি কোথায়? লান্ডিকোটাল। বাড়ি কোথায়? রাওয়ালপিন্ডি। এখন যে শতকরা শতভাগ বাঙালির ছেলে এসডিও, ডিসি, ইউএনও, ডেপুটি সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, এডিশনাল সেক্রেটারি, মুখ্য সেক্রেটারি- মুক্তিযুদ্ধ তো বাঙালিকে এটা দিয়েছে। কাজেই কিছুই পাই নাই, এটা বলা ঠিক হবে না। একটা বাঙালির ছেলে বাইরে যেতে হলে পাসপোর্ট করতে হতো লাহোর পিন্ডি অথবা ইসলামাবাদে গিয়ে। এখন বাঙালির প্রায় ১ কোটি মানুষ সারা পৃথিবীতে থাকে। অনুদান হিসেবে কত হাজার হাজার কোটি ডলার পাঠায় প্রতি মাসে। আমাদের দেশে এদের কোনো ঠিকানা নাই। পৃথিবীর যেখানে যাবেন, বাঙালি নাই পাবেন না। কাজেই স্বাধীনতা আমাদের কিছুই দেয় নাই এটা বলাটা বড় নেতিবাচক কথা।
হ্যাঁ, যতটুকু দেয়ার দরকার ছিল ততটুকু আমরা পাই নাই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অধঃপতন হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলো আরও উন্নত হওয়ার দরকার ছিল। আমাদের রিচার্স আরও বেশি হওয়ার দরকার ছিল। আমাদের বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড এর চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার দরকার ছিল- সেটা আমরা পাই নাই। আরও অনেক উপরে ওঠার দরকার ছিল- সেটা হয়নি। পাকিস্তান আমলে না খেয়ে থেকেও আমাদের যে সততা ছিল, সেই সততাটা লুটেরা অর্থনীতির কারণে নষ্ট হয়েছে। আমরা সবাই অর্থ-বিত্তের পেছনে ছুটি। কেউ পাই কেউ পাই না, কেউ আশায় থাকি কেউ ব্যর্থ হই। ব্যর্থ যে হই সে মুখ লুকাইয়া বাঁচি। সফল হই যারা, দেশকে ভালো না বেসে বেগমপাড়ায় বাড়ি বানাই। মালয়েশিয়াতে সেকেন্ড হোম করি। টাকাটাকে লুটপাট করে সিঙ্গাপুরে বাড়ি কিনি। দেশপ্রেমটা আমাদের যেন কমে গেছে। দেশপ্রেম কমার পেছনে আছে লোভ আর লোভের পেছনে আছে অর্থনীতি, যাকে বলা হয় লুম্পেন ইকোনমি।
অপরদিকে, গ্রেট অব দ্য লিডারশিপ নিচে নেমে গেছে। আগের সেই ন্যালসেন ম্যান্ডেলা নাই, ইয়াসিন আরাফাতও নাই। আগের সেই নেতৃত্ব গান্ধীও নাই, মিশরের নাসের নাই, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোও নাই, জওহরলাল নেহেরু নাই- বুঝতে হবে কিন্তু। লিডারশিপের মানটা কমে গেছে। যে কারণে আমাদের দেশে শুধু ক্ষমতার প্রাপ্তি। কারণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে পরে অর্থনীতি আমার ভাগ্যে আসে। সেই কারণে আমার দেশে আজকে খারাপ কাজ হচ্ছে। কাজেই, স্বাধীনতার ফলে পেয়েছি অনেক। খুব যে পাই নাই তা নয়। আরও বেশি পেতে পারতাম যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঠিক থাকতো এবং সঠিক পথে যদি দেশ থাকতো। বঞ্চিত হয়েছি অনেক কিছু থেকে। হারাইছিও অনেক। এ দেশটাকে আমরা রাজনীতিবিদরা যে কোনো কারণেই হোক সঠিকভাবে চালাতে পারিনি। তারই পরিণতি হলো আজকের ইউনূস সরকার।
আমার কথা স্পষ্ট। বাংলাদেশে থাকতে হলে মুক্তিযুদ্ধ মেনেই থাকতে হবে। কথাটা খুব ঠিক। কারণ মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিলে তো বাংলাদেশ থাকে না। মুক্তিযুদ্ধ হলো বাংলাদেশের মায়ের নাম। মুক্তিযুদ্ধের পেট চিরে এই বাংলাদেশ বের হয়েছে। এর পরে বাংলাদেশ। না হলে তো এটা পূর্ব পাকিস্তান। কাজেই মাকে যারা অস্বীকার করে, তারা সুসন্তান না। যখন দেখি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রং ঢং কইরা যারা কথা বলে, এত কষ্ট হয়, মনে মনে বলি- হায় আল্লাহ, আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছে তুমি? আমার মৃত্যু দাওনা কেন? এগুলো তো আমার শোনার কথা না। শেখ মুজিব নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, নেতাদের নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, শাসন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন থাকবে কেন?
হে বাঙালি, কিছুই বুঝবেন না, কিছুই জানবেন না? এ দেশের ভাত খান, এ দেশের কাপড় পরেন। এ দেশে আপনার সন্তানের জীবন চলে, মুক্তিযুদ্ধটা ভুলে যাবেন?
অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান: গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে