Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বাঁচতে হলে রুখতে হবে পরিবেশের মরুময়তা

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

মঙ্গলবার, ৪ জুন ২০২৪

ত দুই দশক ধরে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ দেখছে পুরো বিশ্ব। মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে যেখানে এক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার করতে হতো, সেই মরুর বুকে ফুটে উঠেছে বৃষ্টি আর সবুজের চিত্র । আবার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশ ও ইউরোপে। নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বেশিরভাগ এলাকায় এখন গ্রীষ্মকালে থাকে মরুর লু হাওয়া। অধিকাংশ সময়ে ঠান্ডা থাকা ইউরোপে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখনই কমানো না গেলে খুব দ্রুতই বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে। মরুময়তায় আচ্ছাদিত হতে পারে এই পুরো অঞ্চল।

আইপিসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে। এর প্রমানও মিলেছে। এবারের এপ্রিলে একটানা ৩১ দিনের মতো তীব্র তাপদাহে জনজীবনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এ সময়ে ৫৮ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে গত ৩০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে মরুময়তার দিকে এগিয়ে নেওয়া একটি ইঙ্গিত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘুর্ণিঝড় রিমাল অস্বাভাবিকভাবে অতি দীর্ঘ সময় ধরে অতিক্রম করে।

অন্যদিকে, বিগত চার দশকে পলিমাটি আর বালুতে প্রমত্তা পদ্মার বুক ভরাট হয়ে গেছে অন্তত ২০ মিটার পুরু হয়ে। পানির প্রবাহ না থাকলে পলি অপসারণও হবে না। এখন বর্ষাকালেই রাজশাহী কুষ্টিয়া অঞ্চলে পদ্মায় দু’কূল ছাপানো ঢেউ আর চোখে পড়ে না। আর খরা মৌসুমে পুরোটা পদ্মার বুক যেন তপ্ত মরুভূমি হয়ে ওঠে। প্রবাহ ফেরাতে না পারলে অচিরেই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে পদ্মা। সম্প্রতি পদ্মায় মাছ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক অংশ নেন। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭.৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬.২ শতাংশ। আর মিঠাপানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ নামে নেদারল্যান্ডস থেকে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী গত বছর জানুয়ারি সংখ্যায় তাদের গবেষণার ফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯.২ শতাংশ কমেছে। এই অববাহিকায় ১৯৮১ সালে যেখানে তাপমাত্রা ছিল ২৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬.২ ডিগ্রিতে। মূলত পদ্মার প্রকৃত অবস্থা বুঝতেই গবেষণার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেওয়া হয় বলে জানান গবেষকরা।

অন্যদিকে, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ সব সময়ই দুর্যোগপ্রবণ দেশ, এর পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দুর্যোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে তীব্র তাপদাহ, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা, নদীভাঙন কিংবা বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের স্বাভাবিক জীবনে। বৈশ্বিক জলবায়ু সূচক-২০২১-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড় ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।

পরিবেশবিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এখানে বন্যা, আকস্মিক বন্যা, ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, লবণাক্ততা ইত্যাদির মাত্রা বেড়ে যাবে। উত্তরাঞ্চলে খরা ও মরু প্রবণতা দেখা দেবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ঝড় ও সাইক্লোনের প্রকোপ বাড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হলে বাংলাদেশের নদী-মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের ওপর নেমে আসবে বিপর্যয়। শত শত বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চল অধিক মাত্রায় প্লাবিত হবে। বন্যার ব্যাপকতায় মানুষের জীবনধারণ, কৃষি, গবাদিপশু, দালানকোঠা ও ভৌত কাঠামো ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হবে। এর প্রমাণ বিগত বছরগুলোর ভয়াবহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও খরা। সিলেট অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যাও এর আরেকটি প্রমাণ। উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাসহ বিভিন্ন এলাকা আকস্মিকভাবে বন্যাকবলিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানি সংকটের কারণে যেমন বিভিন্ন অঞ্চল মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি উজানের পানির ঢলে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন নিঃসন্দেহে এ অবস্থাকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।

আইপিসিসির সর্বশেষ গবেষণা থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমান সময়ের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্ষাকালে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির তুলনায় শীতকালে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার হবে বেশি। শীতের তীব্রতা অনেকটাই কমে যাবে; কিন্তু গ্রীষ্মকালে গরমের মাত্রা ক্রমেই বাড়বে। এতে দেশে ছয়টি ঋতুর পরিবর্তে শুধু চারটি ঋতু আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাবে। বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন। উষ্ণতার এ হার যদি অব্যাহত থাকে, তবে মোট স্থলভাগের অনেক এলাকার ভূমি বিলীন হবে। ফলে তা সীমিত ভূমির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলবে। আরো প্রভাব, আরো ব্যাপক মরুময়তা, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ রয়েছে আরো নানা দুর্যোগ। জমির উর্বরতা হ্রাস পাবে। ফলে উৎপাদন কমে যাবে। সম্পদের সংকট আর জনসংখ্যার আধিক্য মিলে দেখা দেবে এক অপরিহার্য দুর্ভোগ।

তাই, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ও পরিবেশ রক্ষায় এখনই বিশ্বকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এ সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়নের অভাবে রয়েছে। প্রতিবার উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু পূরণ করে না। পর্যাপ্ত অর্থায়ন ছাড়া জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য কষ্টসাধ্য। চলতি অর্থবছরে, বাংলাদেশ সরকার অভিযোজনের জন্য ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে, যার মধ্যে স্বাস্থ্যও অন্তর্ভুক্ত। আমাদের বার্ষিক প্রয়োজন প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। বাকি অর্থের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। অথচ আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছি না, কারণ প্রতিশ্রুতি এবং অঙ্গীকারগুলো সবসময় অপূর্ণ থাকছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও খারাপ হতে দিতে পারি না। এজন্য বায়ুতে কার্বন নির্গমন কমাতেই হবে। অভিযোজনের সীমা রয়েছে। যদি আমরা আমাদের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ না করি, তবে আমরা আরও গভীর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবো।

এমনই এক দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে: ‘করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’ (Land restoration,desertification & drought resilience )। এখন দেখার বিষয় মরুময়তা রুখে ও খরা সহনশীলতা অর্জন করে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বকে বাঁচাতে আগামীতে কতটা সক্ষম হই এই ধরিত্রীবাসীরা।


লেখক: সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ