উদ্বোধনী সংখ্যা ১ : স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যাত্রা
স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য নারীকে কতটা প্রস্তুত হতে হবে?
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন চোখ থেকে মুছতে না মুছতেই এদেশের মানুষের চোখে ভর করেছে এক নতুন স্বপ্ন। স্মার্ট বাংলাদেশ। ভেঙে বললে, যা সাশ্রয়ী, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী, টেকসই আর বুদ্ধিদীপ্ত এক দেশের কথা বলে। অর্থাৎ দেশ সাজবে নতুন সাজে। কেবল সাজ-সজ্জায় নয়, চলনে বলনে সবকিছুতেই দেশ হবে অত্যুজ্জ্বল, ঝকঝকে ও দেদীপ্যমান। ২০৪১ সালে অর্থাৎ মাত্র ১৮ বছরের মাথায় বাংলাদেশ জায়গা করে নেবে উন্নত দেশের কাতারে।
ধুলোমাটির দেশ বাংলাদেশ। ‘পেটের ভাত’, ’চোখের ঘুম’ পেলেই যে জাতি সন্তুষ্ট থাকত, তারাই ধুলোমাটি ঝেড়ে আবার নতুন করে, নতুন পথে চলার স্বপ্ন দেখছে। আয়তনে ছোট হলেও এদেশ কোটি কোটি মানুষের দেশ। গুনলে ১৬ কোটি। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই প্রায় ৮ কোটি ৩৩ লাখ, ৪৭ হাজার, যা পুরুষের তুলনায় বেশিতো বটেই, উপরন্তু মোট জনসংখ্যার ৫০.৪ ভাগ । কাজেই, জনবল হিসেবেও তারা যেমন গন্য, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর মধ্যে সবাই কর্মক্ষম নয়। বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকও আছেন, যারা কাজ করতে সক্ষম নন।
নারী, পুরুষের ‘বহুকালের সঙ্গী’। সৃষ্টিকর্তাই বুঝি সবার আগে বুঝতে পেরেছিলেন সেইকথা। নারীবিহীন জীবন, অপূর্ণ জীবন। জগৎ সংসারে যা কিছু আছে, সবখানেই নারীর বিস্মিত বিচরণ। কাজেই সেই নারীকে বাদ দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া প্রায় অসম্ভব কথা। পৃথিবী যত পুরোনো হবে, নারীর প্রয়োজন আর গুরুত্ব ততই বেড়ে যাবে। সেটা এজন্য যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জাগতিক কাজকর্ম বেড়ে যাবে। আর তাকে সামাল দিতে নারীর সমর্থন চাই-ই চাই।
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। অতএব, স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সুচিকিৎসার কথা বলা হচ্ছে জোরেসোরে। বড় বড় হাসপাতাল আর পাকা ডাক্তার কবিরাজের কথাও শুনছি; কিন্তু শরীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে তার যে সুষম খাদ্যের দরকার, সেকথা বলা হচ্ছে না কোথাও। আগুন দরের খাবার কেনা সম্ভব নাহলে কি খেয়ে তারা বাঁচবে, শরীর টিকিয়ে রাখবে, প্রশ্ন সেটাই। রোগের জন্য দামি হাসপাতাল তৈরি করার আগে রোগ যাতে না হয়, সে চেষ্টা করাই বাঞ্ছনীয় বলে বোধ করি। ‘প্রিকশন ইজ বেটার দেন কিওর’ এ তো আমাদের শৈশবের শিক্ষা।
‘নারী’ যিনি মানুষ জন্ম দেন। অতএব, তার শারীরিক সুস্থতা চাই সবার আগে। যদিও সব মানুষের জন্যই এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য নারীকে তৈরি করতে হলে তার স্বাস্থ্যগত দিকটি সবার আগে বিবেচনায় আনতে হবে। তার খাবার, চিকিৎসা, ওষুধপত্র সবই নাগালের মধ্যে থাকা চাই। মানুষ বলতেই ‘জনমভর কাজ’। তবে শুধু কাজ নয়, চাই পরিমিত বিশ্রামও। তা না হলে, জীবন হবে এক বেদনার্ত দৌড়।
শুধু নারীর সৌন্দর্য নিয়ে চর্চা করার দিন গেছে বহু আগে। সে যে অলৌকিক শক্তি নিয়ে কাজও করতে পারে, এমন ধারণা বহুকাল মানুষের মধ্যে প্রায় ছিলই না। নারীর ব্যবহার ছিল অন্যরকম। নাচ গান। ফুর্তিফার্তা। তাদের নিয়ে এসবই চলত বেশি। ঠিক যেন দমের পুতুল। বাজার কাটতি পণ্য। ঘষেমেজে দিলেই হলো। যত সর্বনাশাই হোক, নারীর বুদ্ধির চেয়ে একসময় তাদের শারীরিক সৌন্দর্যের চাহিদাই ছিল বেশি। হয়ত এখনো তাই। এ নিয়ে নারীর উচ্চবাচ্যও ছিল না তেমন। তবে সময় পাল্টেছে। সৌন্দর্যের চেয়ে এখন বুদ্ধির কদরই বেশি করছে মানুষ।
মাথার সঙ্গে চুল যেমন অনিবার্য, তেমনি নারীর শারীরিক সুস্থতার পরপরই চলে আসে তার মানসিক সুস্থতার কথা। অর্থাৎ তার মেন্টাল হেলথ। সংসারে তার মান মর্যাদার কথা। মূল্যায়নের কথা। সংসার, পারিপার্শ্বিকতা তাকে কতখানি সাচ্ছন্দ্যে রেখেছে খুঁটে দেখতে হবে তাও। কর্মক্ষেত্রে অনেক সময় নারীরা স্নায়ুচাপে ভোগেন। অ্যাবিউজড হন। নিরাপত্তাহীনতা তাদের মানসিকভাবে কাবু করে ফেলে। যা নারীদের মানসিক সুস্থতার প্রতিবন্ধক। কাজেই এ বিষয়গুলো নজরে এনে নারীদের জন্য উপযুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
আগে ছিল কি না, জানি না। ছিলও হয়তো। সংসার নাট্যশালা হলে, নারীর সেখানে হরেকরকম চরিত্র। ঘরে বাইরে, সর্বত্র তাদের সাবলীল পদচারণা। চালিকাশক্তি তাদের এত বেশি যে, সোজাকথায় তাদের ‘চালক’ বললেই বোধহয় ঠিক হয়। ঘরে বসে লেখালেখি থেকে শুরু করে, ব্যবসা-বাণিজ্য, আদালতে বিচারিক কাজকর্ম এমনকি মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত তাদের দখলে। দক্ষতার সঙ্গে সেই পরিচয়ও তারা দিয়েছেন। নারীকে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায়ই তারা রাখেননি। এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল দেখেও পরিষ্কার বোঝা গেছে, লেখাপড়ার দৌড়েও মেয়েরাই এগিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীতো প্রশ্নই করে ফেললেন, ‘ছেলেরা পিছিয়ে কেন?’
শুনেছি ঘর ঠিক না থাকলে মানুষের কিছুই ঠিক থাকে না। আর পরিবার হচ্ছে সেই জায়গা, যেখানে মূল্যায়নের প্রশ্ন ওঠে। ওঠেই। অতএব, নারীর সঠিক মূল্যায়ন হতে হবে ঘর থেকে। সবার আগে। একই সঙ্গে পরিবারের সমর্থন নারীর জন্য অনেক বড় উৎসাহের কথা। পরিবারেই তার বেড়ে ওঠা। পরিবারই তার শক্তি। রোপিত চারার জন্য যেমন আলো-বাতাস আর জলের দরকার হয়, এও তেমনি।
ক্ষমতার চেয়ে দক্ষতার প্রয়োজন অনেক বেশি। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে এদেশে নারীদের ক্ষমতায়ন হয়েছে সত্যি তবে দক্ষ নারী জনশক্তি বলতে যা বোঝায় সেক্ষেত্রে তারা অনেকটাই পিছিয়ে। তাই নারী হওয়াই নারীর শেষ কথা নয়। নারীকে হতে হবে যথাযোগ্য নারী। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে নারীরা তাদের সহযোগিতার হাত বাড়াবেন, তার আগে নারীকে তৈরি করে নিতে হবে আরও বেশি। লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রযুক্তিগতভাবে তাদের সুশিক্ষিত এবং দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের নারীরা সংখ্যায় বেশি; কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে তাদের গুণগত মান কম। প্রযুক্তি শিল্পে নারীর অংশগ্রহণও খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে মাত্র ১-৮ শতাংশ নারী। অর্থাৎ যারা প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং দক্ষ। কারও কারও কাছে এখনো প্রযুক্তি বলতে শুধু একখানা মোবাইল।
ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের দেশে নারীদের এক বিশাল সংখ্যা রয়েছে গ্রাম এলাকায়, যাদের কাছে প্রযুক্তি মানে অগোছালো স্বপ্নের মতো। এক কৌতূহল মেশানো ভয়ও বটে। তারা কীভাবে এর আওতায় আসবেন সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। স্মার্ট কমিউনিটির খাতা থেকে তারা যেন কোনোভাবে বাদ না পড়েন।
নারী শক্তি বরাবরই আশ্চর্য গন্য। হলে কি হবে, তবু নারীর অসম্মানিত হবার ইতিহাস যুগ প্রাচীন। অবশ্য কখনো কখনো নারীরা নিজেই নিজেদের অসম্মান ঘটাতে অংশ নেন। এদেশে আনন্দ সমাবেশ ঘটিয়ে একদিকে যেমন পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। তেমনি নাবালিকা মেয়ে দণ্ডিত হয়, ধর্ষিতা হবার দায়ে। কপালে জোটে একশ বেত্রাঘাত। ফতোয়াবাজের ভাষায় যা ‘দোররা’! এও দেখি, স্ত্রীকে একটানা পনেরো বছর বিছানার সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন স্বামী। যৌতুক না পাওয়ার কঠিন শাস্তি! এই পরিত্রানহীন, অমানসিক কষ্ট এদেশের বহু নারীর বুক সাপটে থাকে! অতএব, নারীর শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তার নিরাপত্তার বিষয়টিও গন্য করতে হবে। ঘরে বাইরে তারা নিরাপদ কি না, তাও ভেবে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে- মানুষের জন্য প্রযুক্তি, প্রযুক্তির জন্য মানুষ নয়।
নারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়া এবং একই সঙ্গে সেই সুযোগ তারা যাতে কাজে লাগিয়ে সফল হতে পারেন, সেভাবেই তাদের গড়ে তুলতে হবে। বলা যায়, প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ তাদের জন্য একেবারে অনিবার্য। সামাজিক জীবন থেকে মানুষ এমনিতেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেকখানি। একই সঙ্গে জীবন প্রাকৃতিক না হয়ে, হয়েছে যান্ত্রিক। প্রাণহীন। শ্রীহিন। যা অন্তত মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর। কাজেই নারীর সামাজিক যে জীবন, তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রযুক্তির কারণে মানুষে মানুষে যোগাযোগ হচ্ছে; কিন্তু মানুষ একত্রিত হচ্ছেনা। আবার একত্রিত যদিওবা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হচ্ছে না। সামাজিকভাবে মানুষে মানুষে এই বিচ্ছিন্নতা টের পাওয়া যায়। যে কোনোভাবেই হোক একে কমিয়ে আনতে হবে।
নারীর মেন্টাল হেলথ বা মানসিক স্বাস্থ্য অনেকখানি নির্ভর করে তার সামাজিক জীবন কেমন, তার ওপর। কাজেই, শুধু প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ করা নয়, মানুষের যে মানবিক দিক তাকেও তরতাজা রাখতে হবে। প্রাণহীন করলে চলবে না। ঘর এবং ঘরের বাইরে নারীকে স্বস্তি, নিরাপত্তা সবকিছু দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত রাখা চাই। ‘নারী’ যে সেবা আর কল্যাণে চির সমর্পিত। মানুষের পাশে থাকার দায়বদ্ধতা যার চিরকালের।
একটি সভ্য এবং সুশিক্ষিত জাতি জন্ম দেবার জন্য নেপোলিয়ন বোনাপার্ট চেয়েছিলেন একজন শিক্ষিত মা। সেটা ১৮ শতকের কথা। তার উপলব্ধি ঠিকই ছিল। তার সেই সুচিন্তা ঢেউয়ের মতো তরঙ্গায়িত হয়ে এদেশের মানুষের মনের মধ্যে এসে পৌঁছেছে। নয়তো এতকাল পরে এসে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করতে দক্ষ নারীর প্রয়োজনীয়তা এত বড় করে ঠেকত না।
লেখক: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে