Views Bangladesh Logo

টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলে তামাকচাষে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য, ধ্বংসের মুখে জলজপ্রাণীও

বেশি মুনাফার লোভে সাধারণ ফসলের বদলে তামাকচাষে ঝুঁকছেন টাঙ্গাইলের ১১টি উপজেলার প্রান্তিক চাষি। অগ্রিম টাকা এবং তামাকের বীজ-সারসহ উৎপাদন ও প্যাকেজিং সরঞ্জাম দিয়ে তাদের এই বিষবৃক্ষ উৎপাদনে উৎসাহিত করছে দেশি-বিদেশি বিড়ি-সিগারেট কোম্পানিগুলো। বিশেষত ভুঞাপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল পরিণত হয়েছে তামাকের ক্ষেতে। ফলে উর্বরতা হারাচ্ছে যমুনার পলি মাটিতে ভরপুর জমি। পরিবেশদূষণ ও মাটির গুণাগুণের ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিও। বিশেষত তামাকচাষিদের মাঝে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। পুষ্টির জোগান বন্ধ হয়ে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন শিশুসহ সব বয়সীরাও।

তামাকের জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে নদী-জলাশয়ে মিশে ধ্বংসের মুখে মাছসহ সব ধরনের জলজ প্রাণী। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীব-বৈচিত্র্যও। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা আরও জানান, উৎপাদন মৌসুম আসার আগেই কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা উৎপাদিত তামাকের মূল্য নির্ধারণ করে অগ্রিম টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের নিয়মিত মাঠ পরির্দশন ও পরামর্শ দানসহ আরও কয়েকটি কারণে ক্ষতি জেনেও ফসল ছেড়ে তামাকচাষে ঝুঁকছেন কৃষক। ভুঞাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মোখলেছুর রহমান জানান, শুধু যমুনার চরাঞ্চলেই ৫৩ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে।

অর্জুনা ইউনিয়নের চর গাবসারা ঘুরে দেখা গেছে, তামাকচাষে নারীশ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। যমুনাপাড়ে জেগে ওঠা জমিতে পুরুষদের সমান তালে চাষের পাশাপাশি তামাক পাতা ও ডগা সংগ্রহের পর বাঁশের মাচাংয়ে শুকানোর কাজও করছেন নারীরা। সহযোগিতায় রয়েছে শিশুরাও। দুল্লি, আয়শা ও রুমেলাসহ কয়েকজন তামাকচাষি জানান, নারীদের রোজ বেতন ৩০০ টাকা আর পুরুষ পাচ্ছেন ৫৫০ টাকা করে। তবে তামাক পাতা ভাঙতে গামছার সঙ্গে হাত ধোয়ার সাবান পাচ্ছেন সবাই।

গাবসারার বাসিন্দা জালাল শেখ বলেন, বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে এবং অগ্রিম টাকা দিয়ে তামাকচাষে উৎসাহিত করছেন দেশি-বিদেশি বিড়ি-সিগারেট কোম্পানির প্রতিনিধিরা। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে শরীর ও পরিবেশের ক্ষতি জেনেও সাধারণ ফসল তুলে দিয়ে কৃষক ঝুঁকছেন তামাক চাষে! অন্য ফসলের তুলনায় তামাকচাষে দ্বিগুণ লাভ বলে দাবি তামাকচাষি শুকুর আলীর। তিনি স্বীকার করেন, ব্রিটিশ-আমেরিকান ও আকিজ টোব্যাকো কোম্পানিসহ টাঙ্গাইলের স্থানীয় বিড়ি ব্যবসায়ীরা কৃষকদের মাঝে বীজ-সার, বিষসহ ত্রিপল, পলেথিন প্যাকেজিং সরঞ্জাম সরবরাহ করন। চাষ করে ও শুকিয়ে সরবরাহ করেন চাষিরা।

কোম্পানির লোকেরা প্রতি কেজি তামাক প্রকারভেদে ১৩০ থেকে ২০০ টাকায় কিনে নেন বলেও জানান শুকুর আলী। রাজধানীর মহাখালী যক্ষ্মা-অ্যাজমা হাসপাতাল ইউস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. শরিফ তালুকদার জানান, দীর্ঘদিন তামাক চাষে যুক্ত থাকলে ক্যান্সারসহ পেটের পীড়া, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, চর্ম, বুক ও ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যারা তামাক বা সাদাপাতা চিবিয়ে খান বা ধূমপান করেন, তাদের হৃদরোগের হার অনেক বেশি।

ভুঞাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘চরাঞ্চলের অসহায় কৃষক না বুঝে বেশি মুনাফার আশায় তাদের জীবন ও জমির ক্ষতি করছেন। পরিত্রাণে কৃষকের মাঝে গণসচেতনতা এবং তামাকজাত পণ্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিতসহ তামাকচাষের ক্ষতিকর দিক নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন কৃষি বিভাগসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা’। তবে এজন্য কৃষি বিভাগের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন উপজেলার বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, তারা নিয়মিত মনিটরিং ও কৃষকদের নিয়ে তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সেমিনার এবং বিকল্প ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করলে তামাকচাষে উৎসাহিত হতেন না চরের চাষিরা।

পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম-সচিব শরিফুল ইসলাম বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি যখন ছিল না, তখন প্রতিটি গৃহস্থবাড়িতে ১০ থেকে ২০ জন বছর করা কৃষি শ্রমিককে প্রতিদিন তামাক হুক্কা খেতে দিতে হতো। এতে প্রচুর টাকা চলে যেত। ফলে কৃষক নিজের জমিতেই শ্রমিকের জন্য তামাকচাষ করতেন। এভাবেই তামাকচাষে কৃষকের উৎসাহের সূচনা। তিনি আরও বলেন, তামাক থেকে নিত্যনতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে মানবদেহে। পরিত্রাণ পেতে গণসচেতনতা এবং তামাকজাত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত করারোপ এখন সময়ের দাবি, যেন তামাকপণ্য খাওয়ায় উৎসাহিত না হন কেউ।

টাঙ্গাইল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর আমান উল্লাহ জানান, তামাকচাষ প্রক্রিয়া থেকে সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং ব্যবহারের পুরোটাই পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফলন বাড়াতে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে যমুনাসহ চরের নদী-নালার মাছ ও জলজ প্রাণী এবং পরিবেশসহ মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, তামাকচাষের বিষয়ে সরকারিভাবে তাদের কোনো নির্দেশনা নেই। এজন্য তারা কোনো মতামত ও চাষে হস্তক্ষেপ করেন না। তবে ‘তামাকচাষে কৃষককে নিরুৎসাহিত করতে গণসচেতনতার পাশাপাশি সরকারের আইনি ব্যবস্থা দরকার’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ