ইন্টারনেটের দাম কমানোর আহ্বান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের শীর্ষ নির্বাহীদের
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও ডিজিটাল সেবা খাতের পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে সোমবার আগারগাঁওয়ে বিটিআরসি ভবনে বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ নির্বাহীরা এক গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে মোবাইল ইন্টারনেট খরচ, কন্টেন্ট সেবাদাতাদের অন্তর্ভুক্তি, রেভিনিউ শেয়ার ও ফ্লোর প্রাইস নীতি পুনর্বিবেচনার বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়।
চালডালের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ওয়াসিম আলিম বৈঠকে বলেন, ‘ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের খরচ অনেক বেশি। আমাদের মোবাইল ইন্টারনেটের খরচও ব্রডব্যান্ডের মতো স্ট্যান্ডার্ডাইজ করা উচিত।’
তিনি উল্লেখ করেন, ইন্টারনেটের খরচ কমানো গেলে দেশের ই-কমার্স খাত আরও প্রসারিত হবে।
ওয়াসিম আলিম ২ জিবি ডেটা মাত্র ১০ টাকায় মাসিক হারে দিতে পারলে সাধারণ জনগণের মাঝে ইন্টারনেট ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন। তবে মোবাইল অপারেটরদের প্রতিনিধিরা এ প্রস্তাবের বাস্তবায়নে কিছু আর্থিক ও নীতিগত চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে বিটিআরসির সঙ্গে আরও আলোচনা চালিয়ে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
বৈঠকে গুগল ও ফেসবুকের মতো বৈশ্বিক কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাংলাদেশে আনার প্রয়োজনীয়তার বিষয়েও আলোচনা করা হয়।
বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘কন্টেন্টের দায়িত্ব কেবল কন্টেন্ট সরবরাহকারীদের ওপর দিলে বৈশ্বিক বিনিয়োগ আমাদের বাজারে আসা সহজ হবে।’ তবে তিনি স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ বিবেচনারও পরামর্শ দেন।
ডেটা প্যাকেজের জন্য ফ্লোর প্রাইস পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তার ওপরও আলোচনা হয়। উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমান ফ্লোর প্রাইস নীতির কারণে ইন্টারনেটের খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যা সাধারণ ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। তারা ফ্লোর প্রাইস বাতিলের প্রস্তাব দেন যাতে সাধারণ ব্যবহারকারীরা আরও সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন।
ফাহিম মাশরুর রেভিনিউ শেয়ার এবং মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে জড়িত এসওএফ ফান্ড পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি জানান, এই ফান্ডগুলো অপারেটরদের আর্থিক চাপে রাখে এবং তাদের ব্যবসার প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করে। দুই বছরের জন্য এসওএফ ফান্ড স্থগিত করার প্রস্তাব দেন, যাতে এ খাতে বিনিয়োগে আরও উৎসাহিত করা যায়।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী বলেন, ‘ইন্টারনেটের প্রবেশাধিকার মানুষের অধিকার এবং আমরা এই অধিকার সবার কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করছি।’
তিনি জানান, ইন্টারনেট খাতে সংস্কার নিয়ে বৈঠকে প্রাপ্ত পরামর্শগুলো বিবেচনায় নিয়ে আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করবে বিটিআরসি।
বিটিআরসির মহাপরিচালক (এসএম) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জুয়েল বলেন, "এক ধাপ এগিয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে যেতে হয়েছে এনইআইআর চালু করার বিষয়টি। আশা করছি কয়েক মাসের মধ্যেই এটি ফের পুরোপুরি চালু হবে। ডেটার ব্যবহার বাড়াতে ভল্টিকল নিয়ে কাজ করছি।"
এমআইএসটির সাবেক অধ্যক্ষ মেজর জেনারেল (অব.) ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, "এআই ভিত্তিক সল্যুশন ইআরপি বা স্বাভাবিক কোনো সেবা নয়। এই বাজারটা এখনো প্রস্তুত নয়। চ্যাটজিপিটি একাই এ কাজ করছে। এআই এর খাদ্য হচ্ছে ডেটা। তাই ডেটা শেয়ারের একটি প্লাটফর্ম থাকা দরকার।"
ব্র্যাক ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) সাব্বির হোসেন বলেন, "ইউএসডি ব্যহারে এসএমএস খরচ কমানো দরকার। টোল ফ্রি লাইন দ্রুততার মধ্যে নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। যেকোনো আপদকালীন সময়ে কীভাবে ডিজিটাল সেবা চালু রাখা যায় সে বিষয়ে রেগুলশন প্রত্যাশা করি।"
টেলিকম বিশেষজ্ঞ মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, "বিটিআরসি চাইলেই বিভিন্ন খাতের সেবা সুলভ করতে দায়িত্ব নিতে পারে। ডেটার ডুপলিকেশন বন্ধে দায়িত্ব নিতে হবে। নির্ভরযোগ্য ডেটা সেট প্রকাশে দায়িত্ব নিতে হবে। এছাড়াও এমএফএস সেবার অধিকার টেলকোকেও দেয়া দরকার।"
দারাজ বাংলাদেশের প্রধান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস রুশো বলেন, "ডিজিটাল সেবাই ভবিষ্যত। তাই এসএমইদের মধ্যে ইন্টারনেট ডেটার সুযোগ করে দিতে সেবা সাবসক্রিপশনে ছাড় দেয়া দরকার। অ্যাপে আইপিফোন ব্যবহারের বিষয়টি সহজতর করা দরকার।"
এইটিটিপুল বাংলাদেশের মুনাফ মুজিব চৌধুরী বলেন, "ডেটার অ্যাকসেস এর সঙ্গে এর মিনিংফুল ব্যবহারের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। ডেটা ব্যবহার করে আমরা কোন সার্ভিসে ভালো হবে সে বিষয়টিই জানে না অনেকে।বাংলাদেশের সঙ্গে মেটা বা ফেসবুকের সম্পর্ক খুব খারাপ। অথচ বাংলাদেশে ফেসবুকের বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনের বাজার। তাই বিটিআরসি এই খাতের ভালো-মন্দের বিষয়টির নিবিঢ় গবেষণা ও সৃজনশীল সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে।"
শেয়ার ট্রিপে সিইও সাদিয়া হক বলেন, "উদ্যোক্তা ইকোসিস্টেমে থাকা ব্যবসায়ীরা এখন ফান্ড রেইজের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ডেটার সঙ্কট নিয়ে আমরা ভুগছি। ভ্রমণে ডিজিটাল সেবা অন্তর্ভূক্তিও এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ইন্টারনেট এডুকেশনের ওপর সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।"
পাঠাও সিইও ফাহিম আহমেদ বলেন, "বিগত সরকারের সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পাশাশি ১৫ দিন বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ ছিলো। ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করে। সেই সময় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। তাই ডেটার লোকালাইজেশনের সঙ্গে ডেটা প্রোটেকশন ও কন্জিউমারস প্রোটেকশন নিয়ে আমাদের বেশি নজর দেয়া দরকার।"
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, "আমরা নিজেদের প্লাটফর্মে বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা যুক্ত করেছি। কিন্তু সেবা গুলো একেক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তাই বিষয়টি বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন ডিজিটাল সেবাদাতাদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যেতে চাই। তাই নীতামালার ভার্টিকাল রিফর্মেশন দরকার।"
শিখো প্রতিষ্ঠাতা শাহির চৌধুরী বলেন, "জুলাই অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিলো শিক্ষা থেকে শেষ হয়েছে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন নিয়ে। অপারেটরদের অবকাঠামোর উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া দরকার। তারা শিক্ষা কিংবা বিনোদনের কাজ করবে না। বৈষম্য দূর করতে ডিজিটাল সেবার বিকল্প নেই। একইসঙ্গে ডিজিটাল সেবা গ্রহণে নাগরীকদের অভ্যস্ত করে তোলাও আমাদের দায়িত্ব।"
সেবা এক্সওয়াইজেড সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইলমুল হক সজীব বলেন, "বৈষম্য বিজয়ের সুফল সব জায়গায় পৌঁছায়নি। এ কারণেই জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি। সঠিক ডেটা আমাদের তুলে ধরা দরকার। ঢাকার অনেক জায়গাতেই আমরা ভালো ইন্টারনেট পাইনা। রিয়েল প্লেয়ারদের সঙ্গে বসে ইন্টারনেটের খরচ কমাতে হবে।"
প্রাভা হেলথের টেকনোলজি অফিসার সাবরিনা ইমাম বলেন, "ঢাকার বাইরে টেলিমেডিসিন সেবা দেয়াটা কঠিন। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের দাম একটি বড় বাধা।"
বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. খলিল উর রহমানের সঞ্চালনায় গোলটেবিলে আরও আলোচনা করেন বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আমিনুল হক, কমিশনার ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী, গ্রামীণফোনের হেড অব ডিজিটাল চ্যানেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন জাহিদ জামান। এছাড়াও অনুষ্ঠানটিতে বিটিআরসি কমিশনার মাহমুদ হোসেন এবং কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইকবাল আহমেদ, এনডিসি এসময় উপস্থিত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে