এম এ খালেক
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিসংখ্যান মোতাবেক, গত নভেম্বর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এটা গত চার মাসের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। শহর এবং গ্রাম সর্বত্রই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উপনীত হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনীতিতে মুদ্রার জোগান কমিয়ে এনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা; কিন্তু বাস্তবে কোনো ব্যবস্থাই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হচ্ছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়তই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ধাবমান রয়েছে।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেও বাংলাদেশ কেন খাদ্য অনিরাপদ দেশ?
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানি বরার্ট ম্যালথাস তার বিখ্যাত জনসংখ্যা তত্ত্বে বলেছেন, ‘একটি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে।’ অর্থাৎ ১, ২, ৪, ৮, ১৬ এভাবে লাফিয়ে। আর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে- ১, ২, ৩, ৪, ৫ এভাবে ক্রামান্বয়ে। জনসংখ্যার মতো শিল্প উৎপাদনও বাড়ে জ্যামিতিক হারে। তাই কোনো দেশের কার্যকর ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবার আগে শিল্প উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। শিল্প উৎপাদনের একটি দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে জনগণের খাদ্য চাহিদা আমদানির মাধ্যমেও মেটানো যাবে। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী এখনো সমাদৃত; কিন্তু বাংলাদেশের মতো কোনো কোনো অপার সম্ভাবনাময় দেশ প্রমাণ করেছে যে, সবার ক্ষেত্রে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সঠিক নয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে, সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী কৃষক সুযোগ পেলে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে পারে।
ব্যাংক একীভূতকরণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের জন্য আইনি সংস্কার জরুরি
এই মুহূর্তে ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। অনেক দিন ধরেই দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ দিলেও কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে কর্ণপাত করেনি। সম্প্রতি অনেকটা হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভুত করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। একই সঙ্গে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি, যারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ‘দুষ্টক্ষত’ হিসেবে পরিচিত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের ব্যাপারে নড়েচড়ে বসলো কোনো। আর দুর্বল ব্যাংক একীভুতকরণের উদ্যোগই বা কেনো নিচ্ছে তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক একীভুতকরণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করে কঠোর আইনি ব্যবস্থার আওতায় আনার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা এমনি এমনি বা স্বপ্রনোদিত হয়ে করেনি।
ব্যাংকিং ও অর্থনীতির কিছু থিওরি নিয়ে সাধারণ আলোচনা
কথায় বলে, ‘কোনো কিছু না জানা অন্যায় নয়, জানতে না চাওয়া অন্যায়। আর সবচেয়ে বড় অপরাধ বা অন্যায় হচ্ছে, না জেনে জানার ভান করা।’ আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অজানা বিষয়ে জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন না। তারা এমনভাব করেন যেন সব কিছুই তিনি জ্ঞাত আছেন। অনেকেই কোনো বিষয়ে পাণ্ডিত্য ফলাতে চেষ্টা করেন; কিন্তু বিষয়টি তিনি নিজেই ভালোভাবে জানেন না। একজন মানুষের পক্ষে সব কিছু জানা সম্ভব নয়। তবে জানার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। যাতে কোনোভাবেই অজ্ঞতার বেড়াজালে আটকে অপমানিত হতে না হয়। পরস্পর মতবিনিময় করা একটি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে গণ্য হতে পারে। আমরা যারা ব্যাংকিং এবং অর্থনীতি নিয়ে কাজ বা চর্চা করি তাদের প্রায়শই বিভিন্ন নতুন নতুন টার্ম বা সূত্রের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। এগুলো সম্পর্কে সাধারণ বা প্রাথমিক জ্ঞান না থাকলে বিব্রত হতে হয়। তাই এখানে ব্যাংকিং এবং অর্থনীতির এমন কিছু টার্ম বা সূত্র সম্পর্কে আলোচনা করব, যা আমরা প্রায় প্রতিদিনই শুনতে পাই। উল্লেখ্য, আমি এখানে যে আলোচনা করব, তা খুবই সাধারণ মানের আলোচনা। এটা কোনো বিশেষজ্ঞ অভিমত নয়। কাজেই ভুল-ভ্রান্তি থাকাটাই স্বাভাবিক।
ব্যাংক একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ, না কি অবলুপ্তি?
বাংলাদেশ সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন পেয়েছে। ইতিমধ্যেই অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশের অনুকূলে আইএমএফের ঋণ অনুমোদিত হবার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেভাবে ঋণ চেয়েছে আইএমএফ ঠিক সেভাবেই ঋণ মঞ্জুর করেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ আইএমএফ কোনো দেশকে বিনা শর্তে ঋণদান করে না। হয়তো দেশ ভেদে ঋণের শর্ত কিছুটা কঠোর অথবা নমনীয় হতে পারে মাত্র।
বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে
স্বাধীনতার পর একজন মার্কিন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ সফরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য উপস্থাপনকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেন ত্বরান্বিত হচ্ছে না, সে সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ অধ্যাপক বলে ওঠেন, আপনারা আমাদের অর্থনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন বলেই আমাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ বক্তব্য শ্রবণ করার পর মার্কিন অধ্যাপক কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, যে দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আমাদের মতো দেশের ঋণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই দেশের অর্থনীতি নিয়ে আমরা কথা বলব না তো কে বলবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক সেদিন আর কিছু বলতে পারেননি। এটাই বাস্তবতা।
‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ কি চিহ্নিতকরণ সম্ভব হবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১২ মার্চ ব্যাংকিং সেক্টরের ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে সার্কুলার জারি করেছে। এই সার্কুলারটি বর্তমান মুহূর্তে ব্যাংকিং সেক্টরের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। অনেকেই মনে করছেন, এবার বুঝি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা জালে ধরা পড়তে যাচ্ছেন। অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই ব্যাংকিং সেক্টরের ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য দুটি দাবি করে আসছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যত উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিত্বই করেছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬০তম মিউনিক নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশগ্রহণ ছিল বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৬০ বছর ধরে ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র জার্মানিতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ১৯৬৩ সালে এই সম্মেলনের যাত্রা শুরু হয়। শুরুর দিকে এই সম্মেলনটি ছিল অনেকটাই পশ্চিমা বিশ্বকেন্দ্রিক। সেই সময় স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছিল সে পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টিই প্রথম দিকে সম্মেলনে গুরুত্ব পেতো। এক সময় ঠান্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ারের পরিসমাপ্তি ঘটে। ঠান্ডা যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর মিউনিক নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা ইস্যু এখানে আলোচিত হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একাধিকবার এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি এ সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল।
সবার জন্য বীমা, এটাই হোক জাতীয় বীমা দিবসের অঙ্গীকার
আজ পহেলা মার্চ চতুর্থ জাতীয় বীমা দিবস। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাতীয় বীমা দিবস নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় বীমা দিবস পালন করা হয়। মাঝখানে এক বছর করোনার কারণে জাতীয় বীমা দিবস পালিত হয়নি। জাতীয় জীবনে বীমা শিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বীমা কীভাবে অবদান রাখতে পারে, সে সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্যই জাতীয় বীমা দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। পহেলা মার্চ জাতীয় বীমা দিবস পালনের পেছনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যুক্ত রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ পাকিস্তান আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদানের মাধ্যমে বীমা শিল্পে কাজ শুরু করেছিলেন। বীমা শিল্পে বঙ্গবন্ধুর যুক্ত হওয়ার ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই মূলত পহেলা মার্চ জাতীয় বীমা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন
বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ বিরাজ করছে। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ হচ্ছে মুদ্রানীতি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, চরিত্রগত দিক থেকে তা সংকোচনমূলক। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে এই উদ্যোগ বিলম্বে নেয়া হয়েছে। আর যে মাত্রায় সংকোচন করা হচ্ছে, তা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ততটা পর্যাপ্ত হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ মূল্যস্ফীতি তো এক কারণে সৃষ্টি হয়নি। মূল্যস্ফীতির আরও অনেক কারণ রয়েছে। কাজেই শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।