Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

টর্ট আইনে অপরাধ ও ক্ষতিপূরণ মামলা

Md J R Khan Robin

মো. জে আর খান রবিন

শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

'টর্ট' শব্দটি ল্যাটিন শব্দ 'tortum' হতে উদ্ভূত, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাঁকা। অতএব, টর্ট বলতে সোজা পথ হতে বিচ্যুতি বা বাঁকা চলন বোঝায়। নরম্যান বিজয়ের পর থেকে এ শব্দটি ব্রিটিশ আইনে অনুপ্রবেশ করে। ইংরেজি ভাষায় এর প্রতিশব্দ হচ্ছে 'Wrong' এবং রোমান ভাষায় বলা হয় 'delict'। বাংলা ভাষায় সকলের ব্যবহারযোগ্য কোনো প্রতিশব্দ এখন বের হয়নি। তাই কেউ একে 'দেওয়ানি ক্ষতি', কেউ 'নিম চুক্তি' আবার কেউ একে 'ব্যক্তিগত অপকার' হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন।

সদা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে টর্টের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব হয়নি। স্যামন্ডের মতে, টর্ট হচ্ছে চুক্তিভঙ্গ ব্যতিরেকে এক প্রকার দেওয়ানি অপকার, যার প্রতিকার হচ্ছে আর্থিক ক্ষতিপূরণ। ফ্রেজার বলেন, টর্ট হলো ব্যক্তি বিশেষের অধিকার খর্ব করা, যা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে মামলার সাহায্যে ক্ষতিপূরণ আদায়ের অধিকার প্রদান করে। ক্লার্ক ও লিন্ডসেলের মতে, চুক্তি ব্যতিরেকে একটা অপকার হচ্ছে টর্ট যা ইংল্যান্ডের সাধারণ আইনে (Common Law) প্রতিকারযোগ্য। পরবর্তীকালে স্যার ফ্রেডারিক পুলক একটা সুন্দর সংজ্ঞা প্রদান করেন যেটাকে আন্ডারহিল আরও উন্নত করেন। তাদের মতে, টর্ট হচ্ছে এমন কাজ করা বা কাজ হতে বিরত থাকা যা আইনের দ্বারা সমর্থিত নয় এবং যা চুক্তির সঙ্গে সম্পর্কবিহীন, যার ফলে (ক) অপরের চূড়ান্ত অধিকার খর্ব অথবা (খ) অপরের সীমাবদ্ধ অধিকার, যা ক্ষুণ্ণ হলে ক্ষতির কারণ ঘটে। অথবা (গ) সর্বজনীন অধিকার, যা ক্ষুণ্ণ হলে সাধারণ ক্ষতি ছাড়াও বিশেষ কোনো ক্ষতি ঘটায় এবং এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে মকদ্দমার মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতিপূরণের অধিকার প্রদান করে।

আন্ডারহিল তার সংজ্ঞায় যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা হলো–প্রথমত, কোনো কাজ করা বা করা হতে বিরত থাকা যার বাধ্যবাধকতা চুক্তির দ্বারা সৃষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, উক্ত কাজ বা নিবৃত্তি আইনের দ্বারা সমর্থনীয় নয়। তৃতীয়ত, এ বেআইনি কাজ বা নিবৃত্তি কোনোভাবে বাদীর বিশেষ ও ব্যক্তিগত ক্ষতির সৃষ্টি করে যা সাধারণ ব্যক্তির ক্ষতি হতে ভিন্নতর।
যা হোক বিভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে টর্টের বৈশিষ্ট্য হলো:

প্রথমত, টর্ট হচ্ছে কোনো একটা কার্যসম্পন্ন করা বা করা হতে বিরত থাকা। কোনো কাজ করা যখন কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে, তখন তা না করাও নেতিবাচক কার্য সম্পাদন বোঝায়। দ্বিতীয়ত, যে কার্য বা নিবৃত্তি আইনের দ্বারা সমর্থনীয় নয়। কথায় বা কাজে অন্যের ক্ষতি না করাই হচ্ছে টর্টের মূল নীতি। তৃতীয়ত, টর্ট হচ্ছে দেওয়ানি অপকার। এ বৈশিষ্ট্যের ফলে দণ্ডনীয় অপরাধ হতে একে পৃথক করা যায়। চতুর্থত, টর্ট ছাড়া অন্যান্য দেওয়ানি অপকার যেমন চুক্তি ভঙ্গ ইত্যাদি হতে নিজ বৈশিষ্ট্যগুণে পৃথক। পঞ্চমত, টর্ট নৈতিকতাবিরোধী কার্য নয়। ষষ্ঠত, টর্টের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের অধিকার দেয়। এ ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনির্ধারিত বা অনিরূপিত। যদিও আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও অন্যান্য প্রতিকার দাবি করা যায় তবুও অনির্ধারিত ক্ষতিপূরণই হচ্ছে টর্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

ব্রিটিশ কমন ল-এর মাধ্যমে টর্ট প্রতিকারযোগ্য বিধায় বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্তের ফলেই এ আইনের পরিপূর্ণতা ও উৎকর্ষতা লাভ করে। ব্রিটিশ টর্ট আইনের নীতিগুলোই আমাদের দেশে তথা বাংলাদেশ-পাকিস্তান- ভারত উপমহাদেশে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

আধুনিক কালের টর্ট আইন প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ 'alterium non leadere'-এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এ মতবাদের অর্থ হলো কথায় বা কাজে কারও ক্ষতি না করা। সামাজিক এ কর্তব্য হতে কেউ বিচ্যুত হলে আইনত সে দায়ী।

ব্যক্তিস্বাধীনতা সব সমাজেই স্বীকৃত; কিন্তু এ অধিকার ভোগ করতে গিয়ে অন্যের অধিকারের প্রতিও সজাগ থাকতে হবে। একজনের যেমন গান-বাজনা করার অধিকার আছে, তার প্রতিবেশীরও অধিকার আছে যেন তার ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যে কেউ হস্তক্ষেপ না করে। বাক স্বাধীনতা আছে বলেই এমন কিছু বলা যাবে না যা অন্যের সুনাম ক্ষুণ্ণ করে। এরূপ সামাজিক কর্মকাণ্ডের জটিলতায় সম্ভাব্য স্বার্থ সংহাত হতে নাগরিকদের রক্ষা করাই টর্টের মূল উদ্দেশ্য। ইচ্ছাকৃতভাবে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে অবশ্যই দায়ী হতে হয়, কিন্তু অনিচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপের জন্যও দায়িত্ব এড়ানো যায় না, কারণ অভিপ্রায়ের চেয়ে আচরণকেই টর্টে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এ কারণে টর্টের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ, বিশ্বাসভঙ্গ ও ফৌজদারি অপরাধের পার্থক্য রয়েছে। ।

টর্টের উপাদানগুলো; ১। অন্যায় কাজ বা নিবৃত্তি, ২। মানসিক সায় ৩। আইনগত ক্ষতি ৪। প্রত্যক্ষ ফল ৫। বৈধ সমাধান। অন্যদিকে টর্ট প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে যেমন; (১) সম্মতি বা ভলেনটি নন্ ফিট্ ইন্জুরিয়া (২) অনিবার্য দুর্ঘটনা (৩) অনিবার্য ভ্রান্তি (৪) দৈব ঘটনা (৫) রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি (৬) বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলি (৭) বিধিবদ্ধ সংস্থা (৮) পিতৃত্বের অধিকার (৯) আত্মরক্ষা (১০) আবশ্যকতা এসব ক্ষেত্রে টর্ট প্রয়োগ করা যায় না। টর্টের জন্য সাধারণত (১) বিচার বিভাগীয় প্রতিকার এবং (২) বিচারালয় বহির্ভূত প্রতিকার প্রার্থনা করা যায়। আদালতের মাধ্যমে যে সকল প্রতিকার পাওয়া যায় সেগুলো বিচার বিভাগীয় প্রতিকার। আর্থিক ক্ষতিপূরণ, নিষেধাজ্ঞা, সম্পত্তি প্রত্যর্পণ, বিধিবদ্ধ আইনের প্রতিকার, ইত্যাদি বিচার বিভাগীয় প্রতিকার। আদালতের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই অপ্রকৃত ব্যক্তি যে সকল প্রতিকারের হকদার সেগুলো হচ্ছে বিচারালয় বহির্ভূত প্রতিকার। আত্মসহায়তা, পুনরুদ্ধার, পুনঃপ্রবেশ, উৎপাত অপসারণ, ক্ষতিপূরণ আদায় সাপেক্ষে মালামাল আটক, ইত্যাদি বিচারালয় বহির্ভূত প্রতিকার। সবাই টর্টের অধীন মামলা দায়ের করতে পারে তবে ১। বিদেশি শত্রু ২। গুরুতর অপরাবে অপরাধী বা সম্ভিত ব্যক্তি, ৩। দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তি, ৪। স্বামী ও স্ত্রী, ৫। গর্ভস্থ শিশু, ৬। অনিবন্ধিত সংঘ ৭। করপোরেশন মামলা করতে পারে না। এবার দেখা যাক টর্টসমূহ কি? সুনির্দিষ্ট টর্টসমূহ হচ্ছে; ১। শরীরে অনধিকার হস্তক্ষেপ (আক্রমণ, আঘাত ও কৃত্রিম বন্দি) ২। বিদ্বেষ প্রসূত মামলা (মিথ্যা মামলা) ৩। ভূমিতে অনধিকার প্রবেশ ৪। দ্রবাদি সংক্রান্ত টর্ট ৫। মানহানি ৬। অবহেলা ৭। উৎপাত ৮। পরার্থ দায় ৯। পরম দায় ১০। বিপজ্জনক ভূমি ও ঘরবাড়ির জন্য দায়দায়িত্ব ১১। বিপজ্জনক বস্তুর জন্য দায়দায়িত্ব ১২। ইকোনমিক টর্ট ১৩। ষড়যন্ত্র ১৪। চুক্তিতে হস্তক্ষেপ ১৫। অবৈধ ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ১৬। প্রতারণা ১৭। গোপন তথ্য ফাঁস ১৮। ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি।

আমরা প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো অবহেলাজনিত মৃত্যুর খবর পেয়ে থাকি। এ রকম মৃত্যু সাধারণত গাড়িচাপায়, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে, ডাক্তারের অবহেলায়, ম্যানহোলে পড়ে, নির্মাণাধীন বিল্ডিং হতে ইট পড়ে, আগুন লেগে, বিল্ডিং ভেঙে সংঘটিত হয়।

এখন দেখার বিষয় আমাদের দেশে টর্টের আওতায় প্রতিকার পাওয়া সম্ভব কিনা? এক্ষেত্রে বলা যায় বর্তমানে ধীরে হলেও টর্ট আইনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে এবং ক্ষতিপূরণ দাবির মামলাও অনেকে করছেন। ক্ষতিপূরণ দাবির মামলার প্রতি উচ্চ আদালতের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এর গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। অবহেলাজনিত মৃত্যুর কারণে সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর পরিবারকে তিন কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন । সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ে তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন, তাছাড়াও উচ্চ আদালত, ইউনাইটেড হসপিটাকে অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের পরিবারকে, নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালাম বিনা অপরাধে জেলখাটায় জাহালামকে, ফ্লাই ওভারের গার্ডার পড়ে নিহত ও আহত হওয়ায় নিহতদের পরিবার ও আহতদেরকে, বাস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।

সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রিট আবেদনের পরিপেক্ষিতে, ভুল চিকিৎসায় শিশু আয়ানের মৃত্যুতে, কক্সবাজারের চকরিয়ার গাড়ি চাপায় ৬ ভাইয়ের মৃত্যুতে, বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র নাইমুল আবরার রাহাতের মৃত্যুতে, সিলেটে ড্রেনে পড়ে আবদুল বাসিত মোহাম্মদের মৃত্যুতে, বরিশালে বিদ্যুৎ লাইনে জড়িয়ে শিশু জুবায়ের হাত হারানোর কারণে, নারায়ণগঞ্জ ও চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুতে সংশ্লিষ্টদেরকে/পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে মহামান্য হাইকোর্ট পৃথক পৃথক রুল জারি করেন।

তবে টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ প্রার্থনার সুযোগ থাকলেও আমাদের দেশে এখনো এ আইন সম্পর্কে অনেকেরই অজানা তাই এর প্রয়োগ নাই বললেই চলে। তবে শাস্তির জন্য দণ্ডবিধির ৩০৪/৩৩৭ ধারামতে ফৌজদারি আদালতে এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার প্রার্থনা করা যায়। অন্যদিকে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানুষের জীবনের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। সুতরাং উক্ত ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ায় হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করে টর্টের আওতায় ক্ষতিপূরণ প্রার্থনা করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রেও সমস্য রয়েছে কারণ আমাদের দেশে ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়।

এ সব প্রতিকার প্রার্থনার ক্ষেত্র সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ছাড়াও সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের যে কোনো নাগরিক সৎ উদ্দেশ্যে দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে ও জনগণের পক্ষে মামলা দায়ের করতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের দেশে টর্ট আইনের যথেষ্ট ব্যবহার ও প্রয়োগ না থাকায় অনেকেই টর্ট এবং টর্ট আইনের সঙ্গে পরিচিত নন। অথচ আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এমন গুরুত্বপূর্ণ আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সতরাং অবহেলাজনিত মৃত্যুর রোধ কল্পে ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্য টর্ট আইন ও বিধি প্রণয়ন এখন সময়ের দারি।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ