Views Bangladesh Logo

‘সাদা-কালো’ মোহামেডানে রঙের ছোঁয়া

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

ট্রান্সফার মার্কেট ডটকমের দেওয়া তথ্য বলছে, ইন্টার মিলানের স্কোয়াড মূল্য ৬৬৩ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ইউরো। বিপরীতে বার্সেলোনার স্কোয়াড মূল্য ১ দশমিক ০২ বিলিয়ন ইউরো। বার্সাকে হারিয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে নাম লেখায় ইতালিয়ান ক্লাবটি। স্কোয়াড মূল্য যে কেবলই একটি সংখ্যা- এটি প্রমাণিত হয় প্রায়ই। প্রমাণিত হয়েছে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও। ঘরোয়া ফুটবলেও কিন্তু সেটা প্রমাণিত হলো- কাগজ-কলমের হিসাবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রমাণ করল মোহামেডান। কাগজ-কলমের হিসাবে গেল কয়েক মৌসুমের মতো এবারও হেভিওয়েট দল বসুন্ধরা কিংস। আবাহনী মৌসুমের অর্ধেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে স্থানীয় ফুটবলারদের সমন্বয়ে। মোহামেডানের স্থানীয় খেলোয়াড়দের সঙ্গে তুলনা টানলে আবাহনীকেই কিন্তু এগিয়ে রাখতে হবে। সেই মোহামেডান এবার লিগ শিরোপা ঘরে তুলল বসুন্ধরা কিংস ও আবাহনীকে টপকে।

এ সাফল্য অবশ্য হুট করে আসেনি। সাফল্যের বীজ বপন করা হয়েছিল ২০২৩ সালের মার্চে, আলফাজ আহমেদের হাত ধরে। গল্পটা আরেকটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। ২০২২ সালে ব্রিটিশ কোচ শন লেন দায়িত্ব ছাড়ার পর মোহামেডানের ডাগ-আউটে দাঁড়ান ক্লাবটির সাবেক ফুটবলার এবং কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক। অভিজ্ঞ এ কোচের অধীনে মাঠের নৈপুণ্য প্রত্যাশিত হচ্ছিল না, দল চলে গিয়েছিল রেলিগেশন অঞ্চলের কাছাকাছি। ওই অবস্থায় ঘরের ছেলে শফিকুল ইসলাম মানিকের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটে মোহামেডানের। আপদকালীন অবস্থায় দায়িত্ব নেন আলফাজ আহমেদ। সাবেক এ তারকা স্ট্রাইকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর অধ্যায়ের সূচনা।

২০২৩-২৪ মৌসুমে ফেডারেশন কাপ শিরোপা দিয়ে ক্লাবটি বড় কিছুর পূর্বাভাস দিয়েছে। সে মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে বসুন্ধরা কিংসকে ধাওয়া করলেও ধরতে পারেনি সাদা-কালো জার্সিধারীরা। ২০২৪-২৫ মৌসুমের শুরুটা চ্যালেঞ্জ কাপ ফাইনাল দিয়ে। বসুন্ধরা কিংসের বিপক্ষে লিড নিয়েও ৩-১ ব্যবধানে হারা মোহামেডান ফেডারেশন কাপেও সুবিধা করতে পারেনি; কিন্তু লিগের শুরু থেকেই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি ছিল অপ্রতিরোধ্য! টানা ৮ জয়ের পর প্রথম লেগের শেষ ম্যাচে এসে ইয়াংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাবের কাছে হারতে হয়েছে। সে হারের পর আর বড় ধাক্কা খেতে হয়নি। মাঝে আবাহনীর সঙ্গে গোলশূন্য এবং ফরটিজ এফসির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করা মোহামেডান বাকি ম্যাচগুলোতে জয়ের চেনা পথেই ছিল। যা লিগ শিরোপা জয়ের কাছাকাছি নিয়ে আসে সমর্থনপুষ্ট ক্লাবটিকে। পঞ্চদশ রাউন্ডে মোহামেডান জিতেছে; কিন্তু সে রাউন্ডে আবাহনী হেরে যাওয়ায় শিরোপা নিশ্চিত হয় আলফাজ আহমেদের দলের।

দেশের ফুটবলে পেশাদার মোড়ক লাগানোর প্রায় অর্ধযুগ আগে, ২০০১-০২ মৌসুমে সর্বশেষ ঘরোয়া শীর্ষ লিগ শিরোপা ঘরে তুলেছিল মোহামেডান। ক্লাবটির সর্বশেষ বড় সাফল্য ছিল ২০০৫-০৬ মৌসুমের জাতীয় লিগ শিরোপা জয়। দেশের ফুটবলের ওপর পেশাদার মোড়ক লাগার পর সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল সুপার কাপ জয়। কোটি টাকার প্রাইজমানির আলোচিত আসরের তিন সংস্করণে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। তা দিয়ে কি আর লিগ জয়ের আক্ষেপ আড়াল করা যায়! ২০০৭ সালে শুরু হওয়া পেশাদার লিগ তাই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির কাছে আক্ষেপের অধ্যায় হয়ে ছিল। সে আক্ষেপ দূর হলো তিন ম্যাচ হাতে রেখে।

১৬ মে পঞ্চদশ রাউন্ডের ম্যাচ খেলেছে মোহামেডান, পরদিন ছিল ফরটিজ এফসির বিপক্ষে আবাহনীর ম্যাচ। ওই ম্যাচে আবাহনী হারলে শিরোপা নিশ্চিত হবে- এমন সমীকরণে মোহামেডান ক্লাব সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি ছিল কুমিল্লা স্টেডিয়ামে। ফরটিজ এফসির সঙ্গে প্রথম লেগের ম্যাচে আবাহনী ড্র করায় কৌতূহলটা বেশি ছিল। বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে দশজনের ফরটিজ এফসির কাছে আবাহনী হেরে যাওয়ায় শিরোপা নিশ্চিত হয়, রঙের ছোঁয়া লাগে সাদা-কালো শিবিরে। পরদিনই ক্লাবটি সজ্জিত হয় বাহারি আলোয়। উৎসুক সমর্থকদের আনাগোনা বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোহামেডানকে ঘিরে আবেগ-উচ্ছ্বাসের বান বইছে। মাঠের খেলায় শিরোপা নিশ্চিত না হওয়ায় উৎসবটা পূর্ণতা পায়নি। বিলম্ব উদযাপনে ক্লাব কর্মকর্তারা সাজাচ্ছেন নানা পরিকল্পনা।

আবাহনী-ফরটিজ এফসির মধ্যকার যে ম্যাচ মোহামেডানের শিরোপা ভাগ্য লিখে দিল, সেটা ক্লাব ট্যান্টে বসে সহকর্মীদের সঙ্গে দেখছিলেন মোহামেডানের প্রধান কোচ আলফাজ আহমেদ। ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব ছাড়াও এসময় আলফাজ আহমেদের সঙ্গী ছিলেন কোচ আব্দুল কাইয়ুম সেন্টু। শিরোপা নিশ্চিত হলেও এখনো মোহামেডানের হাতে তিনটি ম্যাচ। আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত সে তিন ম্যাচের প্রথমটির প্রতিপক্ষ রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি। পুরান ঢাকার ক্লাবটির বিপক্ষে ম্যাচের গুরুত্ব না থাকলেও মোহামেডানের উদযাপনের জন্য সেটা কৌতূহল জাগাচ্ছে। ক্লাবটির কিংবদন্তি প্রয়াত বাদল রায়ের ঘরের মাঠ কুমিল্লা স্টেডিয়ামে সে ম্যাচ খেলবে মোহামেডান। তাই গুরুত্বহীন এ দ্বৈরথ ঘিরেও আবেগ-উচ্ছ্বাসের গল্পের প্রতীক্ষা থাকছে।

ফুটবলের পেশাদারি যুগে বিবর্ণ মোহামেডানে রঙের ছোঁয়া লাগানোয় যার কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি মনে করা হয়, সেই আলফাজ কিন্তু এখন ‘সমবেত সংগীত শিল্পী’ গাইছেন! সাবেক স্ট্রাইকার এ সাফল্যের কৃতিত্ব ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে ভাগ করে দিলেন, ‘এখানে সকলের ভূমিকা সমান। ক্লাব সভাপতি, ক্লাবটির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা, কোচিং স্টাফ ছাড়াও মোহামেডানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের অবদান আছে এখানে। সবচেয়ে বেশি অবদান খেলোয়াড়দের। তারা মাঠে সেরাটা দিয়েছে।’ আলফাজ আহমেদের সঙ্গে কিন্তু পেপ গার্দিওলার সুর মিলে যাচ্ছে! ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর এ কোচকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘সাফল্যের রহস্য কী?’ উত্তরে স্প্যানিশ ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘এখানে আবার রহস্য থাকবে কেন! বিষয়টা পরিষ্কার, ক্লাব সভাপতি হতে শুরু করে গ্রাউন্ড স্টাফ- ক্লাবের সকলে একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছি।’ আলফাজ আহমেদের কথায় মোহামেডানও একই সূত্র প্রয়োগ করেছিল!

কোচ যতই সমবেত সংগীত গাইছেন, একটা সাফল্যের পেছনে তো কিছু গল্প থাকেই। মোহামেডানের এ সাফল্যের ক্ষেত্রে সে গল্পটা কী? এবার একটু গা-ঝাড়া দিলেন আলফাজ আহমেদ, ‘একটা দল নিয়ে আমরা কয়েক মৌসুম ধরে কাজ করছি। এ সময়ের মধ্যে খুব বেশি খেলোয়াড় আমরা দলে নিইনি, খুব বেশি খেলোয়াড় কিন্তু আমাদের ছেড়ে যায়নি। ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবের সঙ্গে আমরা দলের সমন্বয়টা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। হয়তো এটাই সুফল এনে দিয়েছে।’ মাঠের বাইরে সবকিছু নিপুণ হাতে সামলেছেন ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব। মাঠের কৌশল ঠিক করেছেন আলফাজ আহমেদ-আব্দুল কাইয়ুম সেন্টুরা। মাঠে সেরাটা নিংড়ে দিয়েছেন সুলেমান দিয়াবাতে, মুজাফফর মুজাফফরভ, এমানুয়েল সানডে, মেহেদী হাসান মিঠু, শাকিল আহাদ তপু, সুজন হোসেন, মিনহাজুর আবেদীন রাকিব, জাহিদ হাসানরা।

গেল মৌসুমে মোহামেডানের জার্সিতে উজ্জ্বল ছিলেন শাহরিয়ার ইমন, হাসান মুরাদ, কামরুল ইসলাম ও জাফর ইকবাল। প্রতিষ্ঠিত চার ফুটবলার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি ছেড়ে আবাহনীতে নাম লিখিয়েছেন। শূন্যতা পূরণে মোহামেডানকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি, বরং যাদের নেওয়া হয়েছে, তারা নিজেদের দারুণভাবে মেলে ধরেছেন; পেশাদার যুগে মোহামেডানের প্রথম লিগ জয়ের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের নাম জুড়েছেন। সাদা-কালো জার্সিধারীদের এ সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান তিন বিদেশি ফুটবলার- উজবেকিস্তানের মুজাফফর মুজাফফরভ, নাইজেরিয়ার এমানুয়েল সানডে এবং মালির সুলেমান দিয়াবাতের। মাঝমাঠে খেলাটা গড়া মুজাফফর মুজাফফরভ গোলও করছেন, দলের প্রয়োজনে রক্ষণে দারুণ ভূমিকাও রেখেছেন। আক্রমণভাগের কেন্দ্রে থাকা এমানুয়েল সানডে ও সুলেমান দিয়াবাতের লিগে গোল সংখ্যা সমান, ১০টি করে। রহমতগঞ্জের স্যামুয়েল বোয়েটাং(১৪) শীর্ষ গোলদাতা তালিকায় তাদের ওপরে আছেন।

ক্লাব সংশ্লিষ্টদের উৎসবের উপলক্ষ এনে দেওয়া সাফল্য সম্পর্কে মোহামেডান কোচ আলফাজ আহমেদ আরও বলছিলেন, ‘দলের সকলে নিজেদের ওপর আস্থা রেখে লম্বা সময় শ্রম দিয়েছেন, ঘাম ঝরিয়েছে। ক্লাব সংশ্লিষ্ট কারোর প্রচেষ্টার কোন ঘাটতি ছিল না। অনেক প্রচেষ্টা এবং পরিশ্রমের ফল এ লিগ শিরোপা।’ পেশাদার লিগ শুরুর পর টানা তিন আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আবাহনী, তিনবারই রানার্স-আপ ছিল মোহামেডান। মাঝে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের উত্থানে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি মাঝে ছিল ব্যাক-বেঞ্চার! ২০২৩-২৪ মৌসুমে মোহামেডান রানার্স-আপ হয়েছে। ১৬ সংস্করণে চারবার রানার্স-আপ হওয়ার পর সপ্তদশ আসরে এসে মিলল শিরোপা নামক সোনার হরিণ। আবাহনী (৬), বসুন্ধরা কিংস (৫), শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব (৩) এবং শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র ছিল এতদিন চ্যাম্পিয়ন তালিকায়। এবার সেখানে যুক্ত হলো মোহামেডানের নাম।

মাহবুব সরকার: লেখক সাংবাদিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ